বাম আমলে বছরের পর বছর চাষিরা ধান আর আলুতে লোকসান খেতেন। আলুতে তিন বছর লোকসান খেলে লাভ পেতেন এক বছর। এটাই হয়ে গিয়েছিল প্রথা। প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে চাষিরা আলুর দাম পেতেন না। তাতে অনেকেরই চাষের প্রতি তৈরি হয়েছিল অনীহা। তাই বহু চাষির কাছেই জমি হয়ে উঠেছিল বিরাট ‘দায়’। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে সেই জমিই চাষির কাছে হয়ে উঠেছে ‘সম্পদ’। কারণ এখন এ-রাজ্যে কারও এক একর চাষের জমি থাকলেই ‘কৃষকবন্ধু’র সৌজন্যে মা-মাটি-মানুষের সরকারের অনুদান বাবদ তিনি প্রতি বছর পেয়ে যাচ্ছেন ১০ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন-ভোরবেলা টালিগঞ্জের এনটি ওয়ান স্টুডিও’র একাংশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
অথচ পঞ্চায়েত ভোটের আগে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের গায়ে ‘কৃষকশত্রু’ তকমা লাগিয়ে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করছে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি। জগাই-মাধাই-গদাই।
তারা বলছে, এ-রাজ্যের চাষিরা আলুর দাম পাচ্ছেন না। অবস্থা এতটাই নাকি খারাপ যে আলুচাষি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ওরা যেটা বলছে না, সেটা হল, উত্তরপ্রদেশের তুলনায় দ্বিগুণ, আর গুজরাতের চেয়ে দেড়গুণ বেশি দামে আলু বিক্রি করছেন পশ্চিমবঙ্গের চাষিরা। তাই কথায় কথায় গুজরাত আর উত্তরপ্রদেশের প্রসঙ্গ টানা নেতারা ভুলেও ডাবল ইঞ্জিন সরকারের প্রসঙ্গ মুখে আনছেন না। কারণ মোদিজি আর যোগীজির রাজ্যের কথা বললেই ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়বে বেড়াল।
আরও পড়ুন-ছাত্র-যুবর প্রস্তুতি বৈঠক
উত্তরপ্রদেশের পর দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলু হয় পশ্চিমবঙ্গে। এ-রাজ্যের প্রায় এক কোটি মানুষ আলু চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। চাষিরা আলুর লাভজনক দাম পেলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে জোয়ার আসে।
এ-রাজ্যে প্রায় এক বছর ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। তার ফলে গ্রামবাংলার অর্থনীতি প্রায় বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় চাষিরা আলুর দাম না পেলে সমস্যা দেখা দিত। কারণ সাধারণ মানুষের আর্থিক সুস্থিতি বিঘ্নিত হলে সরকার-বিরোধী আন্দোলন জমাট বাঁধত অত্যন্ত দ্রুত। তখন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে খ্যাপানো অনেক সহজ হয়ে যেত। সেজন্যই জগাই-মাধাই-গদাইরা আলু চাষিদের সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিতে চাইছে। এই কারণেই ব্যক্তিগত কারণে আত্মহত্যার ঘটনাকেও আলুতে লোকসানের জের বলে চালাতে চাইছে। এসব করতে গিয়েই পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ের ভাতমৌদি গ্রামে মুখ পুড়েছে বিজেপির।
আরও পড়ুন-আজ ভার্চুয়াল বৈঠকে নেত্রী
জমি থেকে এমন নিশ্চিত রিটার্নে চাষিদের দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমেছে। এখন সার, বীজ কেনার জন্য আর মহাজনের কাছে চাষিদের হাত পাততে হয় না। চাষের আগেই মহাজনের কাছে বন্ধক পড়ে না তাঁদের ঘাম-ঝরানো ফসল। এর ফলে চাষিদের মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। তাঁরা আর কেউ খুব বিপাকে না পড়লে জমি বিক্রি করতে চাইছেন না। জগাই-মাধাই-গদাইরা এই সহজ সত্যিটা জানেন, কিন্তু মানতে চান না।
যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা কুইন্টাল দরে। পাশের রাজ্য বিহারে আলুর কুইন্টাল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কুইন্টাল। নরেন্দ্র মোদির নিজের রাজ্য গুজরাতে আলুর কুইন্টাল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। আর এখানে? উত্তরবঙ্গে দাম কিছুটা কম থাকলেও দক্ষিণবঙ্গে অধিকাংশ চাষিই জ্যোতি আলু বিক্রি করেছেন ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কুইন্টাল। এখন দাম আরও বেশি। এই ছবিটা কী বলছে? এটা কি বলছে, এ-রাজ্যের চাষিরা কমদামে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন? জগাই-মাধাই-গদাইবাবুরা বুকে হাত রেখে বলুন তো, এই কথাটা কতটা সত্যি? কিংবা, আদৌ সত্যি কিনা?
আরও পড়ুন-এবার স্বাবলম্বী হতে নয়া উদ্যোগ, ১ এপ্রিল থেকে আবেদন শুরু,রাজ্যে ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড
পরিশেষে, প্রকৃত সত্যতে আসা যাক—
গোটা দেশে আলুতে সবচেয়ে বেশি দাম পাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরাই। তা সত্ত্বেও তাঁরা যে খুব লাভবান হচ্ছেন, এমনটা বলা যাবে না। কারণ সারের দামের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে অগ্নিমূল্য হয়েছে সার। ডিজেলের দামও আকাশছোঁয়া। আগে ডিজেলের দাম বেশি থাকায় কৃষকরা কেরোসিন দিয়ে সেচের পাম্প চালাতেন। নরেন্দ্র মোদি সরকারের সৌজন্যে খোলাবাজারে সেই কেরোসিনের দাম এখন ডিজেলের চেয়েও বেশি। ফলে সস্তায় সেচের রাস্তাটাও এখন বন্ধ। এবার আবার পুজোর পর থেকে আলু ওঠা পর্যন্ত বৃষ্টিই হয়নি। তাই সেচেও পড়েছে টান। ফলে মার খেয়েছে আলুর উৎপাদন। ফলে, আলুর দাম বেড়ে গিয়েছে। হিমঘর খোলার এক সপ্তাহ পর যাঁরা আলু তুলেছেন তাঁরা লোকসানের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছেন। এ-রাজ্যের কৃষকরা রক্ষা পেলেও বিহার, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতের অবস্থা ভয়ঙ্কর। সেখানে কৃষকদের লাভ তো দূরের কথা, সারের খরচটুকুও উঠছে না। জগাই-মাধাই-গদাইরা সেকথাটা বলুন। সেটা না করে শুধু স্লোগান তুলছেন, আলুর দাম বাড়ল কেন, রাজ্য সরকার জবাব দাও।
আরও পড়ুন-সমর্থকদের ট্রফি উৎসর্গ দিমিত্রিদের, গোয়েঙ্কার উপহার, সরে গেল এটিকে
এ-সব নোংরামি কিন্তু শেষ বিচারে বাজার মাত করতে পারবে না। গ্রাম বাংলার মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতায় বুঝে নেবেন, সত্যিটা আসলে কী। আর তারই পরিণতিতে অনিবার্যভাবে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনেও এগিয়ে চলবে মা-মাটি-মানুষের বিজয়রথ।