শিবপুর-এ অনন্য স্বস্তিকা

রেল ইয়ার্ডের দখলদারি, চোরাকারবার, মাফিয়ারাজ, খুন— এসব নিয়ে এক সময় নিয়মিত খবরে থাকত 'শিবপুর'। পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্য সেই সত্য ঘটনাগুলি কেন্দ্র করেই গড়েছেন কাহিনি, চরিত্রগুলিকে করেছেন কাল্পনিক, উপস্থাপনাও নিজস্ব মুনশিয়ানায়। চমকে দেওয়া অভিনয় করেছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। জোরালো ও ব্যতিক্রমী চরিত্রে আছেন মমতাশংকর। বিশদে জানাচ্ছেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

মাফিয়া রাজ
ছিলেন সাধারণ গৃহবধূ, হলেন মাফিয়া কুইন। অকল্পনীয় বদল ঘটেছে মন্দিরা বিশ্বাসের। যে-হাত একসময় ডুবে থাকত ঘরকন্নার কাজে, সেই হাত হয়েছে রক্তাক্ত, তুলে নিয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। দুচোখে আগুন। মেতে উঠেছেন হত্যালীলায়। কেন এই পরিবর্তন? একটা সময় স্বামী, কন্যা নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁর। হঠাৎ ঘটে যায় একটি ঘটনা। ঘুষ না নেওয়ার কারণে চোখের সামনে খুন হতে হয় তাঁর স্বামীকে। মুহূর্তে অন্ধকার নেমে আসে মন্দিরার জীবনে। প্রতিকার চেয়ে তিনি পুলিশের কাছে ছুটে যান। কিন্ত বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও অভিযোগ নেয় না পুলিশ। কারণ পুলিশ থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ— সবাই মাফিয়াদের হাতের পুতুল। তাই ‘রিস্ক’ নিতে চান না কেউ।

কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা
বাধ্য হয়ে আসরে নামেন মন্দিরা। স্বামীর হত্যার বদলা নিতে তিনি হাত মেলান ওই অঞ্চলের অন্যতম মাফিয়া তথা মাছের সাপ্লায়ার তপন বারিকের সঙ্গে। তপনের বিপক্ষ দলের মাফিয়া নেপাল ভট্টাচার্য তাঁর স্বামীর হত্যাকারী। তাই মন্দিরা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চান। ধীরে ধীরে মাফিয়া কুইন হিসেবে উত্থান হয় তাঁর। বুদ্ধি খাটিয়ে একটু একটু করে শহরের মাফিয়ারাজ খতম করতে থাকেন। এই ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘শিবপুর’ (Shibpur)। মুক্তি পেয়েছে কিছুদিন আগে। ছবির পটভূমি আটের দশকের হাওড়ার শিবপুর। সেই সময় ট্রাম ডিপো, শালিমার রেল স্টেশন অঞ্চল দাপিয়ে বেড়াত অন্ধকার জগতের লোকজন। কত নিরীহ মানুষকে হতে হয়েছে তাদের শিকার।

যত্নবান পরিচালক
ডার্ক পলিটিক্যাল থ্রিলারধর্মী ছবি ‘শিবপুর’ (Shibpur)। পরিচালনা করেছেন অরিন্দম ভট্টাচার্য। তাঁর কাজের প্রশংসা করতেই হয়। যদিও স্টোরি লাইন ভীষণ সোজাসাপটা। তবে প্রতিটা দৃশ্য অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে বানানো হয়েছে। নেওয়া হয়েছে বিশেষ যত্ন। হিংসা, খুনোখুনি এতটাই ভয়াবহ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে একটা সময় দর্শকরা ভুলতে বাধ্য হবেন, এটা সিনেমা। মনে হবে যেন সত্য ঘটনা চাক্ষুষ করা হচ্ছে। এই ছবির স্ক্রিনপ্লে এবং সিনেমাটোগ্রাফি এককথায় অসাধারণ।

শাড়ি পরে অ্যাকশন
মন্দিরা চরিত্রে ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। পর্দায় আগুন ঝরিয়েছেন তিনি। আরও একবার তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন তাঁকে টলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী মনে করা হয়। কাহিনির কেন্দ্রে তিনিই। দেখা গেছে দুটি রূপ। প্রথমে কোমল, শেষে হিংস্র। দুটি একবারে বিপরীতমুখী। নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরেছেন। কয়েকটি দৃশ্যে করেছেন ধামাকেদার অ্যাকশান। আশ্চর্যের বিষয়, তিনি অ্যাকশন করেছেন শাড়ি পরেই। হাতে তুলে নিয়েছেন বন্দুক। একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি আগে কখনও বন্দুক ধরেননি। তাঁর দৌড় ছিল কালীপুজোয় ক্যাপ বন্দুক পর্যন্ত। ছবিতে তাঁকে বেশ কয়েকটি খুন করতে দেখা গেছে। প্রতিটি খুনের পর তাঁর অভিব্যক্তি মনে রাখার মতো। শেষ খুনের ক্ষেত্রে তাঁর বসার ভঙ্গি এবং এক্সপ্রেশন দেখে অবাক হতে হয়। এই স্বস্তিকা এক অচেনা স্বস্তিকা।

আরও পড়ুন- অশান্তি অতীত, পাহাড় এখন হাসছে

পরম প্রাপ্তি
দুঁদে পুলিশ অফিসার সুলতান আহমেদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। বাণিজ্যিক এবং অবাণিজ্যিক, দুই ধারার ছবিতে তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। স্বস্তিকার সঙ্গে কয়েকটি দৃশ্যে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় লাভবান হয়েছে ছবি। দুজন এর আগে বেশ কয়েকটি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। মাঝে ছিল দীর্ঘ বিরতি। বহুদিন পর তাঁরা আবার স্ক্রিন শেয়ার করলেন।

বাঁচতে গেলে চাঁচতে হয়
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে নীল মুখোপাধ্যায়, সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায় এবং রজতাভ দত্ত চিত্রনাট্যের দাবি মিটিয়েছেন। কামাল করেছেন খরাজ মুখোপাধ্যায়। তিনিই এই ছবিতে মাফিয়া তথা মাছের সাপ্লায়ার তপন বারিক। স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গিতে অভিনেতার লুক একেবারে পারফেক্ট। তাঁর কমিক সেন্স নিয়ে কোনও কথা হবে না। খল চরিত্রে রীতিমতো ভয়ঙ্কর। যথার্থই তিনি একজন ভার্সেটাইল অভিনেতা। ছবিতে তাঁর মুখের সংলাপ ‘বাঁচতে গেলে চাঁচতে হয়’ আপাতত লোকের মুখে মুখে। শেষে সংলাপটি উচ্চারিত হয়েছে স্বস্তিকার মুখেও। সংলাপটির মধ্যে দিয়ে মাফিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চর্চায় রয়েছেন আরও দুটো বাস্তবধর্মী সংলাপ। সেগুলো হল ‘মানুষ সম্মান না দিলে আদায় করে নিতে হবে’, এবং ‘সকালে মারপিট কিন্তু দিন শেষে সবাই এক গ্লাসের বন্ধু।’

পরিশেষে
ছবি মুক্তির আগে বহু বিতর্ক হয়েছে। নানা কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্য এবং অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। তবে সেসব এখন অতীত। সবথেকে বড় কথা, দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে ‘শিবপুর’ (Shibpur)। বহু মানুষ দেখেছেন। আশা করা যায়, আগামী দিনে আরও অনেকেই দেখবেন। ফলে আরও একবার প্রমাণিত হল, ভাল জিনিসের কদর করেন দর্শকেরা।

Latest article