চড়িভাতি থেকে পিকনিক মাঝে ভগ্ন সেতু

চড়িভাতি থেকে বনভোজন হয়ে পিকনিকে আসার মাঝখানে একটা সেতু ছিল। সেটিই ছিল সেকাল আর একালের পিকনিক-বনভোজনের চরিত্র-রক্ষক। এখন দেখা যাচ্ছে সেতুটি ক্রমেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেঙে পড়ছে। এই শীতকালীন উৎসবটি থেকে পাওয়া মূল প্রাপ্তি ও তৃপ্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। লিখলেন লীনা চাকী

Must read

মায়েদের সেদিন কুলুই চণ্ডী ব্রত ছিল। মা অর্থাৎ দুর্গা, অপুর মা সর্বজয়া। এই ব্রতের নিয়ম হল বাড়ি থেকে দূরে কোনও নিরিবিলি জায়গায় গ্রামের এয়োরা জড়ো হয়ে বনভোজন করবেন। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী বাড়ি থেকে চাল-ডাল-দুধ ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে সেখানে সবাই মিলে রান্না করে খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরবেন। ব্রতকথার বইতে দেখছি কুলুই চণ্ডী ব্রত পালনে এই বনভোজন ব্যাপারটা নেই। তবে ছিল তো নিশ্চয়ই। আমি বুঝি না যাঁরা বাড়িতে সারা বচ্ছর হেঁশেলে কাটাতেন, তাঁদের কুলুই চণ্ডী কেন মাঠে রান্নাই করতে পাঠাতেন! নাকি তিনি তাঁদের বনভোজনের আনন্দ উপভোগ করার কিঞ্চিৎ সুযোগ দিতেন? ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গা তো মায়ের সঙ্গে যেতে পারবে না, ওখানে সন্তানদের যাওয়া বারণ। মা চলে যেতেই দুর্গা বনভোজনের প্ল্যান করে ফেলেছে। তারপর তো তাদের দু’ভাইবোন ও পরে জুটে যাওয়া বিনির সার্থক বনভোজন। তারা ‘কোষো মেটে আলুর ফল ভাতে ও পানসে আধপোড়া বেগুন-ভাজা দিয়া চড়ুইভাতির ভাত খাইতে বসিল।’ তাদের ‘ধূলার ভাত, খাপরার আলুভাজা, কাঁঠাল পাতার লুচি’ দিয়ে মিছিমিছি বনভোজন নয়। ওরা পুলকিত। প্রাণে খুশির তুফান। বড় যত্ন নিয়ে বিভূতিভূষণ তাঁর মহান সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’তে ‘বনভোজন’ নামটির যথার্থতা বুঝিয়ে রেখে গেছেন। চড়ুইভাতি বা বনভোজন আসলে কেমন ছিল, যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য, আর যাঁরা জানেন তাঁদের স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য ওই বইয়ের চারটি পাতাই যথেষ্ট।

আরও পড়ুন-নতুন বইয়ের গন্ধ

শৈশব, কৈশোর যাঁদের গ্রামে কেটেছে তাঁরা জানেন বনভোজনের মজা। বনভোজনের মানে তো কোনও নিরিবিলি জঙ্গুলে জায়গায় গিয়ে বন্ধুরা মিলে রান্না করে খাওয়া। কিন্তু চড়িভাতি মানে কী! ব্যাপারটা তো একই! হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ তার কিছুটা ইঙ্গিত দেওয়া আছে। রান্নার জন্য পাত্রে করে উনুনে কিছু চড়ান। ‘চড়ানো’ রান্নাঘরে ব্যবহৃত মহিলাদের তৈরি করা কথ্য শব্দ। ভাত চড়িয়ে দে, ডালের কড়াই চাপাও,— এইরকম আর কী। সম্ভবত রান্নাযুক্ত এই শব্দটিই হেঁশেল থেকে মুক্ত হয়ে বনভোজনের আরেক নাম চড়িভাতি বা চড়ুইভাতি হয়ে উঠেছে। এ আমার আন্দাজি কথা, ভাষাবিদরা কী বলবেন জানি না।

আরও পড়ুন-পারলে দশ পয়সার লেনদেন প্রমাণ করুক

সে যাই হোক, চড়ুইভাতি করার মধ্যে ছোটরা একটা বিরাট সাফল্য খুঁজে পেত। মায়েরা নিত্যদিন যে হেঁশেলে কত কী রাঁধেন, এটা ছিল তাদের কাছে অচেনা জগতের ব্যাপার। বিস্ময়েরও। কী করে তৈরি হয় ডাল, কী করেই বা সবজিসকল হয়ে ওঠে ভাজাভুজি, তরকারি? বালিকাদের এ ব্যাপারে নিশ্চয় বড়ই কৌতূহল ছিল। তার ওপরে ওই ঘরটি থাকে শুধু মা, ঠাকুমা, পিসিমাদের দখলে। আমরাও রান্না করতে পারি, নির্ঘাৎ এমন একটা বাসনা থেকেই তাদের বনভোজনের ইচ্ছা জেগে ওঠা। সেটা যে কতকাল আগে থেকে ঘটতে শুরু করেছিল, তা কে বা বলতে পারবেন। তবে চড়ুইভাতি আর বনভোজন শব্দদুটি ব্যবহার করায় কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। ‘অ্যাই, চড়ুইভাতি চড়ুইভাতি খেলবি?, বা চ’ আমরা বেশ চড়ুইভাতি করব।’— এর মধ্যে একেবারে ছোটদের খেয়ালখুশির খেলার খোঁজ পাওয়া যায়। চড়ুইভাতি, সে মিছিমিছিই হোক, আর সত্যিকারের খাদ্যদ্রব্য নিয়েই হোক, আদতে অপক্ক খুদেদের কাছে চড়ুইভাতি একটা খেলা ছিল। পুতুলের বিয়ে দেওয়ার মতো একটা খেলা। এই খুদেরা হত মূলত মেয়েরা, যারা আর ক’বছর পরেই বদ্ধ হেঁশেলে ঢুকবে। তিন-চারজন জুটে গেলেই চড়ুইভাতির টিম তৈরি হয়ে যেত। বনভোজন একটু সিরিয়াস। তারাই এই শব্দটি ব্যবহার করত যারা গ্রাম ছেড়ে একটু দূরে একটু জঙ্গলমতো জায়গায় গিয়ে রেঁধেবেড়ে খেত। প্রায় সারাদিনের ব্যাপার। ‘শোন, কাল ইস্কুল ছুটি, চ’ আমরা বনভোজন করি।’ কে কী আনবে প্ল্যান হয়ে যেত। এটা ছিল শুধু ছেলেদের জন্য। কিশোর, যুবকরা বনভোজনে যেতে পারত, মেয়েরা তো মেয়েই, তাই বনভোজন তাদের জন্য ছিল না।

আরও পড়ুন-একাধিক দাবিতে বিজেপি সাংসদ-বিধায়কের বাড়ির সামনে ধরনা-বিক্ষোভ

একটা ভাঙা মাটির হাঁড়ির অবশিষ্টাংশ হত রান্নার পাত্র। গাছের পাতা, ছোট ছোট মাটির টুকরো, ধুলো ইত্যাদি রান্নার সামগ্রী। তিনটে ঢেলা দিয়ে উনুন। ব্যস। মিছিমিছি চড়ুইভাতিতে মিছিমিছি খাওয়া। এ খেলায় আনন্দে, তৃপ্তিতে কোনও খাদ থাকত না। দেশের বাড়িতে গেলে আমরাও এই চড়ুইভাতি করতাম। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকত না, যেন সত্যিই ভাতের সঙ্গে মাছের ঝোল মেখে খাচ্ছি।
সত্যিকারের চড়ুইভাতিতে রান্নার উপকরণ লাগত। তিন-চার বা পাঁচজন জুটে গেলেই হল। কে বাড়ি থেকে মাকে বলেকয়ে বা না বলে ভাঁড়ার থেকে লুকিয়ে কী আনতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা সারা হল। তবে লুকিয়ে চুরিয়ে আনার মধ্যে বেশ একটা রোমাঞ্চ থাকত। কেউ আনল এক পলা তেল, কেউ নুন, কেউ ডাল। চালটা সবাই এক মুঠি করে নিয়ে আসত, কারণ ওটি তো প্রধান। দুটো আলুও কেউ সরিয়ে এনেছে। গ্রামে সবজির অভাব নেই। পৌষের সবজি অনেক। চাইলেই মাঠ থেকে পটাপট বেগুন, শিম, কপি তুলে নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু এদের চড়ুইভাতিতে অত কিছু জরুরি নয়, হবে হয়তো চালে-ডালে মিশিয়ে খিচুড়ি, তারমধ্যে ফেলে দেওয়া হবে আলু। বা ভাতের সঙ্গে ডাল আর আলু সিদ্ধ। শুকনো পাতাপুতি জড়ো করে আগুনের ব্যবস্থা হল। মাটির হাঁড়িটি কেউ জোগাড় করেছে। সম্মিলিত প্রয়াসে যা হল তাই তারা তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে নিল। ভাতটা তেমন সিদ্ধ হয়নি, ডালগুলো তাকিয়ে আছে ইত্যাদি বলেটলে প্রতিজ্ঞা করা হল, পরেরবার এগুলো শুধরে নেওয়া হবে। মূলকথা, নিজেরা রেঁধে খাওয়ার মজাটা তো পাওয়া হল। মনে আছে, আমাদের দেশের বাড়িতে শীতের সময় গেলেই চড়ুইভাতি করতাম। বাড়ি থেকে একটু তফাতে আঁটির আমগাছতলাটাই নির্দিষ্ট থাকত। রান্নার ভার থাকত মেজদি আর মনাদির ওপরে। প্রতিবার একই আইটেম। খিচুড়ি, সঙ্গে বেগুন পোড়া আর কিছু একটা তরকারি। আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ, শুধু হুকুম খাটা ছাড়া আর কোনও কাজে লাগতাম না।

আরও পড়ুন-আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে চলছে ধস

মাসতুতো দাদারা কলাপাতা কেটে আনত, উনুন বানানো, কাঠকুটো আনা ছিল তাদের কাজ। শীতের রোদ গায়ে মেখে অসমান মাটিতে বসে কলাপাতায় করে খেতাম। খিচুড়ির চাল-ডাল মোটে মিলেমিশে যেত না। তরকারিতে হয়তো নুন বেশি, নয়তো আলুনি। তবুও একেবারে লা-জবাব রান্না মনে হত।
বনভোজনের ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। শৈশব ছাড়িয়ে যে ছেলেরা গোঁফের রেখা নিয়ে কৈশোরে পা দিয়েছে, বা আর একটু এগিয়ে যুবকটি হয়ে উঠেছে, তারা হয় এই বনভোজনের উদ্যোক্তা। জনাদশেক হলেই হল। দিন ঠিক হল। কিছুটা মত-অমতের পরে জায়গা ঠিক হল। দূরের আমবাগান, তালবাগান বা নিরিবিলি নদীর ধার। কে কেমন টাকা জোগাড় করতে পারবে জেনে নেওয়া হল। যার যেমন সাধ্য দিত, এটা নিয়ে মন কষাকষি হত না। সময়টা এত প্যাঁচালো ছিল না তো। বাজার করা, উনুন গড়া, জায়গাটা সাফসুতরো করার পর রান্না শুরু হল। এই কাজটিতে বিশেষ কেউ পাকা হত। মানে বনভোজনে রেঁধে রেঁধেই সে হাত পাকিয়েছে। ভাত-ডাল-খাসির মাংস-চাটনি— এটাই কমন আইটেম। হইহুল্লোড়, গান, তুমুল আড্ডা। কারও পিছনে লাগা। সময় গড়িয়ে যেত। রান্না শেষ। কোমরে গামছা বেঁধে যে দু’জন পরিবেশন করছে, তারাও বসে গেল। বাসনকোসন ধুয়ে এরপর ঘরে ফেরা।

আরও পড়ুন-জেলবন্দি অপরাধীদের সেনায় যোগ দিতে নির্দেশ পুতিনের

বনভোজন শীতকালীন উৎসব বটে, কিন্তু তারা যদি কারও বাড়ির মুরগি বা পাঁঠা চুরি করে ফেলতে পারে, তাহলে সে বনভোজন যখন তখন হতে পারে। গ্রামে এমনটা ঘটত। এরজন্য চলে যেতে হত দূরে, যাতে কাকপক্ষীটি জানতে না পারে। এ-ও এক রোমহর্ষক বনভোজন।
বনভোজন দু’ভাবে করা হত। একটা তো বললাম। আরেকটা হল রান্না করা খাবার নিয়ে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করা। তারজন্য তারা যাবে নদী, মাঠ, বসতি পার হয়ে অনেকটাই দূরে। সঙ্গে মায়েদের রান্না করে দেওয়া ভাত-মাছ-মাংস। আমি এরমধ্যেই বিভূতি নামের একজনের ব্লগে তাঁর ছোটবেলার চড়ুইভাতি পড়লাম। ১০/১২ জন বন্ধু মিলে তাঁদের গ্রাম শিবপুর কাটাখালি থেকে বড় নৌকা নিয়ে গিয়েছিলেন বিলের মাঝে বহু দূরে হোগলা বনে। নিতান্তই বালক, তাই রান্না করা খাবার নিয়েছিলেন। সেই হোগলা বনে মাঝিসহ সারারাত ছিলেন। ওটাই ছিল তাঁদের বনভোজন। এমনটাই ডাকাবুকো ছিল তখনকার বনভোজনকরিয়েরা।

আরও পড়ুন-সনাতন ধর্মই দেশের রাষ্ট্রধর্ম, বিতর্কিত মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রী যোগীর

চড়ুইভাতির বালখিল্যপনা গ্রামের ছোট্ট গণ্ডির বাইরে আসেনি। বনভোজন নামটিও গ্রাম ছাড়িয়ে শহরে আসতে পারেনি তার স্থানিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। শহর গড়ে উঠলে বন পাবে কোথায়! তবে শহর থেকে দূরে গিয়ে খাঁটি বনভোজন করার চল ছিল। তার খবর দেওয়ার জন্য আছে সাহিত্য। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সে খবর দিয়ে গেছেন ‘বনভোজনের ব্যাপার’-এ। টেনিদা তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বাগুইহাটি ছাড়িয়ে চলে গেছেন দূরে একেবারে বনভোজনের উপযুক্ত জায়গায়। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ রাজরাপ্পা নামে এক রহস্যময় জায়গায় পিকনিক করতে যাওয়ার কথা পেয়েছি। আমার দাদা তার বন্ধুদের সঙ্গে বনভোজন নাম সার্থক করতেই সোদপুর, চন্দননগরের দিকে যেত। কিন্তু কাউকে বলতে শুনতাম না যে বনভোজনে যাচ্ছি। বলত, ‘‘ফিস্ট করতে যাচ্ছি’’। বঙ্গীয় নামটি কেন যেন পালটে গেল। সুজির আরেক নাম হালুয়ার মতো নাম হল তার ফিস্ট। ইংরেজি fiest-এর বাংলা অর্থ ছুটির দিন! আমরা ছোটবেলায় ফিস্ট শব্দটি ও তার ভূমিকা জানতে জানতে বড় হচ্ছিলাম। শীত পড়তেই ‘‘সামনের রোববার আমাদের ফিস্ট আছে’’,‘‘আমরা ফিস্ট করতে যাচ্ছি’’, এমনটা বলত সবাই।

আরও পড়ুন-আটকে রাখতেই তৈরি অসমে ট্রানজিট ক্যাম্প

একটা ছুটির দিন কোনও বন্ধুর বাড়ির ছাদে, বাগানে, নয়তো বাড়িলাগোয়া মাঠে হত আমাদের, মানে মেয়েদের ফিস্ট। ওই একইভাবে রান্নার জোগাড় করা, রাঁধা, খাওয়া। এরমধ্যে কোনও রোমাঞ্চ থাকত নাকো। অবশ্যই আনন্দ হত। নিজেদের স্বাধীন মনে হত। তবুও সেই ঘন আনন্দ, উত্তেজনা থাকত না। ছেলেরা যেত ফিস্টে। বাগনান, বারাসত, মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত। ট্রেনে আসা-যাওয়া। দল যত বড়ই হোক বাস-লরি ভাড়া করার কথা কারও মনেই আসত না। গন্তব্যস্থানে বন্ধুদের কারও আত্মীয়টাত্মীয় থাকলে নিশ্চিন্ত। বন্ধুটি আগেরদিন গিয়ে সব ব্যবস্থা করে রাখত। এভাবেই চলল অনেকদিন। তারপর প্রবেশ ঘটল ‘পিকনিক’-এর। শব্দটি অতীতে ছিল সাহেবদের কাছে। ‘ফিস্ট’ অপসারিত হল।
সাহেবরা এদেশে রাজত্ব করতে এসে তাদের আমোদ-তালিকায় যুক্ত করেছিলেন ‘পিকনিক’কে। এই পিকনিক ব্যাপারটিকে তাঁরা নানাভাবে উপভোগ করতেন। এক, বাস্কেট ভর্তি খাবারদাবার নিয়ে কোনও পাহাড়তলি, জঙ্গলঘেঁষা জায়গায় গিয়ে খাওয়া, জিন-শেরি-শ্যাম্পেন পান, খেলা, শিকার ইত্যাদি তাঁদের তালিকায় থাকত। সঙ্গে গুচ্ছের হুকুমখাটা লোক। দ্বিতীয়টি, বাবুর্চিদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেখানে নানা সাহেবি পদ রান্না করা। এই পিকনিক-কালচারটি তাঁরা নিজেদের দেশ থেকেই নিয়ে এসেছিলেন। এখানে একটু নব্য শিক্ষায় আলোকিত কেতার মানুষদের মধ্যে প্রথমটি ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। টিফিন কেরিয়ারে খাবার গুছিয়ে নিয়ে তাঁরা নিরিবিলি কোনও জায়গায় বা কারও বাগানবাড়িতে চলে যেতেন। রান্নার হ্যাপা তাঁরা নিতেন না, পরিবেশন করার লোকটিও উপস্থিত থাকতেন। এটি আসলে আউটিং। পিকনিক কী করে হবে! সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘শাখাপ্রশাখা’-য় আমরা তেমনটি দেখেছি। লীলা মজুমদার ও কমলা চট্টোপাধ্যায়ের ‘রান্নার বই’তেও এমনধারা পিকনিকের খাবারদাবারের তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেটিও আসলে আউটিং, যার সঙ্গে বনভোজনপ্রিয় বাঙালির কোনও সখ্য গড়ে ওঠেনি। অরুন্ধতী দেবীর পরিচালনায় ‘ছুটি’তে পারিবারিক পিকনিকের চেহারাটা ধরা আছে। আরও উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফর ঘিরে প্রস্তুতি বৈঠক

পিকনিকই হোক বা বনভোজন, তার আসল মজাটা কোথায়? জায়গা বাছা নিয়ে ঘোরতর আলোচনা করে দুটো দিন কাটিয়ে দেব, নিজেরা বাজার করব, মেনু নিয়ে তর্কাতর্কি করব, কোমরে গামছা বেঁধে নিজেরাই রান্না করব, কলাপাতা কেটে এনে পাত পেড়ে হাপুসহুপুস করে খাব, কে তিনটে রসগোল্লা লুকিয়ে মেরে দিয়েছে সেই নিয়ে চেঁচামেচি—তবেই না পিকনিক। হুটোপাটা, হইহই, গলা ছেড়ে বেসুরো গান, এসব না হলে কীসের পিকনিক। তেমনটাই চলছিল। ক্রমে ক্রমে পিকনিকের মোহন রূপটা কেমন যেন বদলে গেল। অনেক কিছু দরকার হয়ে পড়ল। অনেক কিছু না হলে পিকনিক বৃথা।

আরও পড়ুন-বেশিরভাগ রাজ্যেই কংগ্রেস শূন্য, হাতে ভোট মানে পদ্মে ভোট: অভিষেক

দল বাড়তে লাগল। পাড়ার ক্লাবের পিকনিক, পারিবারিক পিকনিক, ট্রেনের ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের পিকনিক, বৃদ্ধাবাসের সদস্যদের বাইরে নিয়ে গিয়ে পিকনিক, আরও কত স্তরের মানুষের পিকনিক। বাস, লরিতে চেপে সব চলল পিকনিক স্পটে। আবশ্যিক হল রান্নার ঠাকুরের, তাঁদের পাশ কাটিয়ে এল কেটারাররা। মাটিতে থেবড়ে বসে নয়, চেয়ার-টেবিলে খাওয়ার ব্যবস্থা হল। পরিবেশনের দায়িত্বে ওই কেটারাররা। এখন দেখছি, যাঁর বাগানবাড়িতে বা বাগানে পিকনিক করতে যাবেন, তাঁর পছন্দের স্থানীয় কেটারারকে নিতে হবে। বিনয়ের সঙ্গে তিনি সেটা বলে দেন। তা হোক। কিছু যুবক তো শীতের ক’দিন রোজগার করতে পারছে। কিন্তু ১০০ ডেসিবল পার করা ডিজে-র তীব্র নিনাদ?

আরও পড়ুন-শীতে সুস্থ থাকুক ত্বক সঙ্গে মনও

একটাই বড় বাগান। মালিকের বা কেয়ারটেকারের ঘর এক প্রান্তে। ওই বাগানে চারটে পিকনিক পার্টি। চারটে ডিজে বাজছে। সঙ্গে উদ্দাম নৃত্য। তীব্র উল্লাসধ্বনি। দুপুরের পরে দেখা গেল অর্ধেক ঘাড় লটকে বসে আছে। কুকুরে মুখ দিচ্ছে খাবারে। আমরা ছিলাম প্রত্যক্ষদর্শী। যাবতীয় উৎসাহ, আনন্দ উধাও হয়ে গিয়েছিল। এখন তো পিকনিক খুবই বেড়ে গেছে। বারাসত-বাদু-অঞ্চলে এক পারিবারিক পিকনিকে গিয়েছিলাম। এখন সে-অঞ্চলে বহুদিন আগে করা বাগানবাড়ি বা অনেকটা জমি নিয়ে পড়ে থাকা বাড়িগুলির মালিক পিকনিকের জন্য ভাড়া দেন। তো হল কী, আমাদের পাঁচিলের ওপারেই আর একটা পিকনিক হচ্ছে, তারা তো ডিজে বাজাচ্ছে। আমরা এদিকে হারমোনিয়াম নিয়ে গেছি, গান, নাচ, এইসব হবে। কানফাটানো ডিজের আওয়াজ দিল সব পণ্ড করে। অভিজ্ঞতার পর অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হচ্ছে আমাদের এবং আপনাদেরও। এই ক’দিন আগে বেলপাহাড়িতে গিয়েছিলাম। ডুলুং নদীর ধারে দেখি বক্সে গান বাজছে, জনাদশেক যুবকের কী নাচানাচি! রান্নার আয়োজন দেখছি না। জিজ্ঞেস করলাম। একজন ঘাড় চুলকে লাজুক হেসে বলল, ‘‘বাজার হয়নি। একজন গেছে বাজারে।’’ তখন বাজে দেড়টা!

আরও পড়ুন-সুখের শীত অসুখের শীত

এতসব বলছি কেন? বলছি কি আর সাধে। চড়িভাতি থেকে বনভোজন হয়ে পিকনিকে আসার মাঝখানে একটা সেতু ছিল। সেটিই সেকাল আর একালের পিকনিক-বনভোজনের চরিত্র-রক্ষক ছিল। ধীরে ধীরে কিছু পাল্টালেও চরিত্রটিকে চেনা যেল। এখন দেখা যাচ্ছে সেতুটি ক্রমেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেঙে পড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে এই শীতকালীন উৎসবটি থেকে পাওয়া মূল প্রাপ্তি ও তৃপ্তি।

Latest article