সম্প্রীতি সংহতির বিনাশকারী জমানা

গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বহুত্ববাদের সৌধগুলো এক এক করে ভাঙছে ওরা। সংহতি দিবসের ভাবনায় সেই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন ড. মইনুল হাসান

Must read

৬ ডিসেম্বর। ভারতের ইতিহাসে, ভারতীয়দের জীবনে এক কালো দিন। ১৯৯২ সালের এক বিষণ্ণ ঠান্ডা দুপুরের পর এক শ্রেণির হিংস্র মানুষের শাবল, গাঁইতির আঘাতে ভেঙে পড়ল চারশো বছরের পুরাতন মসজিদ, বাবরি মসজিদ। কারা যেন বিশ্বাস করেছে সেখানে মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়েছে। এই বিশ্বাসের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। ভারতের মতো একটা গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী দেশে এমন জোরজবরদস্তি অসহনীয় অপরাধ। আর বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি সংক্রান্ত মামলা চলছে তখন। হিন্দুত্ববাদীরা ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আইন হাতে তুলে নিলেন। কল্যাণ সিং পরিচালিত সরকার বাধা দিলেন না, বরং সহযোগিতা করলেন, আদালতের নির্দেশ মানলেন না। প্রধানমন্ত্রী ঘুমাতে গেলেন। গুন্ডামির জয় হয়ে গেল। আইনের প্রতি সরকারি ভাবে এমন অশ্রদ্ধা স্বাধীন ভারতে বিরলতম ঘটনা।

আরও পড়ুন-মহানায়ককে শ্রদ্ধা নায়কের, লগ্নি করুন বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পে

সেদিন ভারতে কী ঘটেছিল? একটি প্রাচীন সৌধ বা একটা প্রচীন মসজিদ, যেখানে ১৯৪৯ সালের পর মুসলিমরা নামাজ পড়েনি— সেটা ভেঙে পড়েছিল? না, মোটেই তা নয়। সেদিন ভারতের গণতান্ত্রিক, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত মানুষের হৃদয় ভেঙ গিয়েছিল। সেদিন ভারতের বহু সযত্নে গড়ে তোলা গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের সৌধগুলি মড়মড় করে ভেঙে পড়েছিল। সারা পৃথিবীর কাছে ভারতের মাথা অবনত হয়ে গিয়েছিল। সারা পৃথিবী দেখেছিল ভারতে এখনও পঞ্চদশ শতাব্দীর পৈশাচিক ঘটনাগুলি কেমন ভাবে ঘটে চলেছে। এত বড় আঘাত আমাদের সংবিধানের উপর কোনওদিন আসেনি। সুতরাং বাবরি মসজিদ ভেঙে পড়া একটা নিছক সাধারণ বিষয় নয়। কোনও ধর্ম সম্প্রদায়ের ব্যাপার নয়। সমগ্র ভারতবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকারবোধের ব্যাপার।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

১৯৫০ সালে গৃহীত সংবিধান প্রত্যেক ভারতবাসীর ধর্ম পালন করার, নিজধর্ম প্রচার করার, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যের ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসের উপর আঘাত করা রহিত করে দিয়েছে। বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত মামলার ফয়সালা করে দিয়েছে উচ্চ আদালত। যখন রায় ঘোষণা হবে হবে পর্যায়ে ছিল তখনই সব ধর্মের প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে মুসলমান জনগণ ও সংগঠনগুলি বলে দিয়েছিল আদালতের রায় তাঁরা মেনে নেবেন। আদালতের রায় মুসলমানদের পক্ষে তথা বাবরি মসজিদ নিয়ে যাঁরা মামলা করেছিলেন তাঁদের পক্ষে যায়নি। কিন্তু তাঁরা রায় মেনে নিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলি যে, আমি ব্যথা পেয়েছি। কিন্তু মেনে নিয়েছি।

আরও পড়ুন-কার্শিয়াঙে আজ মুখ্যমন্ত্রী

একথাগুলো বলছি কেন? উচ্চ আদালতের পুরো রায়ের পাতার পর পাতা যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব বাবরি মসজিদের পক্ষে যাঁরা মামলা লড়ছিলেন তাঁদের যুক্তি আদালত মেনে নিয়েছেন। তাছাড়া বেশির ভাগ প্রত্নতত্ত্ববিদ যে মতামত দিয়েছেন তা আদালত মেনে নিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রায় দিয়েছেন ‘বিশ্বাসের’ উপর নির্ভর করে। একাংশের হিন্দুরা বিশ্বাস করে রাম এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এটা রামের জন্মভূমি। সুতরাং রায় চলে গেল যাঁরা রামজন্মভূমি নিয়ে মামলা করেছিলেন তাঁদের পক্ষে। বোধ হয় ভারতে এই প্রথম ‘বিশ্বাস’ ভিত্তিক রায় দিল উচ্চ আদালত। সমগ্র পর্যবেক্ষণ ছিল বাবরি মসজিদের পক্ষে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রায় গেল রাম জন্মভূমির দিকে। উচ্চ আদালত বা সম্মানীয় বিচারপতিদের আমি কোনও সমালোচনা করছি না। কিন্তু তাঁদের দেওয়া রায় সমালোচনা ঊর্ধ্বে নয়। ভারতের সংবিধানের সম্মান এবং নির্দেশ রক্ষা করতে বা মান্যতা দিতে উচ্চ আদালত কেন? আমরা সবাই ব্যর্থ হয়েছি। তবে হিন্দুত্ববাদী, মুসলমান সংগঠন, হিন্দু, মুসলমান তথা ভারতবাসী একটা ব্যাপারে সামান্য পরিপক্কতা তথা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে, তা হল— রায় সবাই মেনে নিয়েছে। সারা ভারতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েনি। রক্ত ঝরেনি।

আরও পড়ুন-বানভাসি চেন্নাইয়ে নৌকা নামিয়ে উদ্ধার করতে হল আমির খানকে

কিন্তু আমরা যেন কেউ মনে না করি যে, সমস্যার সমাধান হয়ে হয়নি। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে এই ধারণা হয়েছে যে, বিশ্বাস এবং সংখ্যা থাকলে যে কোনও গর্হিত কাজ করা যায়! না, যায় না। সেই কারণে ৬ অগাস্টকে সংহতি দিবস হিসাবে আমরা পালন করছি। গণতন্ত্র বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও হিসাবে পালন করছি। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে যেমন সত্যি, সংবিধান ধ্বংস হতে যাচ্ছে সেটাও তেমন সত্যি ঘটনা।
যাঁরা বাবরি মসজিদ ভাঙার মতো জঘন্য কাজে যুক্ত ছিলেন তাঁরা আজ কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন। সুতরাং কেউ এই বাহিনীর কাছে সুশাসন আশা করতে পারে না। দেশের মানুষের আর্থিক উন্নয়ন নেই বললেই চলে। দারিদ্র, বেকারির মাত্রা সীমাহীনভাবে গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে পুরাণ গল্পকথাকে ইতিহাস বলে মেনে নেওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি চলছে, পাঠক্রম পালটানো হচ্ছে। স্কুল-কলেজে ভুল ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আর একটা কুৎসিত ঘটনা হচ্ছে, স্থাননাম পালটানো। শত শত জায়গার নাম পালটে ফেলা হচ্ছে। মুঘলসরাই, এলাহাবাদ, ফৈজাবাদ, ঔরঙ্গাবাদ-সহ কয়েকশো নাম পালটে গিয়েছে। এর পিছনে কোনও সুস্থ মস্তিষ্ক বা ইতিহাসবোধ কাজ করছে না। কাজ করছে সংখ্যা ও জোরজবরদস্তি। আলিগড়ের নাম এখন পালটানো হবে। ইতিহাস পালটে দেওয়ার এই অনৈতিহাসিক কাজ ফ্যাসিবাদীরা বহু বহু বছর ধরে পৃথিবীতে করে আসছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জয়ী হয়নি। জয়ী হয়েছে মানুষ। এদেশেও তাই হবে। সময়ের অপেক্ষা।

আরও পড়ুন-তেলেঙ্গানার নয়া মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন রেবন্ত রেড্ডি

৬ ডিসেম্বর প্রতিবছর আসে। আসতে থাকবে। এই দিনে আমাদের আত্মসমীক্ষা করতে হবে। সংহতি ও গণতন্ত্রের প্রতি, বহুবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আমাদের আবেগ ও ভালবাসা প্রকাশ করতে হবে। আমাদের পার্টি সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস ও তার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সংহতি দিবস পালনের আহ্বান করেছেন। আসুন, রাস্তায় নামি, জয়হিন্দ।

Latest article