কালীপুজো বা শ্যামাপুজোর ঠিক আগের দিনকে বলা হয় ভূতচতুর্দশী। এ দিনে নাকি মা কালীর চ্যালা-চামুন্ডারা ধরাধামে অন্ধকারের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। কথিত, ধরাধামের যে বাড়িতে চোদ্দো শাক খাওয়া হয় না বা চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানো হয় না, মা কালীর চ্যালা-চামুন্ডারা তাদের অনিষ্ট করেন। তাই এই চতুর্দশীর নাম ভূতচতুর্দশী। দুপুরে চোদ্দো শাক খাওয়া আর সন্ধ্যাবেলায় চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানো এবং দরজায় চোদ্দো ফোঁটা দেওয়ার রেওয়াজ বাঙালির বহু দিনের।
আরও পড়ুন-দেবতার সাড়া না পেয়ে মন্দিরে পেট্রল বোমা ছুঁড়লেন এক যুবক
আধুনিক যুগে এই চোদ্দো শাক খাওয়াকে অনেকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিলেও এই প্রথা চালু হওয়ার পেছনে রয়েছে, শারীরবৃত্তীয় ব্যাপারও। ভেষজ উদ্ভিদের বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত স্বাস্থ্যরক্ষার্থে ১৪টি শাক খাওয়ার নিয়মটি এসেছে। বর্ষা বিদায়ের পরে এবং নতুন মরশুমে পৌঁছে পেটের রোগ, কৃমির প্রকোপ, ক্ষুধামন্দ্যের মতো অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। মরশুম বদলের সময় প্রধানত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেই এই শাক খাওয়া দরকার। অন্তত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বিষয়টি তাই দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন-চলন্ত বাসে আগুন, হতাহতের খবর নেই
শাককে মোটামুটি ৬টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যেমন—
১। পত্র শাক : পালং, নটে, পুঁইশাক, বাঁধাকপি প্রভৃতি।
২। পুষ্প শাক : ফুলকপি, মোচা, বকফুল ইত্যাদি।
৩। ফল শাক : লাউ, কুমড়ো, বেগুন, পেঁপে, ঢেঁড়স প্রভৃতি।
পুরাণ মতে, ভূতচতুর্দশীতে চোদ্দো শাক খাওয়ার রীতি প্রচলন করেন ঋক্ বেদের বাস্কল বা শাক দ্বীপি ব্রাহ্মণেরা। যদিও এ আচার পূর্ব ভারতে এবং বাংলা দেশেই সমধিক প্রচলিত।
শাক শব্দটি কেবলমাত্র কোনও গাছের বা লতার পাতাকে বোঝায় না। বৃহত্তর অর্থে শাক বলতে পাতা, ফুল, ফল, নাল, কন্দ, ছত্রাক— সবই বোঝায়। তাই ওলের মতো কন্দ ভাতে খেলেও শাকই খাওয়া হবে। একই ভাবে কাঁচকলা সিদ্ধ, পটল সিদ্ধ, বকফুল ভাজা, মানকচু সিদ্ধ, লাউ-কুমড়ো ডাঁটা খেলেও শাক খাওয়ারই নামান্তর।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রে বিকল্প সরকার হলে একমাসে গ্রেফতার গদ্দার
কালীপুজোর আগের দিন সকালে রীতি মেনে ‘চোদ্দো শাক’ কেনার ভিড় এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। প্রবীণদের আক্ষেপ, ‘ভূতচতুর্দশী’তে দুপুরে পাতে চোদ্দো শাক আর সন্ধ্যায় বাড়িতে চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানোর রীতি প্রায় ভুলতে বসেছে নতুন প্রজন্ম। ওল, কেও, বেতো, কালকাসুন্দা, নিম, সরষে, হিঞ্চে, সুষনী, সালিঞ্চা, জয়ন্তী, ঘেটু বা ভাট, গুলঞ্চ, পলতা, শুলফা— কালীপুজোর আগের দিন এই চোদ্দোটি শাক খাওয়া দীর্ঘদিনের রীতি। আয়ুর্বেদ চিকিৎসকেরা জানান, শাকগুলির প্রতিটির বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের গুণ রয়েছে। যদিও অধিকাংশ শাকই স্বাদে তেতো হওয়ায় সেগুলি অনেকই পছন্দ করেন না।
আরও পড়ুন-এথিক্স কমিটি তো আসলে সালিশি সভা তোপ মহুয়ার
আসলে আজ হল তেনাদের দিন। প্রতি বছর এই সময়টায় গোটা বিশ্বের আকাশে আজ নাকি ঘোরাফেরা করেন আত্মারা। কোনও দেশে ভূত নামে একটু আগে, কোনও দেশে একটু পরে! তবে মোটামুটি অক্টোবর মাসের শেষ দিনটি থেকেই আনাগানো শুরু করেন ভূত, পেত্নি, শাকচুন্নি, বেহ্মদত্যিরা। হ্যালোইউন থেকে ভূতচতুর্দশী— সব দেশই এই সময়টায় স্মরণ করে নেয় পূর্বপুরুষদের আত্মাদের।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রে বিকল্প সরকার হলে একমাসে গ্রেফতার গদ্দার
দুর্গার মতো কালীকেও অশুভ শক্তির বিনাশ ও শস্যের দেবী বলে ধরা হয়। কালীপুজো বা দেওয়ালির ঠিক আগের দিন আশ্বিন মাসের চতুর্দশী বা ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যায় বাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয়। সঙ্গে ১৪ রকম শাক খাওয়ার নিয়মও রয়েছে৷ সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এই প্রথার সঙ্গে শস্যদায়িনী দেবী ভাবনার যোগাযোগ রয়েছে। আর ভেষজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এই শাকগুলি খাওয়া হত।
আরও পড়ুন-মা কালী অতীত ও ভবিষ্যৎ
হ্যালোউইনের রাতে যেমন মিষ্টি কুমড়ো কেটে ভূতের মুখ বানিয়ে তাতে আলো জ্বালান পশ্চিমিরা, তেমনই ভূতচতুর্দশীতে বাড়ির আনাচে-কানাচে আলো জ্বালানোর রেওয়াজ রয়েছে এই বাংলায়ও। রীতির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নানা গল্পও। ভূতচতুর্দশী নিয়ে পুরাণের যে গল্প পাওয়া যায়, তা হল দানবরাজ বলি যখন স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে হত্যাযজ্ঞ চলাচ্ছেন— মানুষ দূরের কথা, অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছিলেন না দেবতারাও। বলির তাণ্ডব ঠেকাতে দেবগুরু বৃহস্পতি ভগবান বিষ্ণুকে একটি উপায় বাতলে দিলেন। বামনের ছদ্মবেশে এসে তিন পা জমি দান চেয়ে দানবরাজকে পাতালে পাঠালেন।
আরও পড়ুন-কর্মসূচির দিনই ডাকছে, এজেন্সি দিয়ে হেনস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ অভিষেকের
কিন্তু লোকবিশ্বাস, জেনে শুনেই বিষ্ণুকে জমি দিয়েছিলেন বলি। তাই পৃথিবীতে তাঁকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন বিষ্ণু। লোকবিশ্বাস হল, কালীপুজোর আগের রাতে বলি রাজা পাতাল থেকে উঠে আসেন পুজো নিতে। তার সহচর হিসেবে থাকেন শত সহস্র ভূত, প্রেতাত্মা এবং অশরীরী। রয়েছে আরও নানা মত। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে সহজ ব্যাখ্যাটি হল, চোদ্দো পুরুষের আত্মাকে তুষ্ট করে অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে এবং ক্ষতিকারক কীটের হাত থেকে হৈমন্তিক ফসল রক্ষা করতে ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর এই রীতি।