ক্লাউড এখন ওদেরও!

আজ আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট দিবস। গত কয়েক বছরে এই রাজ্যের পাশাপাশি গ্রামীণ ভারতবর্ষেও মহিলাদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। প্রায় ৪২ শতাংশ মহিলা জীবন-জীবিকা ও বিনোদনের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। ইন্টারনেট এখন গ্রামীণ ভারতের মহিলাদের অন্যতম প্রযুক্তি। যার মাধ্যমে পাল্টে যাচ্ছে ভাবনার এবং বাস্তবের জগৎটা। লিখলেন বিশ্বজিৎ দাস

Must read

ক্যানভাস -১
ট্রলার তখন মাঝসমুদ্রে। ঢেউ উঠেছে উথাল-পাথাল। সামাল-সামাল রব। ঈশ্বরকে ডাকছেন সকলে। মনে মনে বলছেন— রক্ষা করো। রক্ষা করো। অথচ অবিচল এক প্রান্তে বসে আছেন মীনাক্ষী। ভাবছেন জয় করতেই হবে এই ঝড়-বাদলকে। সন্ধ্যা থেকেই ঈশান কোণে মেঘ দেখে ভাবছিল সে। ফিরে যাওয়াই ভাল। কিন্তু সহজে ঘরে ফেরার মেয়ে সে নয়। সমাজের সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে সে একা মেয়ে শংকরপুরে মাঝসমুদ্রে মাছ ধরতে বেরিয়েছে। রাজ্যে সে প্রথম মেয়ে, যে সমাজের মিথ ভেঙে মাছ ধরতে যায় (মৎস্যজীবীদের ট্রলারগুলো উৎসর্গ করা আছে মহিলা দেবীদের নামে। কখনও মা মনসা। কখনও মা চণ্ডী। অথচ তাঁরা বিশ্বাস করেন, মেয়েরা স্পর্শ করলে অশুচি হয়ে যায় এই ট্রলার।) মীনাক্ষী নিজের সঙ্গে লড়াই করে বেরিয়ে পড়েছিল মাঝসমুদ্রে। জীবন ও জীবিকার জন্য। সঙ্গী শুধু একটা রেডিও। সে-ই পথ দেখায় মীনাক্ষীকে। আর মীনাক্ষী পথ দেখায় সমুদ্রকে। রেডিও জানায় আবহাওয়ার খবর। সে-খবর সবসময় মেলেও না। শেষ মুহূর্তে বদলে যায় প্রকৃতি। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বাজি রাখতে হয় জীবন।

আরও পড়ুন-কমলাদেবী মহিয়সী এক নারী

বছর কুড়ি আগের মীনাক্ষী এখনও সমুদ্রে যান। তবে বদলে ফেলেছে তার সঙ্গীকে। তাঁরও বয়স হয়েছে। এখন তাঁর সঙ্গী মুঠোফোন আর ফাইভ জি ইন্টারনেট। প্রতি মুহূর্তে উইন্ডি তাঁকে বলে দেয় প্রকৃতির হালহকিকত। পথ দেখায় তাঁর মতো ব্যতিক্রমী মহিলা মৎস্যজীবীদের। তাঁর পথ ধরে অনেক মহিলাই এখন বেরিয়ে পড়েন মাঝসমুদ্রে। ভরসা শুধু ইন্টারনেট। জয় দুর্গা। জয় চণ্ডী। জয় মনসা। জয় ইন্টারনেট। এখন তাঁদের নতুন মন্ত্র।
ক্যানভাস-২
সন্ধ্যা নামেনি তখনও। গোধূলি আলোয় একে একে জমায়েত হচ্ছে। মাঠাবুরু, মারাংবুরুকে সাক্ষী রেখে। পাহাড়ের নিচে। নেত্রী মৌসুমির জন্য। না কোনও আন্দোলন নয়। এ যেন ছৌয়ের নিঃশব্দ বিপ্লব। সমাজের মিথ ভেঙেছে মৌসুমি। তৈরি করেছে মহিলা ছৌ নাচের দল। এখন এলাকার মেয়েদের নিয়ে তৈরি করেছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। ইন্টারনেটই তাঁদের এক করেছে। এই ইন্টারনেটের ভরসায় ভিন রাজ্য থেকে, ভিন দেশ থেকেও মহিলারা আসছেন মৌসুমির কাছে।
লোকাচার ভেঙে ছৌ-নাচে এগিয়েছে মেয়েরা। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহিলারা অনেক ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছেন৷ শতাব্দী-প্রাচীন প্রথা ভেঙে এবার তাঁদের সাফল্য মিলেছে।

আরও পড়ুন-উদ্যান পালনে স্বনির্ভর

পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ মূলত বীররসের নাচ৷ তাই এই নাচে শারীরিক কসরত বেশি লাগে৷ ডিগবাজি খাওয়া বা উলফা এই নাচের অন্যতম গুরুত্বপূ্র্ণ অংশ৷ পুরুষ ছাড়া অন্য কারও এই নাচে অংশ নেওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল না গত দশকেও৷ বলা যায়, মহিলারা ছৌ-নাচে একদম ব্রাত্য ছিলেন৷ মহিলাদের চরিত্রে মেয়েদের মতো সাজগোজ করে পুরুষরাই মঞ্চে আসতেন ৷ এখনও অধিকাংশ দলে সেই নিয়মই চলছে৷ কিন্তু, মিথ বা লোকাচার ভেঙে গত ছয়-সাত বছরে মহিলারাও ছৌ-নাচে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসছেন৷ আর ইন্টারনেটের হাত ধরে তা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
এই রাজ্যে শিল্পকলাকে আন্তর্জাতিক ক্যানভাসে তুলে ধরতে ইউনেস্কোর সঙ্গে সরকার হাত মিলিয়েছে৷ ফলে বাংলার যে লোকশিল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল, তা আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে৷ রাজ্য সরকারের লোকপ্রসার প্রকল্পের হাত ধরে ছৌ-নাচের পরিসর বড় হয়েছে৷
বলরামপুর গ্রামের মহিলারা ছৌ-নাচে অংশ নিতে শুরু করেছেন। এই মুহূর্তে সাত থেকে আটটি মহিলাচালিত ছৌ-নাচের দল রয়েছে৷ জগন্নাথের বড় মেয়ে মৌসুমি চৌধুরি প্রথম মহিলা ছৌ-শিল্পী৷ মৌসুমির ছৌ-নাচের দলটির নাম ‘মিতালি ছৌ মালডি’৷ শিল্পীদের গ্রাম মালডির নামে এই নামকরণ৷ বাদ্যকাররা পুরুষ হলেও নৃত্যশিল্পী সবাই মেয়ে৷
মহিলা ছৌ-শিল্পী হিসেবে নরওয়েতে পা রেখেছেন মৌসুমি৷ ২১ বছরের মৌসুমিই প্রথম মহিলা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে মহিলাদের কৃতিত্বের কাহিনি তুলে ধরেছেন৷ তিন-চার কেজি ওজনের মুখোশ আর ভারী পোশাক পরে লাফানো খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়৷ কিন্তু সেই অসাধারণ ব্যাপারই সম্ভব হয়ে উঠেছে মহিলাদের চেষ্টা ও ইন্টারনেটের অনুশীলনে৷ সরলা মুড়া, করুণা মাহাতোদের দল তাই প্রমাণ করেছে নিজেদের। জানান দিয়েছে তাঁদের কথা ইউটিউবে। ইন্টারনেটে। এটা শুধু তাদের বাণিজ্যের প্ল্যাটফর্ম নয়। সমাজের মিথ ভেঙে ঐতিহ্যকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ।

আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামের পর আবার বিদ্রোহ, এবার রাজ্যস্তরে সিবিআই থেকে বাঁচতে দলবদলুদের সিন্ডিকেটের হাতে বিজেপি

পুরুলিয়ার স্কুলছাত্রীরাও ছৌ-নাচে মনোযোগ দিয়েছে৷ রঘুনাথপুর ২ নম্বর ব্লকের বি সি গার্লস স্কুলের কন্যাশ্রী মেয়েরাও ছৌ-দল গড়েছে৷ ছৌয়ের তালিম চলে সগড়কা গ্রামে। গ্রামের মেয়েদের উৎসাহ-গুরু এখন ইন্টারনেট। এখন পুরুলিয়ার মেয়েরা শিখছে ছৌ। স্বপ্ন দেখছে তারা একদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মেয়েরা শিখবে ছৌ। ইন্টারনেট আর ইউটিউবের পাঠশালায়। জয় ইন্টারনেট!
ক্যানভাস-৩
আমিনা বিবির মুঠোফোনে সকাল থেকেই আসছে শুভেচ্ছা বার্তা। উৎসবের পরে চলছে খোঁজ-খবর। বসিরহাট, বাদুড়িয়া, হাসনাবাদ টাকির মেয়েরা শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি জানতে চাইছে করে থেকে আবার ট্রেনিং শুরু হবে। আবার দেখা হবে। শেখা হবে। কথা হবে। গ্রাম বাংলার এই চাওয়া-পাওয়ার বারোমাস্যা চলে ইন্টারনেটের হাত ধরে।
সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সি এবং কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র কোভিডের আগে এক সমীক্ষায় ইন্টারনেট ব্যবহারের একটি ছবি তুলে ধরে। রিপোর্ট-এ দেখানো হয় যে পুরুষ-মহিলা ভেদে ইন্টারনেট ব্যবহারে বৈষম্য রয়েছে। ৩৪ শতাংশ শহুরে। ৫২ শতাংশ পার্থক্য রয়েছে গ্রামীণ এলাকার মহিলা ও পুরুষের মধ্যে। ভারতে মাত্র ৪৩ শতাংশ মহিলার কাছে রয়েছে নিজস্ব ফোন, যেখানে ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ পুরুষ ব্যবহার করেন স্মার্টফোন। ভারতে ইন্টারনেটের ব্যবহার নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়া এবং কম্বোডিয়ার তুলনায় ১৯ শতাংশ কম। ৬৪ শতাংশ মানুষ স্বীকার করেছেন তাঁরা ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানেন না। এর মধ্যে ৬৮ শতাংশ মহিলা গ্রামাঞ্চলের। তবে গ্রাম-বাংলার ছবিটা এতটা হতাশার নয়। বরং উৎসাহের। এখন মীনাক্ষী, মৌসুমি, আমিনা বিবিরা গ্রাম বাংলার মুখ। বাংলার ছবি তাঁরা পৌঁছে দিচ্ছেন বিশ্বের দরবারে।

আরও পড়ুন-বিরোধী দলনেতার ন্যক্কারজনক মিথ্যাচার, মুখোশ খুলে দিলেন চন্দ্রিমা

কোভিড-পরবর্তী ছবিটা কিন্তু অন্য রকম। উৎসাহের। কোভিডের প্রয়োজনীয়তা বদলে দিল ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্যানভাস। এখন প্রায় দেড় বিলিয়ন ভারতীয় মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। তাঁদের মধ্যে এক বিলিয়নের ফোনে রয়েছে ইন্টারনেট। গ্রামীণ ভারতে এ বছর ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় কুড়ি গুণ। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। ফলে পাল্টাচ্ছে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার মান। গ্রাম বাংলার ছবিটাও একই ভাবে বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মহিলাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উপার্জনের ছবিটাও।
পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়
শুধু এ-রাজ্যে নয়, গ্রামীণ ভারতবর্ষেও মহিলাদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। প্রায় ৪২ শতাংশ মহিলা জীবন জীবিকা ও বিনোদনের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। ইন্টারনেট এখন গ্রামীণ ভারতের মহিলাদের অন্যতম প্রযুক্তি। যার মাধ্যমে তাদের ভাবনার এবং বাস্তবের জগৎটা পাল্টে যাচ্ছে। নিয়েলসনের ভারত ২.০ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ৩৫২ মিলিয়ন ভারতীয় গ্রামীণ অঞ্চলে সক্রিয় ভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। যার টেক্কা দিচ্ছে শহরের পরিসংখ্যান। গত বছর ডিসেম্বর মাসের এই পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে গ্রামীণ মহিলাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের অনুপাত। মজার বিষয় এদের প্রায় ৯০ শতাংশ প্রতিদিন রুটিনমাফিক ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। কিন্তু ৫০-ঊর্ধ্ব মহিলারা প্রায় ৮১ শতাংশ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এটা প্রশংসার যে এ-দেশের বা এ-রাজ্যের গ্রামীণ মহিলাদের মধ্যে নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করার মেনে নেওয়ার ও মনে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। একটা মুঠো ফোন আর এক টুকরো ইন্টারনেট হাতে পেলেই বাকি পৃথিবীটা তাদের হাতের মুঠোয় চলে আসে।

আরও পড়ুন-জগদ্ধাত্রী পুজো: চন্দননগরে বৈঠকে বিদ্যুৎমন্ত্রী

এই নতুন প্রযুক্তি গ্রামীণ ভারতে শুধুই নেটওয়ার্ক তৈরি করে না, সামাজিক ভাবে এক করে তোলে। একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করা, ভিডিও দেখা, অনলাইনে গান শোনা এগুলো এখন গ্রামীণ মহিলাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারনেট ব্যবহারের মধ্যে পড়ে। ৪৪০ মিলিয়ন গ্রামীণ মহিলা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভিডিও দেখেন যা গ্রামীণ ভারতের প্রায় ৫৪ শতাংশ।
ইন্টারনেট সাথী
ইন্টারনেটের ব্যবহার নিমেষেই বদলে দেয় গ্রামীণ বাংলার জীবনযাত্রার মানচিত্র। ‘ইন্টারনেট সাথী সমীক্ষায়’ দেখা যায় গ্রামীণ মহিলাদের আর্থিক অবস্থার মানোন্নয়ন ঘটছে ইন্টারনেটের মধ্যে দিয়ে। সরকার তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তারা নিজেরা বিভিন্ন স্বনির্ভর প্রকল্পে ট্রেনিং নিয়ে তৈরি করছে আচার, ডালের বড়ি, মোমবাতি এবং সেগুলো বিক্রি করছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। শিখছে টেলরিংয়ের কাজ, মাসরুম চাষ, ফ্যাশন ডিজাইনিং এবং বিউটিশিয়ন কোর্স যা তাকে স্বনির্ভর করছে। অনেকে ইউটিউব থেকে পাঠ নিয়ে তৈরি করছেন বিভিন্ন কেক, হ্যান্ডমেড চকোলেট, ড্রাইফ্রুটস। এবং পরে সেগুলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই বিক্রি করছেন। ফলে ইন্টারনেট হয়ে উঠছে তাঁদের আর্থিক সাবলম্বী হয়ে ওঠার নির্জন পথ।

আরও পড়ুন-ভাবা যায়! গণধর্ষণের বিনিময়ে কি না চাকরি

শান্তিনিকেতনের রাহেনা বিবি বা সুমনা আখতার, তাঁদের হস্তশিল্প বিকিকিনির মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন ওয়াটসাঅ্যাপ, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামকে। ফলে তাঁরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন আর্থিক ভাবে। এবং তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে বাইরে পাঠাচ্ছেন। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ তাদের সমীক্ষার রিপোর্টে দেখিয়েছে ভারতের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা অর্ধেকই গ্রাম অঞ্চলের। তাদের প্রায় ৪০ শতাংশই মহিলা। ইন্টারনেট তাঁদের সংস্কৃতির বদল এনেছে, বদল এনেছে ভাবনার। ফলে বাইরের জগৎটাকে তারা দেখতে শিখছে, জানতে শিখছে। খুলে যাচ্ছে দক্ষিণের প্রসারিত দ্বার।
মহিলাদের ই-রেনেসাঁ
গ্রামীণ বাংলায় মহিলাদের ই-রেনেসাঁ বা নবজাগরণ এনেছে গুগল ইন্ডিয়া ও টাটা তাদের ‘ইন্টারনেট সাথী’ প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে। তারা পৌঁছে গেছে বাংলার প্রায় ৪০০ গ্রামে। যেমন ভাবে স্বাধীনতার আগে গ্রামীণ বাংলার মহিলারা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ ও সিস্টার নিবেদিতার হাত ধরে জ্ঞানের আলো জ্বেলেছিল, তেমন ভাবে এই প্রকল্প ডিজিটাল সচেতনতা বাড়ানোয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে নবজাগরণ নিয়ে এসেছে। ফলে গ্রামীণ বাংলায় ই-উপার্জনের গ্রাফটা বদলেছে বিভিন্ন সময়ে। গ্রাম বাংলার ৮.৭ শতাংশ মহিলাই সেল্ফ এমপ্লয়েড। যেখানে ০.৯ শতাংশ মহিলা তাঁদের কাজে নিয়মিত মাইনে পান। ইন্টারনেট ব্যবহার করার ফলে গ্রামীণ ভারতের কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আর্থসামাজিক পরিবর্তন এসেছে। পঞ্চম ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভেতে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে। দেখানো হয়েছে এ-রাজ্যে মহিলা ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২৫.৫ শতাংশ। ভারতের ৪৫.৫ শতাংশ মহিলার কাছে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন থাকলেও, তাঁদের দুই তৃতীয়াংশ মহিলা শুধুমাত্র নিজেদের ফোন থেকে এসএমএস পড়তে পারেন। কমবয়সি মহিলাদের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা বেশি, আর একটু বেশি বয়সি মহিলাদের এসএমএস পড়তে না পারার অক্ষমতা।

আরও পড়ুন-আজ আর্মির বিরুদ্ধে জিততেই হবে কিবুদের

নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে
ইন্টারনেটে মহিলাদের ক্ষমতায়ন হয় ঠিকই। কিন্তু সে ইন্টারনেটের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে যে আর্থিক সক্ষমতা দরকার, তা অধিকাংশ সময় এ-দেশের বা এ-রাজ্যের গ্রামীণ মহিলাদের থাকে না। তাই তাকে নির্ভর করতে হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবারের আপন পুরুষের উপর। সরকার বা রাষ্ট্র আর্থিক সহায়তার হাত বাড়ায় না। তবে আমাদের এ-রাজ্যে কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার মেয়েদের এবং মহিলাদের আর্থিক সাবলম্বী করে। কখনও কখনও এই সাবলম্বীতাই তাদের হাত ধরে নিয়ে যায় ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। তারপর গ্রামের এইসব মহিলার স্বপ্নের এক একটা জানালা খুলতে থাকে। উন্মোচন হয় বৈচিত্র্যময় নতুন পৃথিবীর। ইন্টারনেটের এই রঙিন দুনিয়ায় প্রতিমুহূর্তে গ্রামীণ মহিলাদের বলতে হয় ‘কোনি’র মতো ‘ফাইট, ফাইট’। অপেক্ষা করতে হয় জয়ের জন্যে। তখন আর তাদের কাছে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’— এ-কাব্য থাকে না, বাস্তব হয়ে ওঠে। গ্রামের মহিলারা তথ্যের দুনিয়ার সঙ্গে বাস্তবের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটান। তাঁদের কাছে ইন্টারনেট আর বিলাসিতা থাকে না। হয়ে ওঠে বাস্তব, অসম্ভব এক বাস্তব। রাজনীতির রঙ লাগে গ্রামীণ মহিলাদের মনের দুনিয়ায়। দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ পরিচালনায় তাঁরাও হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী। বিশ্ববাংলায় বসে নতুন ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। এ-স্বপ্ন উড়ে চলে দূরে বহুদূরে, এক অসম্ভবের ডিজিটাল দুনিয়ায়। বাঁধা পড়ে অন্তর্জালে। ছিঁড়ে যায় অন্দরমহলের বন্ধন। মন বলতে থাকে ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে’।

Latest article