চিরঞ্জিত সাহা: বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত বছর দশেকের পুরনো সাজানোগোছানো আট কামরার বৃদ্ধাশ্রম সোহাগ। শহরের বিভিন্ন অভিজাত পরিবার থেকে আসা প্রায় আঠারো জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বর্তমান আবাসস্থল। কোনওরকম রক্তের সম্পর্ক বা আত্মীয়তার বন্ধন না থাকা সত্ত্বেও এক দৃঢ় হার্দিক মায়াবি বাঁধনে বন্দি এরা সবাই। আন্তরিকতার উষ্ণ চাদরে মোড়া অনন্য স্বপ্নিল পরিবেশ সর্বদাই বিরাজ করে সোহাগে। সৌজন্যে জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া এই মানুষগুলো।
আরও পড়ুন-বহুগামিনী
তবে আজকের এই উৎসবমুখর বড়দিনের সকালে সোহাগের আবহাওয়াও কুয়াশা জড়ানো সূর্যের মতোই আড়ষ্ট ও থমথমে। ভবনে কান পাতলে পিন পড়ার শব্দটুকুও শোনা যাচ্ছে অনায়াসে। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও ‘আগামী’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আবাসনের সকল অধিবাসীকে নিয়ে শহর ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছে ক্রিসমাসের দুপুরে, গন্তব্য ইকোপার্ক। পরিকল্পনামতোই, ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছুঁতে না ছুঁতেই ‘আগামী’র সদস্যরা বাস নিয়ে হাজির বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু প্রভু যিশু হয়তো এ বছরের জীবননাট্যে লিখতে চেয়েছিলেন কোনও নতুন মোড়।
আবাসিকদের সকলেই আজ বেড়াতে যেতে নারাজ। লাবণ্যদেবী বেশ কয়েকবার প্রত্যেককে বুঝিয়ে বললেন— ‘আরে, সামান্য তো জ্বর। কিচ্ছু হবে না আমার। তোমরা যাও, রেডি হয়ে ঘুরে এসো। ফিরে এসে দেখবে, একদম ফিট আমি; রান্নাঘরে বসে বড়দিনের কেক বানাচ্ছি। কতগুলো ওষুধ তো খেলাম। সেরে যাবে। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো কত উৎসাহ নিয়ে এসেছে— তোমাদের সাথে নিয়ে গোটা শহরটা ঘুরে দেখবে; ওদের নিরাশ কোরো না প্লিজ! এইমাত্র তো ট্যাবলেটগুলো খেলাম। ঘণ্টা দুই যাক, জ্বর নেমে যাবে ঠিক।’
‘তা হয় না লাবণ্যদি, তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে কী করে যাব আমি? নিজের দিদির থেকে আলাদা করে কোনওদিন আমি দেখিনি তোমায়! আজ আমার নিজের দিদি বিছানায় পড়ে থাকলে আমি কি পারতাম তাকে ফেলে বেড়াতে যেতে? বলো!’ ছোট্ট শিশুর মতো বলে ওঠেন বছর বাহাত্তরের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাণীব্রত বসু।
‘দেখো, লাবুদি, সত্তরটা ক্রিসমাস কাটিয়ে ফেলেছি। নতুন করে আর কী আছে দেখার! আমার যখন পক্স হয়েছিল, রাত জেগে মাথায় কে হাত বোলাত শুনি? কাল বিকেলেও আমার বাতের ব্যথায় তেলটা কে মালিশ করেছিল? তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। বর্ষশেষের রাতে এবার রবি ঠাকুরের গানে মেহফিল নামবে সোহাগে, কিন্তু আজ আমি তোমাকে এক দণ্ডও কাছ ছাড়া করতে পারব না; এই বলে দিলুম।’ বছর সত্তরের বিধবা রমাদেবীর গলা বেশ অভিমানী শোনায়।
বাণীব্রত বসু, রমা সেন প্রমুখ সকলেই ‘সোহাগ’-এর সোহাগপ্রাপ্ত বহুদিন ধরে। বছর চারেক আগে একমাত্র সন্তান ওমের হাত ধরে এই সোহাগ ভবনে আগমন একাত্তর বছরের বিধবা লাবণ্য সিনহার। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে সেদিন কেঁদেছিলেন খুব। রুটিবিক্রেতা স্বামী আর একমাত্র সন্তান ওমকে নিয়ে লাবণ্যদেবীর ছিল স্বপ্নে মোড়া সুখের সংসার। ক্লাসে বরাবর প্রথম হয়ে আসা ছেলের আইআইটিতে চান্স যেন সেই সুখের পালে বসন্তের বাতাস বয়ে আনে। আট বছর আগে, মাঘ মাসের শুভলগ্নে তন্দ্রাহরণী, স্বপ্নচারিণী অপরূপা সুন্দরী সুহানার সাথে জাঁকজমক সহযোগে বিবাহসম্পন্ন হয় আইআইটি এমটেক উইপ্রো কর্মী ওমের। কিন্তু সব গল্পের শেষে যেমন সুখ লেখা থাকে না, তেমনি সব স্বপ্নও পায় না সফলতার ঠিকানা। ছেলের বিয়ের পর মাস ছয় যেতে না যেতেই হঠাৎ এক গ্রীষ্মের দুপুরে, ম্যাসিভ সেরিব্রাল অ্যাটাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন লাবণ্যদেবীর স্বামী সনাতনবাবু। তারপর থেকেই ছেলের সংসারে দিন দিন উদ্বৃত্ত হতে শুরু করে মা। বৌমা সুহানার সাজানো বাগিচায় তিনি যেন ক্যাকটাস। প্রতিনিয়ত অপমান, অবহেলা প্রত্যক্ষভাবেই বুঝিয়ে দিত সংসারে তার অপাঙক্তেয়তা।
চোদ্দো ঘণ্টা অফিসে ব্যস্ত থাকা ছেলেকে নিজের সমস্যার কথা লাবণ্যদেবী বুঝতেই দেননি কোনওদিন; আসলে মমতাময়ী জন্মদাত্রী চাননি— তার জন্য ওদের নববিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনওরকম ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হোক। তাই ছেলেকে ডেকে নিজের মুখেই একদিন বললেন— ‘বাবু, এসব সংসারটংসার আমার আর একদম ভাল লাগে না রে সোনা। যতদিন যাচ্ছে বড় একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে সব। আমাকে বরং ক’টা দিনের জন্য বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আয়, ওখানে সমবয়সি বেশ কিছু মানুষও পাব আর কয়েকটা দিন একটু অন্যরকমও কাটবে; তারপর আবার না হয় ফিরে আসব বাড়িতে।’ প্রোমোশনের ইঁদুরদৌড় আর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর যত্নে ব্যস্ত থাকা ওমের মনে ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করেছিল জন্মদাত্রী মায়ের স্থান, তাই সেও দ্বিধাহীনভাবে কাজ করে লাবণ্যদেবীর কথামতোই। তারপর থেকে এই দীর্ঘ চার বছরের বৃদ্ধাশ্রমজীবনে লাবণ্যদেবীর এমন অসুস্থতা এই প্রথমবার।
‘কিগো! তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে নাও। বাবুকে আমি রেডি করে দিয়েছি।’ সুহানার হঠাৎ ডাকে ঘুম ভাঙে ওমের।
তিন বছরের পুত্রসন্তান আর্যকে নিয়ে ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে আজ ওরা পাড়ি দেবে অস্ট্রেলিয়া। দুপুর বারোটায় দমদম এয়ারপোর্ট থেকে সপরিবারে সওয়ার হবে সিডনিগামী বিমানে। সিডনি ভ্রমণের পাশাপাশি বাড়তি পাওনা হতে চলেছে প্রবাসী বাঙালিদের বাৎসরিক উৎসব। প্রখ্যাত এক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিখ্যাত বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী রূপম ইসলাম এবং অনুপম রায়ও সিডনি উড়ে যাচ্ছেন প্রবাসী বাঙালিদের ওই উৎসবে আমন্ত্রিত হিসেবে। ওম নিজে অনুপমের অন্ধ ভক্ত, তবে সহধর্মিণী সুহানাও এ-ব্যাপারে কম যায় না কিছু। কলেজ লাইফে প্রিন্সেপ ঘাট আর ওমের গলায় গিটার সহযোগে ‘বসন্ত এসে গেছে’ অকালবসন্ত বয়ে এনেছিল সুহানার হৃদয়ে। প্রেমপ্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেনি সুন্দরী মেয়েটা।
আরও পড়ুন-আমাদের এই বসুন্ধরা
কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে সূর্যটাও বেশ প্রখর হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। গির্জার ঘড়িতে ঢংঢং করে দশটার ঘণ্টা বেজে গেল। লাবণ্যদেবীর জ্বরটা এবেলায় বেড়েছে বেশ। বৃদ্ধাশ্রম থেকে খবর দেওয়া হয়েছে ডাক্তারকেও।
এয়ারপোর্টের জন্য পুরোপুরি রেডি হয়ে গেছে ওম। দেখতে দেখতে প্রায় তিনমাস হয়ে গেল, দেখা করতে যাওয়া হয়নি মায়ের সঙ্গে। বিজয়ার পর মাকে আর ফোনও করে উঠতে পারেননি ব্যস্ত ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। সিডনি যাওয়ার আগে একবার দেখা করার কথা ভাবলেও অফিসের কাজ গোছাতে গোছাতে আর সময় হয়ে ওঠেনি শেষমেশ।
লাগেজসমেত সদর দরজাটা খুলতেই একটা সিডি ক্যাসেট আর প্যাকেটে ভরা বই এসে ঠেকল পায়ে।
‘শালা, পেপারওয়ালাটাও হয়েছে। আরে ভাই, নতুন পত্রিকা এসেছে, দিয়েছিস। ভাল কথা। কিন্তু বেলটা তো অন্তত বাজাবি। নাহলে পরে কোনও কারণে বই হাতে না পেলে…পয়সাগুলো তো এমনি এমনি দিই প্রতি মাসে। সাত থেকে আটটা পত্রিকা নিই, তাও দু-সেকেন্ড দাঁড়িয়ে বেল টেপার ফুরসত হয় না বাবুর। ডিসগাস্টিং।’ রাগে গজগজ করতে করতে ক্যাসেটসমেত বইটা হাতব্যাগে ভরে নিল ওম। তারপর ট্যাক্সি ধরে সোজা এয়ারপোর্ট। সেখানে চেকিং সেরে প্লেনের সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে হঠাৎই মনে পড়ল বইটা খুলে দেখার কথা। প্লেন তখন সবে উড়ান নিয়েছে।
আরও পড়ুন-মে দিবসের গল্প
হাড়হিম করা শীতের মধ্যেও সোহাগ ভবনে হাজির হয়েছেন ডাক্তার উমাপদ সেন। ‘সেভারাল নিউমোনিয়া। প্রচণ্ড ঠান্ডায় হাইপোথ্যালামাস ফেইল করেছে। আমার আর কিছু করার নেই। হাতে সময়ও খুব অল্প। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনার বাড়ির লোককে খবর দিন। নাহলে হয়তো…’ লাবণ্যদেবীর নাড়ি টিপে গম্ভীর মুখে জানালেন উমাপদবাবু। আবাসিকদের মাথায় যেন অমাবস্যার আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা, সকলেই রীতিমতো হতবাক! কাল অবধি যে মানুষটাকে কেউ একবার কাশতেও দেখেনি, সে-ই কিনা হঠাৎ এমন নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে বসল এক রাতে! ডাক্তারবাবুর কোথাও ভুল হচ্ছে না তো!
সিট বেল্টটা বেঁধে নিয়ে বই খুলতেই মেরুদণ্ডে হিমেল স্রোত বয়ে গেল ওমের। বইয়ের নাম ‘আসলে সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই।’ লেখক অনুপম রায়। আর বইয়ের সাথেই রয়েছে অনুপম রায়ের প্রথম মিউজিক অ্যালবাম ‘দূরবিনে চোখ রাখব না’। সাথে কাঁপা হাতে লেখা ছোট্ট একটা চিরকুট ‘উপহারে সান্তাদাদু’। স্মৃতির ধূসর পাতাগুলো চোখের সামনে প্রকট হয়ে উঠছে ক্রমশ। চশমার কাচে জমাট বাঁধছে উষ্ণ হীরককুচি। ওম তখন ক্লাস এইট, সেকশন এ। সবে মুক্তি পেয়েছে অনুপম রায়ের প্রথম অ্যালবাম ‘দূরবিনে চোখ রাখব না’। সঙ্গীতপ্রেমী ছেলেটা রায়বাবুর সুরে তখন রীতিমতো মাতোয়ারা। অ্যালবামটা কিনে দেওয়ার জন্য বাড়িতে কান্নাকাটি করেছিল খুব। কিন্তু ছেলের আবদারে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেননি স্বল্প-উপার্জনকারী রুটিবিক্রেতা বাবা। গৃহবধূ লাবণ্যদেবীর হাতেও ওমের শখ মেটানোর প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না সেসময়। চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েই শেষমেশ নিজের চাহিদার সমাধি দিতে বাধ্য হয় বছর তেরোর ওম।
আরও পড়ুন-আমাদের এই বসুন্ধরা
হঠাৎই লাবণ্যদেবীর ঘরের বাইরে বংশীর টলমল গলার স্বর— ‘ও দিদা! আছ নাকি ঘরে?’ বংশী এই তল্লাটের প্রখ্যাত পাঁড় মাতাল। অলিগলিতে রিকশা চালায় আর তার ফাঁকে মাঝেসাঝে গল্প করতে হাজির হয় এই সোহাগ ভবনে। কোনওরকম সাড়াশব্দ না পেয়ে রগচটা বংশী আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে সোজা ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। শয্যাশায়ী লাবণ্যদেবীকে দেখামাত্রই চেঁচিয়ে উঠল বাংলা খেয়ে চুর হয়ে থাকা অবস্থায়— ‘কতবার বললাম, এই বুড়ো বয়সে এসব পাকামি মেরো না। বুড়ির শালা বেশি জিংলামি। ছেলে ওনাকে জাহান্নামে ফেলে গেছে আর উনি মাঝরাতে কাঁপতে কাঁপতে চললেন ছেলের দুয়ারে গিফট রাখতে। অমন ছেলের মুখে মুতি শালা।’ বংশীকে চেপে ধরতেই জানা গেল— গতকাল রাতে আশ্রমের সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর বংশীকে সাথে নিয়ে নিজের ছেলের বাড়ির দরজায় ক্রিসমাসের গিফট রাখতে গিয়েছিলেন লাবণ্যদেবী। তাঁর দেওয়া সময়মতোই ঠিক রাত বারোটায় রিকশা নিয়ে মাতাল বংশী হাজির হয় আশ্রমের গেটে। ডিসেম্বরের মাঝরাতের কনকনে ঠান্ডা হাওয়া সহ্য করার ক্ষমতা পঁচাত্তর বছরের লাবণ্যদেবীর ছিল না। ফল আজকের এই শারীরিক বিপর্যয়।
ইতিমধ্যেই চোখ বুজেছেন লাবণ্যদেবী। কথা বন্ধ হয়ে গেছিল ঘণ্টা দুই আগেই। ডেথ সর্টিফিকেটটা লিখে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার উমাপদবাবু। এই নিয়ে অষ্টমবারের জন্য সোহাগ ভবনের কোনও আবাসিকের মৃত্যুনামা রচিত হল সত্তরোর্ধ্ব এই ফিজিসিয়ানের কলমে। আশ্রমের অধিকর্তা তপনবাবু ফোনে বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন লাবণ্যদেবীর একমাত্র পুত্র ওমকে। কিন্তু ফোন ফ্লাইট মোডে রেখে সে এখন উড়ন্ত সিডনির পথে।
অঙ্কন : শংকর বসাক