‘Atomic Habits’ নামে একটা বই লিখেছেন জেমস ক্লিয়ার। সেই বই দুনিয়া ব্যাপী বিক্রি হয়েছিল প্রায় দেড় কোটি। অনূদিত হয়েছে ৫০টি ভাষায়। ওই বইটিতে ক্লিয়ার একটা কথা লিখেছিলেন। বলেছিলেন, শেষপর্যন্ত আশাবাদীরা জিতে যান কারণ সফল হতে কতদিন লাগবে, কতটা পরিমাণে নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে পারলে সফল হওয়া যাবে, এসব হিসাবে তাঁরা সবসময় ভুল করে বসেন আর তাই সফল হওয়ার জন্য তাঁরা সবসময় বেশি প্রয়াস চালান।
আরও পড়ুন-১১ গোর্খা জনজাতি তফশিলিতে আসবে, দার্জিলিংয়ের ১৫ বছরের রিপোর্ট কার্ড দিক বিজেপি
যদি ব্যাপারটি এরকম হয় তাহলে অন্য কথা। নইলে বিজেপির কিংবা মোদিজির হিসাব মিলছে না কিছুতেই। হিসাব মানে ৪০০ আসনের হিসাব। যে ৪০০ আসনের স্বপ্ন ওঁরা দেখছেন এবং চারিদিকে সেই কথা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারে অন্যরকম।
বরাবর বিজেপিকে দারুণভাবে সাহায্য করে হিন্দি বলয়। ২০১৯-এর ভোটে দেখা গিয়েছে, গো-বলয়ের দশটি রাজ্যের মোট ২২৫টি আসনের মধ্যে এনডিএ পেয়েছে ২০৩টি আসন। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে ৮০টির মধ্যে ৬৪টি, বিহারে ৪০টির মধ্যে ৩৯টি, হরিয়ানায় ১০টির মধ্যে ১০টি, দিল্লিতে ৭টির মধ্যে ৭টি, রাজস্থানে ২৫-এ ২৫, হিমাচলে ৪-এ ৪, উত্তরাখণ্ডে ৫-এ ৫, মধ্যপ্রদেশে ২৯টির মধ্যে ২৮টি আসন জেতে বিজেপি বা এনডিএ। এর বাইরে ছত্তিশগড়ে ৯টি এবং ঝাড়খণ্ডে ১২টি আসন দখল করে এনডিএ। হিন্দি বলয়ের দশটি রাজ্যে বিজেপি তথা এনডিএ-র চূড়ান্ত সাফল্যের এই পরিসংখ্যান তাদের ঝুলিতে থাকলেও এবারের বাস্তব পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই ২৪-এর ভোট ২০১৯-এর চেয়েও সেখানে তাদের ভাল ফল করা শুধু কঠিনই নয়, কার্যত অসম্ভব। খাতায়-কলমে একমাত্র উত্তরপ্রদেশে কয়েকটি আসন বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও থাকতে পারে। বলা যেতেই পারে, উত্তরপ্রদেশ ছাড়া গো-বলয়ের বাকি ন’টি রাজ্য থেকে বিজেপির আসন সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ তেমন নেই, বরং সেখান থেকে ২০১৯-এর তুলনায় বিজেপির বা এনডিএ-র আসন সংখ্যা কমার সম্ভাবনাই প্রবল।
আরও পড়ুন-পিএসসি : আদালতের নির্দেশে তদন্তে সিআইডি
বাকি রইল দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তর ভারত। এখানে মোট আসন সংখ্যা ৩১৮। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে দক্ষিণ ভারতে মোট ১৩০টি আসনের মধ্যে বিজেপির ভাগ্যে জুটেছিল মাত্র ২৯টি আসন। এর মধ্যে কর্নাটকেই ছিল ২৫টি আসন। বাকি ৪টি তেলেঙ্গানায়। অন্যদিকে অসম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা-সহ উত্তরপূর্বের মোট ৮টি রাজ্যের ২৫টি আসনের মধ্যে বিজেপির দখলে ছিল ১৪টি আসন। তার মানে এনডিএকে ৪০০ আসন পেতে হলে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাবের মতো রাজ্যগুলির বাকি ১৬৩টি আসনের মধ্যে পেতে হবে ১৫৫টির মতো আসন। বিজেপির দাবি, তারা কেরল, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানায় ভাল সংখ্যক আসন পাবে। পশ্চিমবঙ্গে নাকি পাবে ৩০টির বেশি আসন। তাদের দাবি, এইসব মিলিয়েই ‘ম্যাজিক’ সংখ্যা ৪০০-তে পৌঁছে যাবে! এসবই আসলে কষ্টকল্পিত বিষয়। যার সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতি মেলে না।
আরও পড়ুন-মালদহ ও বহরমপুরের দুই সাংসদ বিজেপির হাত শক্ত করেছে: অভিষেক
পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় দফার ভোটের কথাই ধরা যাক।
আগামী শুক্রবার বালুরঘাটে ভোট। প্রার্থী বিজেপির রাজ্য সভাপতি। তার ওপরে তিনি, শোনা যায়, অমিত শাহর ঘনিষ্ঠ। কিন্তু শুধু ইটাহার বিধানসভা এলাকা যদি তৃণমূল কংগ্রেসকে ৮০ থেকে ৮৫ হাজারের লিড দেয়, তাহলেই অবলাকান্ত মজুমদারকে তাঁর রাজপাট হারাতে হবে। তার উপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি তৃণমূল কংগ্রেসে তাঁদের আস্থা অটুট রাখেন, তবে তো কথাই নেই। পরিষেবার দিক থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতার ধারেকাছে কেউ নেই। তা সে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার হোক বা স্বাস্থ্যসাথী। নির্বাচনে এই পরিষেবা প্রদানে সাফল্য নিশ্চিতভাবে মা মাটি মানুষের ওপর জনাশিস বর্ষণে বেগ আনবে।
পাশের কেন্দ্র রায়গঞ্জে আবার বিজেপির অবস্থা এমনিতেই খারাপ। সিটিং এমপি মোদি মন্ত্রিসভার রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। হাওয়া অনুকূলে নেই বুঝেই তাঁকে রায়গঞ্জ থেকে সোজা কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ফেলা হয়েছে। নিজেদের কেন্দ্রের মানুষের জন্য কী করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে আমতা আমতা করা ছাড়া উপায় নেই ওই এমপির। তাঁর জায়গায় যিনি বিজেপির টিকিট পেয়েছেন তিনি আগে ছিলেন কংগ্রেসে। তারপর কালিয়াগঞ্জের চেয়ারম্যানও হয়েছেন। তারপর ভায়া তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিতে এসেই টিকিটের দাবিদার। গেরুয়া শিবিরে তিনি যে খুব পছন্দের মানুষ, তেমনটা কেউ বুক ঠুকে বলতে পারবে না।
বাকি থাকল দার্জিলিং। এখানে ফ্যাক্টর চা-বাগান। জমির পাট্টা বিলি, মজুরি, মাথার উপর ছাদ দেওয়ার মতো প্রকল্প এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা এবং তাঁর প্রতি পাহাড়ের মানুষের আস্থা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। মোদি ২০৪৭-এর গল্প শোনাচ্ছেন। ২০৪৭ অনেক দূর। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার কিন্তু বর্তমান। মানুষ যদি আজ ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েই সত্যিই ভাবে, মোদি তাঁর ১০ বছরে মানুষকে কী কী দিয়েছেন, তাহলেই প্রশ্ন উঠবে, রামমন্দিরের জন্য ৬০০ কোটি টাকা খরচ করাটা কি যুক্তিসঙ্গত? নাকি এই টাকা গরিব মানুষের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার হলে বেশি উপকার হত?
ব্যস! সেই উত্তরটা পেয়ে গেলেই মোদি গ্যারান্টির খেল খতম।
আরও পড়ুন-রাজারামের পাঁচ লিঙ্কম্যান শহরে! তল্লাশি গোয়েন্দাদের
প্রচারবাবু মোদির দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথাকথিত ধর্মযুদ্ধের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সমস্ত বিরোধী দলকে শেষ করে ফেলো এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরোধী নেতাদের দূরে রাখো। বিজেপির মারাত্মক আলিঙ্গন ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দলকে (মূলত একটি রাজ্যেই যাদের কর্মকাণ্ড) সাইনবোর্ড-সর্বস্ব করে ফেলেছে। এই তথাকথিত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ আদৌ দুর্নীতির বিরুদ্ধে নয়, এটি বরং আরও আধিপত্য বিস্তারের কৌশল, এই সহজ সত্যটা আজ স্পষ্ট।
বিরাট স্ট্যাচু অব ইউনিটি গড়ে যিনি একসময় হাততালি কুড়িয়েছেন, তিনিই ভারতের আত্মিক ঐক্যকে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে শেষ করতে চলেছেন। যিনি নিজেকে দেশের ‘চৌকিদার’ বলে বুক বাজান, তাঁর দলকে ঘিরে আজ ইলেক্টোরাল বন্ডের কলঙ্ক জমেছে। আমরা এখনও জানি না, পিএম কেয়ার্স ফান্ড নিয়ে এমন কোনও হতবাক হওয়ার মতো কিছু ভবিষ্যতে ঘটবে কি না! একমাত্র সুপ্রিম কোর্টই আমাদের সেই রাস্তা দেখাতে পারে। সুতরাং এই মুহূর্তে মোদি গ্যারান্টির শেয়ার দর যে ভোটারদের কাছে হু হু করে পড়ে যাচ্ছে, এনিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
৪০০ দূর অস্ত। ২০০ আসনেও গেরুয়া পার্টি পৌঁছবে কি না সেবিষয়ে সন্দেহ আছে।