আসছে স্বাধীনতা দিবস। তেরঙ্গা ওড়ানোর দিন। যদিও এবার তেরঙ্গা ওড়ানোকে আলাদা কর্মসূচি হিসেবে নিয়েছে মোদি সরকার। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘হর ঘর তেরঙ্গা’। স্বাধীনতার মাস আসতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ফেসবুক ডিপি বদলে সেখানে দিয়েছেন তেরঙ্গার ছবি। তিনি দেশবাসীর কাছে আবদেন করেছেন তাঁরাও যেন তাঁদের ডিপিতে তেরঙ্গার ছবি দেন। একথা ভিন্ন যে মোদিজির রাজনৈতিক দলের গুরু আরএসএস কস্মিনকালেও এই তেরঙ্গাকে মেনে নেয়নি। আজও তাঁরা অনেকেই বলেন একদিন দেশের জাতীয় পতাকা হবে গেরুয়া। কেবল আগমার্কা সংঘের লোকেরাই নন, বিজেপির লোকেদের মুখ থেকেও জাতীয় পতাকা বদলানোর কথা শোনা গিয়েছে বহুবার। যেমন তারা হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলে, তেমনই তারা তেরঙ্গা বদলানোর কথা বলে। আরএসএস-এর স্বপ্ন সাকার করতেই তো বিজেপির আগমন। অটল ও মোদি জমানা মিলিয়ে এ যাবৎ তাদের বহু স্বপ্ন সফল হয়েছে। একথা অস্বীকারের উপায় নেই। তবে মোদি জমানায় যেভাবে ‘হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদ ও বিদ্বেষের সুষম ব্লেন্ডিং’ বানানো হয়েছে তা ‘ইউনিক’ সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন-নিউইয়র্কে হামলা, ছুরিকাহত রুশদি
যে তেরঙ্গা নিয়ে এত কথা তার নকশা প্রথম বানিয়েছিলেন পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া। ১৯১৬ সালে অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনম শহরের নিকটস্থ ভাটলাপেনামারু গ্রামের বাসিন্দা পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া একটি সাধারণ জাতীয় পতাকার রূপদানের চেষ্টা করেন। মহাত্মা গান্ধীর ইচ্ছানুসারে একটি নতুন পতাকার নকশা করা হয়। কিন্তু জাতীয় পতাকাটি যাঁর হাতে পূর্ণতা পায় তাঁর নাম সুরাইয়া তৈয়াবজি। পিঙ্গালি তেরঙ্গার মাঝখানে চরকা দিয়েছিলেন। যা গান্ধীর পছন্দ হলেও তাতে সার্বিক প্রতিনিধিত্ব ছিল না। নেহরুরও তা পছন্দ ছিল না। তিনি সিভিল সার্ভেন্ট বদরুদ্দিন তৈয়াবজিকে বলেছিলেন চরকা সরিয়ে মাঝখানে কী দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবতে। বদরুদ্দিন সে কথা বলেন তাঁর স্ত্রী সুরাইয়াকে। গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে দেন তিনি। তাঁর মাথায় আসে সারনাথের অশোকস্তম্ভের চক্রের কথা। তিনি তখন চরকার জায়গায় এই চক্রকে ব্যবহার করে আসলে সহিষ্ণুতা ও সর্বধর্ম সমন্বয়কে পতাকায় স্থান দেন। এই পতাকা ভীষণ পছন্দ হয় নেহরুর। তবে প্রাথমিকভাবে এই চক্রের রং ছিল কালো। পরে তা নীল রঙের করা হয়।
আরও পড়ুন-বিশ্বজুড়ে এবার বন্ধ জনসন এন্ড জনসন বেবি পাউডার
ইংলিশ ইতিহাসবিদ ট্রেভোর রয়েলের বইতে বলা হয়েছে ভারতের জাতীয় পতাকার নকশা বানিয়েছিলেন সিভিল সার্ভিস অফিসার বদরুদ্দিন তৈয়াবজির স্ত্রী সুরাইয়া তৈয়াবজি। ট্রেভোরের দাবি, সুরাইয়ার করা নকশা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ভাল লাগায় তিনি নিজের গাড়ির বনেটে তা লাগিয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেটাই ভারতের জাতীয় পতাকার মর্যাদা পায়। ফেরদৌস বেকনের ‘ভারতের ইতিহাস বিকৃতি ও সুরাইয়ার অস্বীকৃতি’ নামক লেখায়ও আছে এই ইতিহাসের বিস্তারিত। ১৪ অগাস্ট যে জাতীয় পতাকা উপস্থাপন কমিটি জাতীয় পতাকার ডিজাইন পেশ করেছিল, তাতে সুরাইয়া তৈয়াবজির নাম ছিল। কিন্তু ডিজাইনার হিসেবে অজ্ঞাত কারণে কখনওই সুরাইয়ার নামটি ওঠেনি ভারতের ইতিহাসের পাতায়।
আরও পড়ুন-ফের নিম্নচাপের জেরে ভাসতে চলেছে দক্ষিণবঙ্গ
১৯১৯-এ হায়দরাবাদের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সুরাইয়ার জন্ম। সে আমলে মুসলিম মেয়েদের যেভাবে চিত্রায়িত করা হত, সুরাইয়াকে তাঁর মধ্যে ফেলা যায় না। তিনি ছবি আঁকতেন, অসাধারণ সেলাইয়ের কাজ করতেন, সাঁতার কাটতে জানতেন, খুব সুন্দর রান্না করতেন, সবটাকেই তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পের পর্যায়ে। এককথায় তিনি ছিলেন বহুমুখী শিল্পী। এমন একজন মহিলার নাম কেন ইতিহাসে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সম্প্রতি নয়া রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু যে ভাষণ দেন, তাতে একজনও মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম ছিল না। এদেশের রাষ্ট্রপতি যে স্ক্রিপ্টেড ভাষণ পড়ে শোনান, তা সকলে জানেন। ২ অগাস্ট পিঙ্গালির জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী মোদি শ্রদ্ধা জানানোর সময় তাঁর তৈরি জাতীয় পতাকার নকশার কথা বলেন, কিন্তু একটিবারের জন্যেও তিনি সুরাইয়ার নাম উচ্চারণ করেননি। অনেকে কথা শুনে বলতেই পারেন, যারা লোকসভা এবং রাজ্যসভায় একজন মুসলিমকে টিকিট দেয়নি, তারা যে সুরাইয়ার নাম মুখে আনবে না এতে অবাক হওয়ার কী আছে। কেউ উচ্চারণ করুক আর না করুক জাতীয় পতাকার সঙ্গে জুড়ে থাকবে সুরাইয়ার নাম। তা মুছে দেওয়া যাবে না। ইতিহাসকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু তাকে মুছে দেওয়া যায় না।
আরও পড়ুন-এবার গুজরাতে বিধায়কের জামাইয়ের গাড়ির ধাক্কায় নিহত ৬
১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই গণপরিষদের একটি অধিবেশনে এই পতাকার বর্তমান রূপটি ভারত অধিরাজ্যের সরকারি পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকার মর্যাদা লাভ করে। আমাদের স্বাধীনতা দিবস ১৫ অগাস্ট হলেও জাতীয় পতাকার জন্মদিন ২২ জুলাই। স্বাধীনতার আগে বেশ কয়েকবার ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন হওয়ার কথা ইতিহাসে আমরা পাই। প্রথম উত্তোলন করা হয় ১৯০৬ সালের ৭ অগাস্ট কলকাতার পার্সি বাগানে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সভায়। তারপর ১৯০৭ সালে জার্মানির স্ট্রুটগার্ট শহরে ভিখাজি কামা উত্তোলন করেন। লাহোর অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি মধ্যরাতে পণ্ডিত নেহরু রবি নদীর ধারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৪৫-৪৭ সময়পর্বে জাতিসংঘে এই পতাকাটিই ভারতের পতাকা হিসেবে ব্যবহৃত হত।
১৯২৪ সালে কলকাতায় সর্বভারতীয় সংস্কৃত কংগ্রেস হিন্দুধর্মের প্রতীক রূপে গেরুয়া রং ও বিষ্ণুর গদার চিত্র পতাকায় সংযোজনের প্রস্তাব দেয়। এই বছরই ‘হিন্দু যোগী ও সন্ন্যাসী এবং মুসলমান ফকির ও দরবেশদের মধ্যে প্রচলিত ত্যাগের প্রতীক’ গেরু বা গিরিমাটি রং পতাকায় যোগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। শিখরা দাবি তোলে, হয় তাদের প্রতিনিধিরূপে হলুদ রং পতাকায় রাখতে হবে, নয়তো পতাকা থেকে ধর্মীয় প্রতীকতত্ত্ব বাদ দিতে হবে।
আরও পড়ুন-আরও একটি নয়া ভবন পেল সূর্য সেন মহাবিদ্যালয়
১৯৪৭ সালের ২৩ জুন জাতীয় পতাকার বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য গণপরিষদ স্থাপিত হয়। গণপরিষদ রাজেন্দ্র প্রসাদের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সরোজিনী নাইডু, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, কে এম মুন্সি ও বি আর আম্বেদকর। তিন সপ্তাহ পর তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাটি উপযুক্ত সংস্কারের পর সব দল ও সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণীয় করে তুলে জাতীয় পতাকা হিসেবে গৃহীত হবে। পরে এমন প্রস্তাবও গৃহীত হয় যে ভারতের জাতীয় পতাকার কোনও সাম্প্রদায়িক গুরুত্ব থাকবে না। সে সময়েই চরকার পরিবর্তে সারনাথ স্তম্ভ থেকে অশোকচক্রটি গৃহীত হয় পতাকায়। তারপর ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীন ভারতে প্রথমবার অশোকস্তম্ভ সহ এই পতাকাটি উত্তোলিত হয়।
আরও পড়ুন-বুমরার চোট নিয়ে চিন্তায় বোর্ড, বিশ্বকাপে বিকল্প ভাবনায় শামি
ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ লিখেছেন, চরকা পছন্দ করা হয়েছিল কারণ এটি ধর্ম ও আইনের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে চরকার বদলে অশোকচক্রকে গ্রহণ করার ব্যাপারটি নেহরু স্বাগত জানান। তিনি পতাকায় চরকার বদলে ধর্মচক্র সংযোজনের বিষয়টিকে বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ বলে মনে করেন। তবে গান্ধী বিষয়টি প্রথমে পছন্দ না করলেও পরে মেনে নেন।
আরও পড়ুন-সোনা জিতেই সিন্ধু ফের চ্যালেঞ্জের মুখে
এ তো জাতীয় পতাকার সত্যি ইতিহাস। কিন্তু সে ইতিহাস যে এমনই থাকবে তা বুক ঠুকে বলা যায় না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা আজকের দিনে বিজেপির লৌহপুরষ অমিত শাহ স্বয়ং নতুন করে ইতিহাস লেখার হুঙ্কার দিয়েছেন। ইতিহাস যেন মেগাসিরিয়াল। কেউ চাইল আর লিখে ফেলল। মুঘল ও সুলতানদের ইতিহাস তাঁদের পছন্দ নয়। এদেশে ইতিহাস পড়ে শিক্ষিত লোক, তা গেরুয়া শিবির জোর দিচ্ছে ইতিহাসের ফোড়ন দিয়ে খিচুড়ি টাইপ সিনেমা বানাতে। তাতে একদিকে ভরপুর এন্টারটেনমেন্ট থাকবে, অন্যদিকে হালকা করে পুশ করে দেওয়া যাবে বিদ্বেষ ভ্যাকসিন। তাহলে আর যাই হোক এই লোকগুলোর ভিতরে সহিষ্ণুতার, সম্প্রীতির কিংবা ঐক্যের ভাব জেগে উঠবে না। তারা কেবল ‘জয় শ্রীরাম’ কিংবা ‘হর হর মোদি, ঘর ঘর মোদি’ বলে রণহুঙ্কার দিয়ে বিশ্বগুরু হওয়ার আস্ফলন করবে। তাতেই সফল হবে নিউ ইন্ডিয়া। কর্মসংস্থানের স্বপ্ন ছেড়ে দেশবাসী ৫ জি লাভেই জীবন সার্থক মনে করবে। জয় হিন্দ। জয় বাংলা…।