নদী-জঙ্গলে ঘেরা সুন্দরবন। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। ছড়িয়ে রয়েছে ভয়, জড়িয়ে রয়েছে রোমাঞ্চ। তবু মানুষের অদ্ভুত ভালবাসা লেগে রয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য-অঞ্চলটির প্রতি। সারা বছর বহু পর্যটক সুন্দরবন বেড়াতে যান। রাজ্য সরকার সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের উপর জোর দিচ্ছে। আছে প্যাকেজ ট্যুর। পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে আরও কয়েকটি উদ্যোগ। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী
ভয় এবং ভালবাসা। দুটোই জড়িয়ে রয়েছে সুন্দরবন নামটির সঙ্গে। চলতি ভাষায় অনেকেই বলেন সোঁদরবন। মূলত ম্যানগ্রোভ অরণ্য। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আপনভূমি। জলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় কুমির, চিতল হরিণ, অজগর, চিতাবাঘ, বিড়াল, বিষধর সাপ। গাছে গাছে উড়ে বেড়ায় নানা প্রজাতির পাখি। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, এই নিয়েই যাপন স্থানীয়দের। পেটের প্রয়োজনে পুরুষদের যেতে হয় গভীর জঙ্গলে। অসীম সাহসী তারা। মুখোমুখি হতে হয় বাঘের। কখনোসখনো ঘটে যায় মহাবিপদ। প্রাণহানিও। কম সাহস নয় মহিলাদেরও। বিভিন্ন কাজে তারা হাত লাগায় পুরুষদের সঙ্গে। জঙ্গলের আলোকালো পরিবেশে ছড়িয়ে রয়েছে গভীর রহস্য। তবু সুন্দরবনের অসংখ্য নদীনালা, বনভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আকৃষ্ট করে দূরের সাধারণ মানুষকে। প্রায় সকলেই অঞ্চলটি একবার ঘুরে দেখতে চায়। সুন্দরবনের বিস্তৃতি ২০,৪০০ বর্গ কিলোমিটার। এই জাতীয় উদ্যান পরিচিত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম হিসাবে। ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে।
বেড়ানোর আদর্শ সময় নভেম্বর থেকে মার্চ। এটাই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার-সহ বন্যপ্রাণী দেখার উপযুক্ত সময়। এই সময়ের মনোরম আবহাওয়া সুন্দরবন ভ্রমণকে আরও উপভোগ্য করে তোলে।
আরও পড়ুন-পার্কসার্কাস ময়দানে শুরু হল মহামিলনের উৎসব
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে রাজ্য সরকার সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের উপর জোর দিচ্ছে। পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত হয়ে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পর্যটকদের কাছে স্থানীয় লোকশিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করছে। এইভাবে শিল্পীদের আয়ের পথও খুলে গিয়েছে।
সুন্দরবন ভ্রমণ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তরের সচিব সৌমিত্র মোহন জানালেন, সুন্দরবনে আমাদের প্যাকেজ ট্যুর আছে। শুধুমাত্র শীতের মরশুমে নয়, সরকারি ব্যবস্থাপনায় সারাবছর এই প্যাকেজ ট্যুর চলে। আছে আমাদের নিজস্ব বোট, ক্রুজ। গেস্ট হাউস আছে সজনেখালি, বকখালি এবং গঙ্গাসাগরে। আমরা চাই আরও বেশি পর্যটক সুন্দরবনে আসুক, ঘুরে দেখুক। বেড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহীরা আমাদের ওয়েবসাইট দেখতে পারেন।
আরও পড়ুন-কমলাপুর ও কদমতলা-কুর্তিতে পরপর দুটি বিশাল সভা
জানা গেছে, সুন্দরবনের সাফারি সকাল ৮-৩০-এ শুরু হয় এবং বিকাল ৪টেয় শেষ হয়। এখানে জিপ সাফারির কোনও ব্যবস্থা নেই। আছে শুধু বোট সাফারি।
পুরো সুন্দরবনটাই দেখার মতো। তার মধ্যে কয়েকটি জায়গা বিশেষভাবে ঘুরে দেখা যায়। সেগুলো হল :
সজনেখালি
সুন্দরবনের চিরসবুজ এক দ্বীপ সজনেখালি। এখানেই আছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার। নদীর ধারে আছে বনবিবির থান। সরকারি পর্যটক আবাসের একপাশে আছে ওয়াচ টাওয়ার। বহু মানুষ উপরে ওঠেন বাঘ দেখার আশায়। কপাল ভাল থাকলে দর্শন পাওয়া যায়। দেখা যায় হরিণও। সজনেখালিতে আছে গেস্ট হাউস। কলকাতা থেকে গাড়িতে সায়েন্স সিটি ও ঘটকপুকুর হয়ে সোনাখালির নতুন সেতু পেরোতে হয়। ওপারেই গদখালির ঘাট। সেখান থেকে লঞ্চে সজনেখালি যেতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। থাকা যায় সজনেখালি ট্যুরিস্ট লজে। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করা যায় বিবাদী বাগের ট্যুরিজম সেন্টারে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
ঝড়খালি
সুন্দরবনের পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের জায়গা ঝড়খালি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এককথায় অসাধারণ। নদী ও ম্যানগ্রোভ অরণ্য দিয়ে ঘেরা। শান্ত নির্জন পরিবেশ। চাইলে কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতে পৌঁছানো যায়। আবার বোটে সামান্য গেলেই সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল। এখান থেকে দিনেরবেলা বেড়িয়ে আসা যাবে নেতিধোপানি, সজনেখালি, সুধন্যখালি, কলস ইত্যাদি দ্বীপের ওয়াচ টাওয়ার। ঝড়খালির মিষ্টি জলের দিঘিতে শীতকালে পরিযায়ী পাখির মেলা বসে। সামান্য দূরে নদীতীর। এখানকার আরেক অবশ্য দ্রষ্টব্য ম্যানগ্রোভ ইকোলজিক্যাল গার্ডেন। ঝড়খালির বাদাবনের ভয়ঙ্কর প্রকৃতির কোলে কয়েকটা দিন খুব মজায় কাটানো যেতে পারে। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার লোকাল ট্রেনে ক্যানিং নেমে সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে ঝড়খালি যাওয়া যায়। ক্যানিং থেকে দূরত্ব মোটামুটি ৪৪ কিলোমিটার। বাসন্তী থেকে আরও কাছে। গাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে কলকাতা-ধামাখালি রুটে সরবেড়িয়া হয়ে ঝড়খালি পৌঁছানো যায়। থাকার জন্য মৎস্য দপ্তরের গেস্টহাউস আছে। বুকিং করা যায় সল্টলেকের ময়ূখ ভবন থেকে।
আরও পড়ুন-নির্মলার কুৎসা, রাজ্যের জবাব
নেতিধোপানি
নেতিধোপানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু কিংবদন্তি, বেহুলা-লখিন্দরের প্রচলিত কাহিনি। পদ্মপুরাণে, মনসা মঙ্গলকাব্যে বেহুলা-লখিন্দরের প্রেম কাহিনীতে নেতিধোপানির ঘাটের উল্লেখ রয়েছে। ভাটার সময় বিখ্যাত ঘাটটি দেখা যায়। হিন্দুদের কাছে এই স্থান অতি পবিত্র। এখানে আছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো শিবমন্দির। অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। আছে ওয়াচ টাওয়ার। কপাল ভাল থাকলে এখান থেকে দেখা যায় বাঘ। আসে পরিযায়ী পাখিও। সমুদ্র এখান থেকে খুব কাছে। সারাবছর লেগে থাকে পর্যটকদের আনাগোনা।
দয়াপুর
গোমর নদীর ধারে দয়াপুর দ্বীপ। এখানেই গড়ে উঠেছে সুন্দরবন বেড়ানোর একটি বেসক্যাম্প। দয়াপুর সজনেখালির কোনাকুনি, নদীর ঠিক ওপারে। তাই যাতায়াতের ব্যবস্থা মোটামুটি সজনেখালির মতোই। এখানে আছে বেশকিছু রিসর্ট। তাদের নিজস্ব জলযান আছে। গদখালি থেকে পর্যটকদের নিয়ে এবং দিয়ে আসা হয়। সেইসঙ্গে ঘোরানো হয় সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে। দয়াপুর থেকে জটিরামপুর বার্ড স্যাংচুয়ারি ঘুরে আসা যায়।
আরও পড়ুন-প্রবল কটাক্ষ সমালোচনায় প্রত্যাহার গরু আলিঙ্গন দিবস
বালি
সুন্দরবনের বালি দ্বীপে গ্রামভিত্তিক ইকো ট্যুরিজমের বিকাশ ঘটেছে। নদীর পাশে ছবির মতো সুন্দর এক গ্রাম। বালিকে ঘিরে প্রবাহিত কয়েকটি নদী। যেমন, মাতলা, পিরিখালি, খনাখালি, বিদ্যা, গুমটি। লঞ্চ থেকে নেমে বাঁধের রাস্তা ধরে কিছুটা হাঁটলেই কটেজের দেখা মেলে। দিনের আলো থাকতে থাকতে এখান থেকে জলপথে সজনেখালি এবং আরও দূরের দ্বীপের ওয়াচটাওয়ারগুলি ঘুরে আসা যায়। সায়েন্স সিটি থেকে গাড়িতে সোনাখালি হয়ে যাওয়া যায় গদখালি। সেখান থেকে লঞ্চ বা ভুটভুটিতে বালি দ্বীপ যেতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে।
আরও পড়ুন-পরীক্ষার্থীদের ভরসা দিতে যুগান্তকারী একাধিক পরিবর্তন এনেছে পর্ষদ : শিক্ষামন্ত্রী
হেনরি দ্বীপ
হেনরি দ্বীপ সুন্দরবনের একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। এখানে মাছ চাষের নানা প্রকল্প আছে। শীতের সময় এখানে উড়ে আসে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। দ্বীপটি বকখালির খুব কাছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ও সুন্দরবন জাতীয় উদ্যানের দক্ষিণে অবস্থিত। যদি সমুদ্র সৈকত আপনাকে মুগ্ধ করে তবে আপনার হেনরি দ্বীপে যাওয়া উচিত। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সৌন্দর্য এবং প্রাণীজগতের বৈচিত্র্য উপভোগ করার আদর্শ জায়গা। কলকাতা থেকে বকখালিগামী বাসে বকখালি পৌঁছে হেনরি দ্বীপ যাওয়া যায়। থাকা যায় বকখালির হোটেল অথবা গেস্ট হাউসে।