হঠাৎ চারদিকে গেল গেল রবের মাঝে স্মৃতিগুলো সব ঝলসে ওঠে। নিমেষে চাঙ্গা হয়ে যারা বড় বড় বুকনিতে গগন ফাটাচ্ছে, তাদের জমানার কুকীর্তির বৃত্তান্ত অফুরান হয়ে ধরা দেয় মস্তিষ্কের কোষে। তেমনই কিছু কর্দম-স্মৃতি পাঁক ঘেঁটে বের করে আনলেন প্রবীর ঘোষাল
বিশ শতকের আশির দশকে ‘বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি’ রাজ্য জুড়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। জ্যোতি বসু তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কীর্তিমান পুত্র চন্দন বসু ক্ষমতার অলিন্দে রাজ করছেন। মার্কসবাদী নেতার কোটিপতি পুত্র বেঙ্গল ল্যাম্প কোম্পানিকে অর্ডার পাইয়ে দিতে সরাসরি সুপারিশ করেছিলেন তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তীকে। সেই সুপারিশপত্রটি মিডিয়ায় পাঁস হতেই হইচই শুরু হয়। জ্যোতিবাবুর ভাবমূর্তি মলিন হচ্ছে দেখে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব বেজায় চটে যায় আরএসপির ওপর। বামফ্রন্টের এই শরিক দলের নেতা ছিলেন যতীনবাবু। রাজ্যে বাম আন্দোলনের এক প্রথম সারির নেতা হিসাবেই সকলে তাঁকে চিনতেন।
আরও পড়ুন-তিন মহিলার ফাঁসি
সিপিএম পার্টি জানায়, পূর্তমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে বলতে হবে, ‘খবরটি মিথ্যা’। আরএসপির সেই সময়ের রাজ্য সম্পাদক মাখন পাল শত চেষ্টা করেও যতীনবাবু ওরফে ‘জ্যাকিদা’কে বাগে আনতে পারেননি। অর্থাৎ তিনি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বেড়ালতপস্বীদের কাছে মাথা নত করেননি। পরিণতি হল, যতীনবাবু শুধুমাত্র মন্ত্রিত্ব খোয়ালেন না, তাঁকে আরএসপি দল থেকেও তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্রেফ জ্যোতিবাবু এবং সিপিএমকে খুশি করার জন্যই বামফ্রন্টের শরিক দলটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারির পর শাসক শরিকরা বুঝে যায়, দুর্নীতির প্রশ্নে সিপিএমকে ঘাঁটালে এই পরিণতি সবারই হবে। বলা বাহুল্য, সেই থেকে চন্দন বসু অ্যান্ড কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গে সবথেকে ক্ষমতাশালী ‘অপারেটর’ হিসাবে পরিচিত হয়ে যায়। চন্দনের ল্যাজে পা পড়ে, এমন কোনও কাজ করার ক্ষমতা তখন থেকেই কোনও মন্ত্রী-নেতার ছিল না। সবাই ভয়ে কুঁকড়ে যান। কিন্তু একজন কমিউনিস্ট নেতা ‘বিদ্রোহ’ করে দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
আরও পড়ুন-ঘুমের ওষুধ
এই মানুষটিকে আদর্শবান বামপন্থী কর্মী-সমর্থকরা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। নৃপেন চক্রবর্তী। ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, এটাই তাঁর পরিচয় নয়। দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি। বাংলা এবং ত্রিপুরায় পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। একসময় এ-রাজ্যের কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য সম্পাদকও ছিলেন নৃপেনবাবু। হাওড়া জুট মিলে শ্রমিকের কাজ করার সময়, হাতের একটি আঙুল কেটে বাদ চলে যায়। সেই নৃপেনবাবু পার্টিতে প্রশ্ন তুলেছিলেন, চন্দন বসু ধনকুবের হয়ে উঠেছে, কোন জাদুবলে? তিনি কী উপায়ে কোটি কোটি টাকা রোজগার করছেন? সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য পার্টিতে এই প্রশ্ন তোলার পর জ্যোতিবাবুর রোষে পড়েন। প্রথমে পলিটব্যুরো, পরে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তাঁকে সরানো হয়। তাতেও নৃপেনবাবু দমছেন না দেখে পার্টি তাঁকে তাড়িয়েই ছাড়ে। পশ্চিমবঙ্গে তখন দুর্নীতির অভিযোগে সিপিএম কােণঠাসা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগরতলায় চলে গেলেন। ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাসী’ নৃপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন। ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সেদিন অগ্নিকন্যাকে দেখিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মমতাই আমাদের পথ দেখাবে!’
আরও পড়ুন-চলচ্চিত্রে বিদ্যাসাগর
শিক্ষাক্ষেত্রে বাম জমানায় দুর্নীতি বলতে গেলে মহাভারত রচনা হয়ে যাবে। স্কুল এবং কলেজের শিক্ষক নিয়োগের চিঠি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হাতে পেতেন ঠিক দুর্গাপুজোর পঞ্চমীর দিন। কেন বলুন তো? নিয়োগপত্র হাতে পেয়েই প্রার্থীরা সেদিনই স্কুলে বা কলেজে চাকরিতে যোগ দিতেন। পরেরদিন থেকে তো একমাস পুজোর ছুটি। চাকরি প্রার্থীর একমাস চাকরি হয়ে গেল। পুজোর ছুটিতে হাইকোর্ট বন্ধ থাকে। কেউ মামলা করার আগেই নিয়োগপত্র হাতে পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকারা একমাসের মাইনে নিয়ে চাকরি পাকা করে ফেলতেন। নিয়োগপত্র পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নামের তালিকা সিপিএমের জেলা নেতৃত্ব তৈরি করতেন। সেটা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হয়ে চলে যেত শিক্ষা দফতরে।
আরও পড়ুন-দুয়ারে প্রশাসন মুশকিল আসান জেলাশাসক
সিপিএম পার্টি ক্যাডারদের শিক্ষা দফতর চাকরির আর একটা অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করত। ‘অর্গানাইজ স্কুল’ নাম দিয়ে বিভিন্ন এলাকার স্কুল তৈরি করত পার্টির লোকজন। তিন-চার বছর পর সেইসব সংস্থা সরকারের কাছে স্কুলের অনুমোদন চাইত। অনুমোদন পেয়েও যেত। প্রতিটি স্কুলে এইভাবে চার-পাঁচ জন করে সিপিএম ক্যাডার সরকারি চাকরি বাগিয়ে নিত। নিয়োগে এইরকম নির্লজ্জ পার্টিবাজি এবং হরেক বেনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী শম্ভুচরণ ঘোষ। সিপিএমের কোপে পড়ে তাঁর মন্ত্রিত্ব গিয়েছিল। বামফ্রন্টের মেজো শরিফ ফরওয়ার্ড ব্লকের হাত থেকেই উচ্চশিক্ষা দফতর কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন-শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে পদক্ষেপ, বৈঠক ডাকলেন ব্রাত্য
বাম জমানার সততার পুজারিদের এরকম কত কাহিনি যে লুকিয়ে আছে তা বলবার নয়। আর একটা কীর্তি বলে লেখা শেষ করব। লোহাচুর কেলেঙ্কারির কথা মনে পড়ছে? ৩০০ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। চিনের বেজিংয়ে অলিম্পিক গেমস হবে। পশ্চিমবঙ্গ পেল লোহার গুঁড়ো সরবরাহ করার ৩০০ কোটি টাকার অর্ডার। রাজ্য সিপিএমের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার দুই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আর ছিলেন পাঞ্জাবের এক পার্টি নেতার পুত্র এই কাজের ঠিকাদার। যদিও সরবরাহের দায়িত্ব বর্তেছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের অধীনে থাকা খাদ্য ও অত্যাবশ্যক পণ্য সরবরাহ দফতরের ওপর। মন্ত্রী নরেন দে। ৩০০ কোটি টাকার লোহাচুরবাহী জাহাজ সমুদ্রপথে চিনে রওনা হয়। মাঝসমুদ্রে সেই জাহাজের ডুবে যাওয়ার রহস্যের কিনারা আজও হয়নি। সিবিআই তদন্তে নেমেছিল। মন্ত্রী নরেনবাবুকে তারা জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই!
বাম জমানার মহানায়কদের কীর্তি-কাহিনি বিস্তারিত লিখতে হলে মহাভারতের চেয়েও বিরাট আকার ধারণ করবে সেটা।