ঘুরে আসুন রাজগীর

বুদ্ধের বিচরণক্ষেত্র ছিল রাজগীর। কথিত আছে, দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম এখানেই বধ করেছিলেন জরাসন্ধকে। আশেপাশে আছে বেশকিছু প্রসিদ্ধ স্থান। ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য বিহারের এই অঞ্চলে ঘুরে-বেড়ানো জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি হতে পারে। লিখলেন চৈতালী সিনহা

Must read

রাজার ঘর রাজগৃহ। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তার নাম। যখন ইতিহাস তার শুরুর দিকের গল্প শোনায় তখন তার নাম ছিল গিরিব্রজ। পাঁচটি পাহাড় ঘেরা এই অঞ্চল ছিল ষোড়শ মহাজনপদের এক সমৃদ্ধ অঞ্চল মগধের রাজধানী। রত্নগিরি বিপুলাচল, বৈভগিরি, সোনগিরি আর উদয়গিরির আদরে ঘেরা অতীতের গিরিব্রজ হল মাঝে রাজাদের রাজগৃহ তার পর সাধারণের রাজগীর। তার সঙ্গে জুড়ে আছে প্রবাহমান জ্ঞানের স্রোত সেই ন আলম দা, সাতশো বছরের একটা গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। তার পোড়া চেহারা যেন চিৎকার করে অত্যাচারীকে চেনায়। সেকুলারিজমের মারাত্মক ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গলিত লাভার মতো বেরিয়ে আসে তীব্র ঘৃণা। শিক্ষায়তনকে পোড়ায় যারা, ইতিহাস তাদের কখনও ক্ষমা করে না।

আরও পড়ুন-পরীক্ষায় ব্যর্থ হলেও থাকবে শিক্ষকদের চাকরি, আশ্বাস বিহার শিক্ষামন্ত্রীর

এই একটা সময় যখন গিজার আর এসি বসে ডুয়েট গায় তোমার হল শুরু, আমার হল সারা ঠিক এই সময় রাজগীরের ডাকে সাড়া না দেওয়া মানে নিতান্তই বেড়ানোর ঠাকুরকে অসম্মান করা। পরীক্ষা ভাইরাসগুলো এই সময় একটু কম অ্যাক্টিভ থাকে। বিহারের রাজগীর বিহারের জন্য বাঙালির বক্তিয়ারপুর কিংবা গয়াপ্রাপ্তি আবশ্যিক। রাজগীর ঘোরার নাম নিয়ে বেরোলেও গয়া, বুদ্ধগয়া, নালন্দা, পাওয়াপুরি, রাজগীর এক ব্র্যাকেটের মধ্যেই থাকে। রাগের পারদ যখন চড়ে নালন্দার অবস্থা দেখে, বোধিবৃক্ষের স্পর্শে সে পারদ নেমে আসে করুণাধারার শিক্ষায়। পাওয়া পুরীর জৈন মন্দিরে মন থেকে নামে ক্লেশের ভার, শান্তিস্তূপে মনে আসে শান্তি আর গয়ায় বিষ্ণু পাদপদ্মস্পর্শে মন খুঁজে পায় সঠিক দিশা। তাই দিন চার-পাঁচের রাজগীর ভ্রমণ মনের বিভিন্ন স্তরের বিকাশ এবং উত্তরণ।

আরও পড়ুন-প্রেমদিবসে নিজের বিশ্বরেকর্ড করা ৩২৭ ফুট লম্বা চিঠির সংরক্ষণ চান অনুপম

গয়া দিয়ে এই বিহার শুরু করলে শেষ হবে বখতিয়ার পুর দিয়ে কিংবা বিপরীত ক্রমে। পুণ্যাত্মা গয়াসুরের স্মৃতিধন্য বিষ্ণুপাদপদ্ম, অভিশপ্ত অন্তঃসলিলা ফল্গু নদী, জন্ম-মৃত্যুচক্র অতিক্রম করে পরমাত্মার সঙ্গে লীন হওয়ার চক্করে পূর্বজদের পিণ্ডদান রীতি নিয়েই গয়া তীর্থ। সব মিলিয়ে একটা বেলা ভালই লাগে। বিকেলের নরম আলোয় বুদ্ধগয়ার মন্দিরগুলো দূর থেকেই বড় মায়াবী লাগে। শান্তির রাত নেমে আসে বুদ্ধের দেশে কোনও এক বিলাসী সরাই সজ্জায়। আধো জাগরণে তন্দ্রায় দেখি সারা ভারত জুড়ে যুগ যুগ ধরে তপস্যার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সুজাতারা হেঁটে চলেছে পরমান্ন পাত্র হাতে নিয়ে, গড়ে তুলছে একের পর এক বুদ্ধ।
পনেরো কিলোমিটার দূরত্ব ফল্গুকে বানায় নিরঞ্জনা। সীতাদেবীর দেওয়া বালির পিণ্ড নিয়ে দশরথ হলেন তৃপ্ত, সাক্ষী রইলেন ফল্গু। পরে রামচন্দ্রের জিজ্ঞাসায় অস্বীকার করলেন পিণ্ড দানের কথা। অপমানিত সীতার অভিশাপে ফল্গু নদী অন্তঃসলিলা। পায়ের পাতা শুধু ডোবে। তোমার মিথ্যা বলার শাস্তি— শিয়াল-কুকুর তোমার উপর চরে বেড়াবে! নিরঞ্জনা নামে কিছুটা হয়তো তার পাপক্ষয় হয়েছে তাই বুদ্ধদেবের তপস্যা সফল হল। অশ্বত্থ (পিপল) গাছের নিচে বোধিলাভের স্থানে সম্রাট অশোক নির্মাণ করলেন মহাবোধি মন্দির। বিশ্বতীর্থ বুদ্ধগয়ায় চিন, জাপান, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও আরও অনেক দেশ মন্দির নির্মাণ করেছে। প্রত্যেক মন্দির তার নিজস্ব গঠনশৈলীতে অনন্য। প্রায় আশি ফুট উঁচু একটি বুদ্ধমূর্তি বিস্ময় জাগায়। যুগে যুগে বৌদ্ধেরা শান্তির বাণী ছড়িয়েছেন বিশ্বময়।

আরও পড়ুন-এবার ষষ্ঠ সমন, ১৯শে ইডির তলব কেজরিকে

বোধি লাভের পর ধর্মপ্রচার। ‘নৃপতি বিম্বিসার নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইলা পাদনখকণা তাঁর’। খ্রিস্ট পূর্ব পাঁচশো তেতাল্লিশের কথা, মগধের সিংহাসনে তখন হর্ষঙ্ক বংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি বিম্বিসার। রাজানুগ্রহে রাজগীর হল বুদ্ধের বিচরণ ক্ষেত্র। এখানে আরও আগে বৃহদ্রথ-পুত্র জরাসন্ধের সন্ধি বিযুক্ত করে ভীম জরাসন্ধ বধ করেছিলেন কৃষ্ণের ইশারায়। জরাসন্ধ বৈঠক, কৃষ্ণের রথের চাকার দাগ, সোনাভাণ্ডার, গরমজলের কুণ্ড ঘুরে বিশ্ব শান্তি স্তূপ। চলমান একক দড়িপথ। রোপওয়ে যাত্রা তো সবচেয়ে উত্তেজনা পূর্ণ। বাক্সবন্দি ছয় জনের ঝোলা নয়, খোলা চেয়ার এবং একা। ঘোড়া কাটোরা লেক খুব নিরিবিলি, ভাল জায়গা। রাজগীর যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর এবং মনোরম জায়গা ছিল এবং এখনও আছে। ইতিহাসের এক-একটা পাতা হয়ে ওঠা রাজগীরের এক-একটা স্থান পেরিয়ে এবার আসবে রাজগীর জু সাফারি। ইতিহাস ও ধর্মের পর আকর্ষণ আধুনিক গ্লাস ব্রিজে। জু-এর সাফারির টিকিট অনলাইনে করে আসাই ভাল। একটা দিনই না-হয় বেশি লাগবে, মন ভরবে নিশ্চয়।

আরও পড়ুন-শহরবাসীর হয়রানি কমাতে পুরভবনেই ঠিকা দফতর

এবার চিরন্তন জ্ঞানের প্রবাহ পথে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রাচীনতম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে গুপ্তসম্রাট কুমারগুপ্তের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানে দশ হাজার ছাত্র বিনাপয়সায় পড়াশোনা করত। সম্পূর্ণ রাজানুগ্রহে চলা এই প্রতিষ্ঠান ভারতকে জ্ঞানের জগতে অনেক উঁচু আসনে বসিয়ে ছিল। যে-যুগে গোটা বিশ্বে ধর্ম আর পারিবারিক শিক্ষা ছাড়া সেভাবে কোনও শিক্ষায়তন গড়েই ওঠেনি সেই যুগে ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়। দু’হাজার শিক্ষক এখানে থাকতেন। প্রধান হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান পেয়েছে আর্যভট্ট, নাগার্জুন, দিননাগ, শীলভদ্র, ধর্মপাল, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর প্রমুখ দিকপালকে। নালন্দার গ্রন্থাগারের দশ লক্ষাধিক পুঁথি ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বসেরা ভাবাতে পেরেছিল। দেশ-বিদেশ থেকে ছাত্র আসত নালন্দায়। হিউয়েন সাং-এর বই আমাদের জানিয়েছে নালন্দার ইতিকথা। যারা ভাবি ইংরেজরা আমাদের দেশে প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন তারা কতটা ভুল জানি, সেটাই জানি না। হুন আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত নালন্দা সেরে উঠেছিল। গৌড় আক্রমণের ক্ষত শুকিয়ে গিয়েছিল। ১২০০ সালে বখতিয়ার খিলজি নালন্দাকে জ্বালিয়ে দিলেন। তিনমাস ধরে জ্বলেছিল নালন্দার পুঁথি। পোড়া দাগ আজও নালন্দার ধ্বংসাবশেষ দেওয়ালে— পোড়া ঘা আজও ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার গোটা শরীর জুড়ে। একটা জাতিকে পিছিয়ে দিতে তার শিক্ষাব্যবস্থায় আঘাতের কোনও বিকল্প নেই। বখতিয়ার খিলজি ভারতের ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্ক হয়েই রয়ে যাবেন।
নালন্দা থেকে পাওয়াপুরি। জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের মহানির্বাণস্থল। জলের মধ্যে মন্দির, জলের মধ্যে ফুল ফুটুক না ফুটুক পদ্মের বাগান। মন্দিরে মহাবীরের পায়ের ছাপ। একটু শান্তির খোঁজে এখানে আসা যায় বারবার।
রাজগীর শুধু বেড়াতে যাওয়ার জায়গা নয়। ইতিহাসের পাতা একটার পর একটা ওল্টাতে যাঁরা পছন্দ করেন তাঁদের জন্য চারটে দিনে গয়া, বুদ্ধগয়া, রাজগীর, নালন্দা, পাওয়াপুরি জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি হবে। এই বসন্তে ঘুরে আসুন।

আরও পড়ুন-দাপুটে মেধাবী সরস্বতী

কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে গয়া টাইম টেবল দেখলে খান কুড়ি ট্রেন পাওয়া যাবেই। গয়া থেকে বুদ্ধগয়া আধ ঘণ্টার পথ। বাস, অটো নিয়মিত এবং প্রচুর। বুদ্ধগয়া থেকে রাজগীর ঘণ্টা দেড়েকের পথ। বাস, গাড়ির ছড়াছড়ি। রাজগীরে আজও টাঙা চলে। রাজগীর থেকে নালন্দা পনেরো কিলোমিটার। পাওয়া যায়
বাস, অটো।

কোথায় থাকবেন?
গয়া, বুদ্ধগয়া, রাজগীরে হোটেলের ছড়াছড়ি। বাজেট আর পছন্দ একান্ত ব্যক্তিগত। খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। যেকোনও সুস্থ ভদ্রলোকে যা যা খান তার সবই এই এলাকায় পাওয়া যায় এবং দামও সাধারণ।

Latest article