একেই বলে রসখ্যাপা। আবার গুড় সেবকও বলা যায়। খেজুরের রস আর গুড়ের জন্য যাদের এই মরণপণ— এই আকুতি দেশ- গাঁও ছেড়ে রস তুলতে পরবাসী তাদের আর কীই-বা বলা যায়! যে রসের গুণে রবীন্দ্রভারতীর শ্রেয়সী থেকে সিটি কলেজের রাজ্জোও পাগল। ওর আসল নাম অবশ্যই রাজ্জো নয়। রাজিয়া আদতে বাঁকুড়ার মেয়ে। পড়াশোনার সূত্রে আপাতত কলকাতায়। কিন্তু এরা দু’জনেই রসখ্যাপা। মানে শীতের সময় খেজুর রসের জন্য পাগল আর কী। শুধু এরা কেন আমি- আপনি শীতের সকালে(ভোরে) এক গ্লাস টাটকা খেজুরের রস হাতে নিজেদের বাদশা ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঘূর্ণাবর্তের কারণে শীতের কাঁপুনি এই মুহূর্তে কম হলে কী হবে!
আরও পড়ুন-আজ ভুবনেশ্বর-যাত্রা ক্লেটনদের, কুয়াদ্রাতকে ছাড়াই প্রস্তুতি ইস্টবেঙ্গলের
প্রতিদিন রাত ৩-৪টেয় খেজুর গাছে যেসব সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানো হয় আর যারা চালায় তাদের জীবন কিন্তু বড্ড কঠিন। আপাতদৃষ্টিতে খেজুর রস আর তাকে ঘিরে অন্যরকম রোমান্টিকতা থাকলেও এই রস তুলে এনে একটা দীর্ঘ পদ্ধতি মেনে জ্বাল দিয়ে গুড় বানিয়ে আমাদের হাতে যাঁরা পৌঁছে দেন তাঁদের কী পরিমাণ পরিশ্রম আর দক্ষতা লাগে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। শুধু কি তাই, এই রস খ্যাপামির সঙ্গে জুড়ে আছে এক বিরাট অর্থনীতিও। গোটা বাংলা জুড়ে রস আর গুড়কে কেন্দ্র করে যে বাজার রয়েছে আর্থিক খতিয়ানে তা নেহাত কম নয়। আর সেই সঙ্গে জুড়ে আছে কর্মসংস্থান। গ্রামবাংলার এক বিরাট অংশের মানুষের এই সময়টা একটা মোটা টাকা রোজগার হয় রস আর গুড় থেকে। তাই অক্টোবর মাসে পুজো- পার্বণ মিটলেই একদল লোক নিজের জেলা- ঘর-পরিবার-পরিজন ছেড়ে অন্য জেলায় পারি জমায় রস তুলতে। কয়েকমাসের জন্য অস্থায়ী ঘর বানায় রসের জেলায়। তারপর ফেব্রুয়ারিতে রসের সিজন মিটলে আবার ফিরে যাওয়া নিজের ঘরে। সেই সঙ্গে রোজগার করে নিয়ে যাওয়া একটা মোটা রেস্ত। যা কাজে আসে বছরের বাকি মাসগুলোতে। কারণ অনেকে বাইরে কাজে গেলেও পুরনো রসখ্যাপারা এখনও পড়ে আছেন এই পেশায়। শুধুই কি পেশা! সেই সঙ্গে নেশাও যে। বছরের বাকি দিনগুলোতে এর-ওর জমিতে জন খেটে কিংবা পুকুর কেটে দু’পয়সা আসে। কিন্তু রসের এই সময়টার জন্য অপেক্ষা থাকে সারা বছর।
আরও পড়ুন-ইনসাফ চাইছেন! বরং মুখ ঢাকুন লজ্জায়
এবার ঝাড়গ্রামের অদূরে বেলপাহাড়িতে দেখা হল সুকুর আলির সঙ্গে। আমরা আপন খেয়ালে বেলপাহাড়ির জঙ্গলে ঢুকেছিলাম। আচমকা আবিষ্কার করি, কাঁধে ইয়া লম্বা বাঁক আর তাতে অজস্র ডিব্বা নিয়ে রোগা এক মানুষ জঙ্গলের পথে দুুলকি চালে চলেছেন। থামিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানা গেল মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাসিন্দা সুকুর মিয়া বংশ পরম্পরায় এই শাল-মহুলের বেলপাহাড়িতে আসেন রস তুলতে। আগে বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে আসতেন ছোটবেলায়। তারপর কখন যে রসের পেশা নেশা লেগেছে তা নিজেও ঠাহর করতে পারেননি সুকুর আলি। দশকের পর দশক ধরে খেজুর গাছে হাঁড়ির সঙ্গে মনও বাঁধা পড়েছে। আর ছাড়াতে পারেননি। তবে সময়ের সঙ্গে এই পেশারও ধরন বদলেছে। আগে হাঁড়িতেই শুধু রস তোলা হত। এখন প্লাস্টিকের ডিব্বা সঙ্গে রাখা হয়।
আরও পড়ুন-কথা হল কবিতায়
গাছ থেকে হাঁড়ি নামিয়ে একসঙ্গে অনেকটা রস সমেত সেই হাঁড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়া যেমন কষ্টসাধ্য তেমন হাঁড়ি ভাঙার ঝুঁকিও রয়েছে। তাই এখন হাঁড়ি থেকে রস তোলা হয় একাধিক ডিব্বায়। এতে সুবিধে হয়। গুড়ের কারবারিরা একসঙ্গে অনেক রস নিয়ে যায় প্রতিদিন। যারা দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী তারা প্রচুর গাছ কিনে রাখে এই সময়টা। ওই সব গাছের সব রস তাদের। গোটা সিজনটা রসের সাপ্লাই যেন ঠিক থাকে তা নিশ্চিত করতে ভিন জেলা থেকে আসে রসখ্যাপারা। অনেক সময়ই এদের আনা, ঘর তৈরি করে দেওয়া, খাওয়ার বন্দোবস্ত করে মহাজনরা। রসখ্যাপাদের দায়িত্ব প্রতিদিন হাঁড়ি ভর্তি রসের জোগান দেওয়া। খেজুর গাছ কাটা। গাছের যত্ন নেওয়া। কোন গাছের রসের মান সব থেকে ভাল তা বুঝে মহাজনকে সেই গাছের রস বেশি করে দিতে হয়। এক-একজনের গুড়ের কারবারির চাহিদা এক একরকমের। এদের পরিবারের মেয়ে -বউরাই মূলত গুড় তৈরি করেন। রস এলে তা থেকে গুড় বানানো এটাই আজীবন করে আসছে গুড় ব্যবসায়ীদের পরিবারের লোকজন। এরাই হল সেই লক্ষ্মী যাদের হাতের গুণে গুড়ের গন্ধে ভেসে যায় গোটা গ্রাম। পথ চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় পথিক। আর হাটে-বাজারে-দোকানে সেই গুড়ের পাটালি পড়লে নিমেষে উড়ে যায়। খরিদ্দাররা ঠিক জানে বাজারে কার দোকানে মন মাতানো সেরা গুড় পাওয়া যায়। যা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হবে পিঠে-পুলি-পায়েস। পরিবারের মুখে হাসি ফুটবে।
আরও পড়ুন-সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা
যে কারণে গুড় ব্যবসায়ীদের অনেকের পরিবারেই বিয়ের সময় জানতে চাওয়া হয় মেয়ে গুড় বানাতে জানে কি না! যদি নাও বা জানে বিয়ের পর স্বামীর ঘরে এসে তা শিখে নিতে হয়। এটাই রেওয়াজ। এক্ষেত্রে অমিতাভ বচ্চনের সেই বিখ্যাত ছবি ‘সওদাগর’ মনে পড়তে বাধ্য, যেখানে অমিতাভ গুড় ব্যবসায়ী। নিজেই গাছ থেকে রস পেরে এনে গুড় বানায়। আর তার গৃহিনী মাজুবিরের হাতের তৈরি গুড়ের সুনাম গোটা গ্রামে। যার জন্যই ফুলে ফেঁপে ওঠে সে। কিন্তু অন্য এক রূপসীর টানে মাজুবিরকে তাড়ানোর পর সে নিজেও ডুবে যায় অন্ধকারে। কারণ তার নতুন বউ রূপে মাত করলেও মাজুবিরের মতো ওইরকম সুন্দর-সুস্বাদু গুড় তৈরি করতে পারে না সে। স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবসা মার খায়। রূপালি পর্দার এই ছবির ঘটনা বাস্তবেও আকছার ঘটে থাকে। গুড় ব্যবসায়ীদের তাই বিয়ের ক্ষেত্রে রূপের চেয়ে দরকার হয় গুণের মেয়ে। যে তার গুড়ের মিঠাস রাখতে পারবে।
আরও পড়ুন-চলতি বছরে সবুজসাথী প্রকল্পে বাড়ছে আরও ৩ লক্ষ, ১৫ লক্ষ সাইকেল দেবে রাজ্য
এই রসখ্যাপা আর আমার ভাষায় গুড় সেবকরা একে অপরের পরিপূরক। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনের চলে না। প্রতিবছর রসখ্যাপারা বিভিন্ন বাঁধা জায়গায় পাড়ি জমায় দল বেঁধে। রসের মরশুম ফুরোলে টাকা গেঁজে ভরে ফিরে যায় নিজের গ্রামে। তখন তাদের পায় কে। এক-একজন রসখ্যাপা এই চার-পাঁচ মাসে লক্ষাধিক টাকার ওপর রোজগার করে। তবে তুলনায় পেশায় নতুনদের রোজগার একটু কম। এই পেশার জহুরি সে-ই, যে খেজুর গাছের জাত চেনে। গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে বলে দিতে পারা সেই গাছের রসের গুণমান বা কতটা রস হতে পারে। নতুনদের গাছের এই নাড়ি বুঝতে সময় লাগে। তবে এখন এই সুপারফাস্ট রিল দুনিয়ায় নতুন প্রজন্ম আর খুব একটা আগ্রহী হচ্ছে না রসখ্যাপামিতে। তাদের চোখে নতুন স্বপ্ন। তবে এই রসের পেশা ছিল, আছে, থাকবেও। যতদিন মানব জীবন থাকবে, ততদিন রসবোধ আর রসখ্যাপামিও থাকবে। আর বাংলার গ্রামে গ্রামে জন্মাবে সুকুর আলিরা। যারা জঙ্গলের পথে বাঁক নিয়ে পাড়ি জমাবে রস তুলতে।