স্বামী বিবেকানন্দের চোখে শ্রীরামকৃষ্ণের যে ভাবমূর্তি ফুটে উঠেছে তা তিনি নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তার মধ্যে একটি উক্তি হল, ‘‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভারতবর্ষের সমগ্র অতীত ধর্মচিন্তার সাকার বিগ্রহস্বরূপ। যে তাঁকে নমস্কার করবে সে সেই মুহূর্তে সোনা হয়ে যাবে।’’ আসলে স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন সনাতন ভাবতবর্ষের যে রূপ, তাতে বিচিত্র বৈচিত্র যুক্ত হয়েছে বলেই, তা এত সজীব। শ্রীরামকৃষ্ণ সজীব প্রাণচঞ্চল ভারতবর্ষের মূর্ত প্রতীক। আমরা সবাই জানি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বাণী বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের প্রচারক হয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণের সেইসব বাণী যে কতখানি গভীর অর্থবহন করে, তা আজকেও আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। তাই আজ তাঁর ১৮৭তম জন্মতিথিতেও সমানভাবে পরমহংসদেবের কথা এত যুগোপযোগী। তিনি বলতেন, ‘‘নেতি নেতি করে করে এক্কেবারে শেষকালে যা বাকি থাকে তাই, সেই এক জানাই জ্ঞান, আর অনেক জানা অজ্ঞান।’’ পরমহংসের মনের ছোঁয়ায় যিনি হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর কাছে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’, তিনি শিকাগো বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের ধর্মের সনাতন রূপটি তুলে ধরলেন সারা বিশ্বে। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন তাঁর গুরু, ঠিক তেমনভাবেই তিনি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বাণী প্রচার করতে শুরু করলেন। কী ছিল সেই বাণী? ‘যত মত তত পথ’— অতি সহজ- সরল ক’টি কথা। এই কথাগুলিতেই যেন কেঁপে গেল ধর্মের নামে অধর্মের বুজরুকি। স্বামী বিবেকানন্দ যদি শ্রীরামকৃষ্ণের এই বাণী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে না দিতেন তা হলে কি সত্যি বিশ্ববাসী জানতে পারত, এই যুগোপযোগী বাণীর মর্ম। রামকৃষ্ণ স্বয়ং মা কালীর ভক্ত হয়েও তাঁর উদার মন ও ক্ষমাশীল দৃষ্টিতেই আকৃষ্ট হয়েছেন অগণিত ভক্ত। স্বামীজি সর্বধর্ম স্বরূপ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বেদান্তভিত্তিক সাম্য ও সেবার বাণী প্রচার করতে গিয়ে কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন হিন্দুদের দ্বারা। এই হিন্দুধর্ম জাগরিত করার জন্যই কিন্তু তিনি আমেরিকায় গিয়ে মহা ঐতিহাসিক ‘শিকাগো বক্তৃতার’ মাধ্যমে হিন্দুজাতিকে বিশ্বের কাছে এক অন্যরকমভাবে পরিচয় করান। বিশ্বের আঙিনায় এ-যাবৎকাল হিন্দুধর্মের পরিচয় ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ, গোঁড়া আর অন্ধত্বে মোড়া। বিশ্ববাসীর কাছে হিন্দুধর্মের অর্থ ছিল এক অন্ধকারময় প্রাচীন ধর্ম। তাই বিদেশিরা মনে করতেন, ভারতবর্যে নানা ধর্মের মধ্যে নানা মতবাদ আছে যা হিন্দুদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যেও অশ্রদ্ধা বাড়ায়। তাঁরা এ-ও মনে করতেন, ভারতবর্ষ এক কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীন দেশ। এই দেশে নানা জাতি, নানা ছুঁতমার্গ। এমতাবস্থায় ওই শিকাগো ধর্ম মহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দ যখন তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে এক উদার ভারতবর্ষের ছবি আঁকলেন, তখন ওই শিকাগো ধর্মসভায় বিরাজ করছিল পিনপতনের মতো নৈঃশব্দ্য। স্বামীজি তাঁর দৃপ্ত ভাষণের মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন ভারতবর্ষের মানুষ দরিদ্র হতে পারে, তবে মূর্খ নয়। সেই বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি নিজের দেশকে যখন তুলে ধরলেন, উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে, তখনই শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয় সাধনের মন্ত্রটি যে কাজ করতে শুরু করেছিল তাতে আর সন্দেহ নেই। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর যোগ্য শিষ্যকে নির্বাচন করতে এতটুকু ভুল করেননি। এই প্রসঙ্গে খুব সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলা যায়। এই কথাগুলি রামকৃষ্ণদেবকে নিয়ে। তাঁর সর্বধর্ম সমন্বয়ে চিন্তাধারা যে ফল্গুধারার মতো যে বইত সেই ব্যাপারে দু-একটা ঘটনার অবতারণা করি। দক্ষিণেশ্বরের পূজারি গদাধর মায়ের রূপ-গুণেই মোহিত, ‘মা-আর ছেলে’, আবার যেন ‘প্রিয় আর প্রিয়া’। দক্ষিণেশ্বরে নানা ধরনের সাধুসন্ন্যাসীর আনাগোনা ছিল। ঠাকুর সবাইকেই দেখতেন, সবার সঙ্গেই মিশতেন। একদিন এক অদ্ভুত সাধু এলেন, পুঁথি আর ঘটি ছাড়া আর কিছুটি তাঁর নেই। পুঁথিই তাঁর দেবতা, তাঁকেই ফুল দিয়ে পুজো করেন, আবার মন দিয়েই পড়েন পুঁথি। কৌতূহলী ঠাকুর সন্ন্যাসীকে চেপে ধরলেন, দেখলেন পুরো পুঁথি জুড়ে শুধুই বড় বড় অক্ষরে দুটি মাত্র শব্দ ‘ওঁ রাম’। শুধু ওই একটি নামই সাধুর কাছে ‘প্রাণায়াম’। এই সাধু ছিলেন বৈষ্ণবদের রামায়েৎ সম্প্রদায়ের লোক। এই সন্ন্যাসীর সূত্রে এক অপূর্ব প্রেমের সন্ধান পেলেন তিনি। যে প্রেমে স্বার্থবোধ নেই, তাই বিচ্ছেদও নেই, বেদনাও নেই, এই প্রেমে পরম পূর্ণতা। এই প্রেম সকল ভাবের বড়—মহাভাব। পূজার চেয়ে বড়। জপের চেয়ে ধ্যান। ধ্যানের চেয়ে ভাব বড়। ভাবের চেয়ে মহাভাব বড়। মহাভাবই প্রেম। আর প্রেম যা ঈশ্বরও তাই। পরমপুরুষ রামকৃষ্ণদেব তাঁর চারপাশের মানুষের মধ্যে এই ঈশ্বরকে দেখেছেন। তাই তিনি মানুষকেই ঈশ্বরজ্ঞানে পূজা করতে বলেছেন। সর্বধর্ম সমন্বয় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সাধনার পথ। শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মের প্রধান কাঠামোই হল লোকশিক্ষা। এই লোকশিক্ষার আকর্ষণে রাজা থেকে ফকির— কে না উদ্বেল হয়েছেন! এই লোকশিক্ষার মন্ত্রই শ্রীরামকৃষ্ণ দিয়ে গেছেন তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী সারদাদেবীকে। এই লোকশিক্ষার প্রদীপ তিনি জ্বালিয়ে দিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যেও। তাই স্বামী বিবেকানন্দই উপলব্ধি করেছিলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের বাণীকে সংরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজন এক সংঘের। স্বামীজি চেয়েছিলেন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। প্রয়োজন সংঘ প্রতিষ্ঠার। একক শক্তিতে যা অসম্ভব, তা সম্ভব সংঘশক্তিতে। এই সংঘই পরবর্তীকালে পরিচিত হয়েছে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন নামে। আজ শ্রীরামকৃষ্ণের ১৮৭তম পুণ্য জন্মতিথিতে সবাই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন তাঁর বাণী ও কাজের প্রয়োজন কতখানি। ধর্ম নিয়ে যে রাজনীতি এখন চারদিকে শুরু হয়েছে, তার প্রতিরোধে ঠাকুরের ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ মন্ত্রের রাস্তাই এক নতুন দিশা দেখাতে পারে। প্রাণের ধর্মের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠছে প্রাতিষ্ঠানিক অচারবিচার। লোকাচারকে, দেশাচারকে ভগবানের বেদিতে বসিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসেবার আয়োজন চলছে চারদিকে। হিন্দি-হিন্দুত্বের আগ্রাসী চিৎকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সনাতন ধর্মের পূজার মন্ত্রের উপলব্ধি বাচক স্বরূপ। প্রাণের উপচারকে ছাপিয়ে জয়ধ্বজা উঠছে ইট কাঠ পাথরের মন্দিরের চূড়ায়। মনুষ্যত্বকে অগ্রাহ্য করে বিদ্বেষের বিষে আকাশ ঢাকার এই ছলনা রুখতে শ্রীরামকৃষ্ণই হোন আমাদের শুভবুদ্ধির পরম আশ্রয়। গণ্ডিভাঙা প্রাণের ঠাকুরের দেখানো পথেই ফের জেগে উঠুক ভারতবর্ষ।
আরও পড়ুন: দক্ষিণ দিনাজপুরে ২৪ শয্যার ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট, রেফার রুখতে বাড়ছে বেড