এমনই বরষা ছিল সেদিন..
ময়মনসিংহের সহবতপুর গ্রামের শীতের আকাশ সেদিন ছিল উজ্জ্বল, স্বচ্ছ, সুন্দর। আঁতুড়ঘরে প্রসবযন্ত্রণায় অপেক্ষা করছেন গোবিন্দময়ী। হঠাৎই একরাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল চারদিক, প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গেই শুরু হল একরাশ বৃষ্টি। ঝড়-বাদলের দাপটে আঁতুড়ঘর ভেঙেচুরে উড়ে গিয়ে পড়ল নদীতে। থেকে থেকে চলতে লাগল মেঘের গুরু-গুরু গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকানি।
সমস্ত সংস্কার জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হলেন দিদিমা-স্থানীয়রা। আঁতুড়ঘর থেকে দরদালানের অন্দরমহলে ঠাঁই হল গোবিন্দময়ীর। প্রকৃতির সব অশনি সংকেতকে উপেক্ষা করে নারী-শিক্ষার মশাল বুকে নিয়ে পৃথিবীতে এলেন শ্যামমোহিনী।
আরও পড়ুন-অভিনব ক্যালেন্ডার
মাতামহী দুর্গাসুন্দরী বললেন, ‘রাজেন্দ্রাণী এলেন কিনা, তিনি কেন মুলিবাঁশের বেড়া দেওয়া মাটির ঘরে জন্ম নেবেন! তাই একেবারে অন্দরমহলের অট্টালিকায় ভুবন আলো করে এলেন।’
নাতনিকে উদ্দেশ্য করে আরও বললেন, ‘গোবিন্দ তুই দেখে নিস, এ মেয়ে কিছু একটা হবে তোর। জন্মের এই ব্যতিক্রম ঈশ্বরের নিশ্চিত কোনও অভিপ্রায় রয়েছে, দেখে নিস! দুঃখ করিস না মেয়ে হল বলে।’
সত্যি ব্যতিক্রমী শ্যামলবরণী এই কন্যার জন্যে বাংলাদেশের কেউ দুঃখ করেনি, বরং অহংকার করেছে। সমাজহিতৈষী শিক্ষানুরাগী বাবার মেয়ে শ্যামমোহিনীর রক্তে ছিল সমাজকল্যাণের ধারা।
আরও পড়ুন-লীলায়িত ভুবন
বাড়ির পাশে আরশিনগর…
মায়ের কাছে ছেলেবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাস রপ্ত করেছিলেন। উচ্চ প্রাথমিক পরীক্ষাই ছিল সে যুগের স্ত্রী-শিক্ষার সর্বোচ্চ সীমারেখা। শহরে অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল। এই পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার খবর ছড়িয়ে পরে রাজশাহি ময়মনসিংহ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ছাত্রী অবস্থায় তিনি যেমন প্রেরণার উৎস ছিলেন, কর্মক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন প্রেরণাদাত্রী। ছাত্রী অবস্থায় রাজশাহিতে পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধাকে রামায়ণ-মহাভারত পড়তে শেখান। রামায়ণ-মহাভারত পড়তে পড়তে বহু চরিত্র তাঁর মনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করত। নিখিল ভারত নারীশিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠাত্রী সম্পাদিকা শ্যামমোহিনী উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন শিক্ষা, সংস্কার ও সেবার ব্রত। সুখের অসুখে তাঁর নজর ছিল না, এখানেই তিনি অতুলনীয়া, অনন্যা। সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। পোশাকে-জীবনে তিনি ছিলেন সরল সাধাসিধে। ছোট চুল ছাঁটা শ্যামমোহিনীকে একবার ভুল করে এক মহিলা ট্রামের মধ্যে বলে উঠেছিলেন— ‘এই যে শুনুন, লেডিস সিট এটা! লেডিস সিট ছেড়ে দিন।’
আরও পড়ুন-লস্ট, থ্রিলারের মোড়কে প্রেম প্যাশন আর অন্বেষণ
তোমার এতো ভালোবাসা কোথায় আমি রাখবো বলো না!
শ্যামমোহিনীর শ্বশুরবাড়ি শিক্ষিত পরিবার। বিবাহের পরেই শ্যামমোহিনীর শিক্ষার ভার সুরেন্দ্রনাথ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। প্রথম সাক্ষাতেই তিনি স্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, লেখাপড়া কদ্দূর জানো? তারপর তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন— ‘দেশে বড়ই অশিক্ষা, স্কুল-কলেজ তেমন নেই। এ বিষয়ে সকলের চেষ্টা করা উচিত। আমিও চেষ্টা করব, তুমিও করবে।’ স্বামীর এই কথা শ্যামমোহিনী সারাজীবন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ তাঁকে ইংরেজি শেখা জরুরি, এই পরামর্শও দেন। তিনি আরও বলেন, লাইব্রেরিতে প্রচুর বই আছে, যতখুশি নিয়ে পড়বে।
অষ্টমঙ্গলায় মামারবাড়িতে ফিরলেন শ্যামমোহিনী। দু-চারদিন পর থেকেই স্বামীর চিঠি আসা শুরু হল। মামার কর্মচারীরা সে চিঠি খুলে পড়ে আবার আঠা লাগিয়ে রেখে দেয়। মামা-মামিও কৌতূহলী হয়ে পড়ে দেখেন যে, তাঁদের কালো মেয়েকে স্বামী আদৌ পছন্দ করছেন কিনা। চিঠি পড়ে তো তাঁদের দুশ্চিন্তা দূর হল। কিন্তু মজা পেল মামার কর্মচারীরা। তাঁরা শ্যামমোহিনীকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল— কী, ইতিহাস কতখানি পড়া হল? দর্শন কতখানি হল? শ্যামমোহিনী তো অবাক! তারপরে চিঠি পড়ে বুঝতে পারলেন তাদের কথার অর্থ। বাক্স খুলে দেখেন কতরকম বইপত্র পাঠিয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ। সঙ্গে চিঠিতে সে-বিষয়ে প্রশ্নোত্তর। দেশভাগের পরে স্বামীর সব স্মৃতিই হারিয়ে যায় শ্যামমোহিনীর।
কিউ কি সাস ভী কভি বহু হ্যায়..
আরও পড়ুন-সস্ত্রীক দেখা করলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে, বিশ্বকাপে সাকিবদের চারে দেখছেন সৌরভ
শ্যামমোহিনীর শাশুড়ি ভবানীসুন্দরী নিজে লেখাপড়া না জানলেও সে-বিষয়ে তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিল। পুত্রবধূ দ্বিতীয়বার শ্বশুরবাড়ি আসার আগেই তিনি হাটাইল মধুপুর গ্রামের লোকেদের ডেকে বলে রাখলেন, আমার বউ খুব লেখাপড়া জানে, তোমরা ছেলেমেয়েদের পাঠাবে, বউ পড়াবে। বউ ফিরে এলে তিনি চণ্ডীমণ্ডপে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ব্যবস্থা করলেন।
একদিন হঠাৎ শ্যামমোহিনী দেখলেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্লেট, পেন্সিল, কেউ বা দোয়াত, খাগের কলম আর চাটাই নিয়ে হাজির। শাশুড়ি পুত্রবধূকে এ-ব্যাপারে আগাম কিছুই জানাননি। এখন ছেলেমেয়েদের দেখিয়ে বললেন, বউ গ্রামে কোনও স্কুল নেই যে, এরা লেখাপড়া শিখবে। তুমিই এদের পড়াও। শ্যামমোহিনী তো এমন সুযোগ পেয়ে সানন্দে মাথায় মস্ত ঘোমটা টেনে তাদের পড়াতে আরম্ভ করলেন।
লেখাপড়া শেখা তাঁর ব্যর্থ হয়নি, শ্বশুরবাড়ির লোকজনে তাঁর কদর বুঝেছে, খুশিতে মন ভরে ওঠে শ্যামমোহিনীর।
আরও পড়ুন-সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের হামলায় জখম ১১ তৃণমূল নেতা-কর্মী
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সুরেন্দ্রনাথের ঐকান্তিক আগ্রহে শ্যামমোহিনী একদিকে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন আর অন্যদিকে নিরক্ষরদের মধ্যে জ্ঞানের আলোর প্রসার ঘটাচ্ছিলেন। গ্রামের লোকেরা শ্যামমোহিনীর উচ্চ প্রশংসা করে তাঁর শাশুড়িকে বলত, আপনার বউ খুব যত্ন করে শেখান, গরিব-বড়লোক বলে কোনও ভেদাভেদ করেন না।
এবার ভাশুরেরা শ্যামমোহিনীকে আরও বড় কাজের ভার দিলেন। তাঁরা নিজেরা সকলেই কাজেকর্মে বাইরে বাইরে থাকেন। এতে জমিদারি দেখাশোনা ও খাজনা আদায়ে খুব অসুবিধা হত। তাঁরা এবার শ্যামমোহিনীকে সব বুঝিয়ে তাঁর হাতেই এই কাজের ভার তুলে দিলেন। শ্যামমোহিনী ঘোমটা দিয়ে ঘরের ভিতর থেকে খাজনা আদায় করে হিসেবপত্র লিখতেন। তবে কথাবার্তা সবই তাঁর শাশুড়ি বলতেন।
শ্যামমোহিনীকে দিয়ে এত কাজ করানোয় প্রথম প্রথম তাঁর জায়েরা হিংসে করতেন। তাঁরা বিদ্রুপ করে বলতেন, উনি তো এখন সেরেস্তায় বসবেন, এবারে তোমরা সব খেটে মরো। একদিন একথা শুনে ফেললেন শ্যামমোহিনী। তারপর থেকে খুব ভোরে উঠে তাড়াতাড়ি করে বাসন মাজা, বিছানা তোলা, ঘর লেপা, উঠোন বাড়ি পরিষ্কার করা— এসব সেরে নিতেন। তারপর সেরেস্তার কাজ করে পড়াতে বসতেন।
আরও পড়ুন-দিদির দূত আর নবান্নে জমা পড়া অভিযোগ নিরসনে ২৭ ফেব্রুয়ারি সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন মুখ্যমন্ত্রী
ন্যাকাপড়া : সংসার-স্বামীভক্তি-রান্নাঘর সব যে রসাতলে যাবে
স্বামীর মৃত্যুর পরে বৈধব্য তাঁকে সংস্কারে আটকে রাখতে পারেনি। নিজের গয়না বিক্রি করে সেই টাকা সুদে খাটালেন। সুদের টাকায় তৈরি করলেন মেয়েদের স্কুল। রান্নাঘরের উল্টোদিকে তৈরি করলেন টিনের ঘর। শুরু হল ক্লাস। পড়ার বই, খাতা, পেন্সিল কিনে দিলেন শ্যামমোহিনী নিজেই।
প্রাচীনপন্থীরা সমালোচনার ঝড় তুললেন। বললেন মেয়েদের ‘ন্যাকাপড়া’! মানে সংসার, স্বামীভক্তি, রান্নাঘর সব যে রসাতলে যাবে। লেখাপড়া শেখাবে না, ছাই, এসব হচ্ছে টাকা রোজগারের ফন্দি। আর নিত্যনতুন সাজ-পোশাকের বাহার দেখানো। কিন্তু মেয়েদের পড়ার ইচ্ছা, তারা শ্যামমোহিনীকে বলল— আমরা পড়তে চাই, তবে মায়েরা যে আসতে দেয় না। শ্যামমোহিনী তাদের পরামর্শ দিলেন— ‘তোরা এক কাজ করিস, তোরা খুব ভোরে উঠবি— উঠে মায়ের যাবতীয় কাজ সেরে আসবি। ভাই-বোনদেরও কোলে করে নিয়ে আসবি।’ তার উপদেশে ফল মিলল।
শ্যামমোহিনী নিজেই তাদের পড়াতেন। সেই সঙ্গে ঘরের কাজও করতেন। তাঁকে দেখেও মেয়েরা শিখতেন। ধান তোলা, পুজোর ভোগ রান্না করা, ভাইকে খাবার দেওয়া— সব সেরে তিনিই এসে মেয়েদের পড়া ধরতেন। দেখতে দেখতে তাঁর স্কুলের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্দরমহল থেকে প্রকাশ্যে এসেছিল শ্যামমোহিনীর এই স্কুল ‘গোবিন্দময়ী বালিকা বিদ্যালয় নামে’।
আরও পড়ুন-রেপো রেট : আবার বাড়ছে মধ্যবিত্তের অশনি সঙ্কেত
লেখাপড়া করে যেই জন…
লেডি অবলা বসুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয় ১৯২৩ সালে। স্ত্রী-শিক্ষার বিস্তারে অবলা বসুর অবদান দেখে শ্যামমোহিনী মুগ্ধ হন। তাঁর হুগলি, হাওড়া ও ২৪ পরগনার পল্লিশিক্ষা বিভাগের পরিদর্শকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শ্যামমোহিনী ১৯২৬ সালে এম ই স্কুলের দেখভালের জন্য পাবনা চলে আসেন। ১৯৩১-এ লেডি বোসের ডাকে সমিতির কাজে ফিরে আসেন। সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে যোগ দেন নারী-শিক্ষা সমিতির বিদ্যাসাগর বাণী ভবনে।
বঙ্গ আমার জননী আমার…
বঙ্গভঙ্গ ও স্বাদেশিকতার সময়ে মেয়েদের মধ্যে স্বাদেশিকতাবোধ জাগানোর জন্য হোস্টেল ও পাড়ার মেয়েদের নিয়ে তৈরি করেন ‘দীপালি সংঘ’। মেয়েদের নিয়ে যোগ দিতে শুরু করেন বিভিন্ন সভা সমিতিতে। বিপ্লবী পুলিন দাস শ্যামমোহিনী ও তাঁর দীপালি সংঘের মেয়েদের লাঠি খেলা, ছোরা চালানো ও যুযুৎসু শেখান ওই হোস্টেলের মধ্যে। বহু মেয়েকে স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষিত করেন।
আরও পড়ুন-এত রাগ কেন?
১৯২৪-এ সুবক্তা হিসেবেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্যা হন। মহিলা সমিতির মেয়েদের সেলাই, হাতের কাজ, চরকায় সুতো কাটায় দক্ষ করে তোলেন। ১৯২০-তে তৈরি পাবনা মহিলা সমিতিতে ১৯২৭ সালে গান্ধীজি পাবনা এলে বিপুলভাবে তাঁকে সমর্থন করে। নিজেদের চরকায় কাটা সুতো দিয়ে নিজেদের নাম লিখে গান্ধীজিকে উপহার দেন। গান্ধীজি খুশি হয়ে বলেন— মেয়েরা তোমরা সব সীতাদেবীর মতো হবে। ১৯২৯ সালে স্কুলের কাজ ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনের মশাল হাতে তুলে নেন। আইন অমান্যের জন্য পথে নামেন।
স্বপ্নের আলপথ ধরে…
শ্যামমোহিনীর চোখে ছিল নারী-শিক্ষার স্বপ্ন। বুকে ছিল স্বাদেশিকতার আগুন। বাংলার গ্রামে গ্রামে তিনিই বারুদ ছড়িয়েছিলেন বলেই আজ নারী-শিক্ষার এই দাবানল। শিক্ষার এই সময়েও তিনিই স্বপনচারিণী হয়ে উঠুন। বাংলার মেয়েরা গেয়ে উঠুক— আমরা যদি এই অকালে স্বপ্ন দেখি, কার তাতে কী?