(গতকালের পর)
আমি একাধিকবার ‘তথাকথিত অস্থায়ী উপাচার্য’ শব্দগুলি ব্যবহার করেছি সচেতনভাবে। কারণ এঁদের কি উপাচার্য বা অস্থায়ী উপাচার্য বলা যায়? ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাবাসাহেব আম্বেদকর শিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএড বিশ্ববিদ্যালয়) উপাচার্যদের বিষয়টি আলাদা। তাঁরা উপাচার্যই ছিলেন। তাঁদের কার্যকালের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে মাত্র। শুনেছি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যকালের মেয়াদও বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কিন্তু ‘অতি বুদ্ধিমান’ এই মাননীয় শিক্ষাবিদ কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্ত হয়েছেন এবং কার্যভার গ্রহণ করেছেন। বাকি যাঁরা নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁরা শুধুমাত্র উপাচার্যের দায়িত্ব বা কর্তব্য পালন করবেন। এইটুকু ক্ষমতা তাঁদের দেওয়া হয়েছে। রাজভবন থেকে প্রকাশিত নির্দেশে এই কথাই বলা হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে এই ক্ষমতা দান (authorisation) এবং উপাচার্য হিসাবে নিয়োগের (appointment) মধ্যে তফাত রয়েছে। মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট একই কথা বলেছে।
আরও পড়ুন-মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে অর্থসাহায্য রাজ্যের, রাজনীতি করছেন রাজ্যপাল : ফিরহাদ
পূর্ব উল্লিখিত মামলার (WPA(P)/272/2023) রায়ের (তারিখ ২৮.৬.২০২৩) ২৬ নম্বর প্যারাতে মাননীয় প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ স্পষ্টভাবে বলেছে, যাঁদের সম্প্রতি নিয়োগ করা হয়েছে, তাঁরা কেউ উপাচার্য বা অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য নন। তাঁদের শুধুমাত্র উপাচার্যের কর্তব্য পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে (‘they are only authorized to perform duties of the Vice Chancellor”। এ-ছাড়া রায়ের ৮২ নম্বর প্যারাতে বলা হয়েছে, উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত হওয়ার আগে পদাধিকারীরা যে বেতন পেতেন, তাঁরা সেটাই পাবেন, অর্থাৎ উপাচার্যের বেতন পাবেন না। তবে কােনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের যদি বিশেষ ভাতার বন্দোবস্ত থাকে, সেই ভাতা তাঁরা পাবেন।
মাননীয় আচার্য-রাজ্যপাল বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পরিভ্রমণ করেছেন। কিছুদিন এই ভ্রমণ স্থগিত রয়েছে। এতে দোষের কিছু নেই। আচার্য হিসাবে এবং একজন পণ্ডিত ব্যক্তি হিসাবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেই পারেন। অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, প্রশাসনিক আধিকারিক, কর্মচারী-বন্ধু এবং সর্বোপরি ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্য সরকারকে পরামর্শ দিতে পারেন। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বইপত্র দেখতেও পারেন। বিহারের রাজ্যপাল ও বিশিষ্ট অধ্যাপক কিদোয়াই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন। কোনও বিতর্ক হয়নি। কিন্তু আমাদের আচার্য-রাজ্যপালের একটি নির্দেশ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। নির্দেশটি হল, উপাচার্যরা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত সাপ্তাহিক রিপোর্ট রাজভবনে সরাসরি পাঠাবেন। সম্ভবত ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে একটি বাংলা দৈনিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরি এই নির্দেশের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে একমত। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সরকারি অফিসে কতসংখ্যক ফাইলের নিষ্পত্তি হল, সপ্তাহের শেষে তার রিপাের্ট চাওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন-ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে চাঞ্চল্য
কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে, এটা সম্ভব মনে হয় না। তবুও সুস্থ বিতর্ক-আলোচনা চলতে পারে। প্রশ্ন হল, উপাচার্যরা কি সরাসরি রাজভবনে যে কোনও ধরনের রিপোর্ট পাঠাতে পারেন? সরকারি আধিকারিকরা কি সরাসরি কোনও মন্ত্রীমহোদয়কে লিখতে পারেন? এটা প্রশাসনিক বিধি বা শিষ্টাচার (protocol) বিরোধী। পূর্বে উল্লিখিত ২০১৯ সালে বিধিতে (Rules) আবার ফিরে আসছি। ওই বিধির ৮ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপধারাতে বলা হয়েছে, রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা যদি কোনও বিষয়ে আচার্যকে লিখতে চান বা যোগাযোগ করতে চান তাহলে বিষয়টি উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে পাঠাতে হবে। তাহলে উপাচার্যরা কীভাবে সরাসরি রাজভবনে রিপোর্ট পাঠাবেন?
আরও পড়ুন-নীরজের ঝুলিতে সোনা, শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর
একইভাবে একই ধারার ৫ নম্বর উপধারায় বলা আছে, আচার্য রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবেন একমাত্র উচ্চশিক্ষা বিভাগের মাধ্যমে। তাঁর সংযোগের বিষয়টি অথবা প্রস্তাবটি উচ্চশিক্ষা বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। মান্যবর আচার্য-রাজ্যপাল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আলোচনা করতে অবশ্যই পারেন। কিন্তু কোর্ট বা সিনেটের বৈঠক ডাকার ক্ষমতা তাঁর নেই। সেই ক্ষমতা আছে একমাত্র উপাচার্যের। উচ্চশিক্ষা বিভাগকে জানিয়ে উপাচার্য এই বৈঠক ডাকতে পারেন এবং উচ্চশিক্ষা বিভাগ প্রয়োজন মতো আচার্যকে জানাবে। আর এখন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যদের রাজ্য সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও বৈঠক ডাকার ক্ষমতা নেই। সংবাদ সূূত্রে প্রকাশ, অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে আচার্য বলেছেন, পরামর্শ (Consultation) সম্মতি (Concurrence) নয়। ঠিক কথা। কিন্তু মাননীয় উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে আদৌ পরামর্শ করা হয়েছে কি? হয়নি। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্বাচিত সরকারের ক্যাবিনেট পর্যায়ের বিভাগীয় মন্ত্রীকে অবজ্ঞা করা কি গণতান্ত্রিক রীতি ও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার সম্মত? ‘পরামর্শ’ কথাটির অর্থ কী? জম্মু-কাশ্মীর বনাম এ আর জাকি মামলায় (১৯৯২) সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, যদিও ‘পরামর্শ’ মানে ‘সম্মতি’ নয়, তবুও ‘ফলপ্রসূ পরামর্শ’ হওয়ার আবশ্যক— অর্থাৎ পারস্পরিক মত-বিনিময় হবে এবং এক পক্ষ অপর পক্ষের ভিন্ন মতের মধ্যে ইতিবাচক দিক আছে কি না, সেটি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করবে। নচেৎ ‘পরামর্শ’ প্রক্রিয়া শেষ হবে না।
আরও পড়ুন-আইএসএফের ষড়যন্ত্রেই বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ
রাজভবনে শিক্ষা-সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে সেল খোলা হয়েছে শুনলাম। রাজ্যপাল সাংবিধানিক প্রধান। সমাজের নানা স্তর থেকে মানুষ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা নিয়মিত রাজভবনে যান। অনেকে তাঁদের সমস্যার কথা, ক্ষোভের কথা, অভিযোগের কথা রাজ্যপালকে জানান। সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে রাজ্যপাল সেই সমস্ত অভিযোগ বা সমস্যার কথা সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়ে দেন। রাজ্যপাল রিপোর্ট চাইতে পারেন। তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলে বিভাগীয় সচিব বা মন্ত্রীমহোদয়কে ডেকে আলোচনা করতে পারেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজ্যপাল নিজে তদন্ত করতে পারেন না। ২০১৯-এর বিধির ৮ নম্বর ধারার ৬ নম্বর উপধারার উল্লেখ করছি। এই উপধারায় বলা আছে, রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাজকর্ম সম্পর্কে আচার্যের কাছে কোনও অভিযোগ এলে, তিনি সেটি উচ্চশিক্ষা বিভাগকে পাঠিয়ে দেবেন।
আরও পড়ুন-আজ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, এক মঞ্চে নেত্রী-অভিষেক
উচ্চশিক্ষা বিভাগ প্রয়োজন মনে করলে অভিযোগটি নিয়ে অনুসন্ধান বা তদন্তের বন্দোবস্ত করতে পারে। এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে আচার্য-রাজ্যপালের প্রত্যক্ষভাবে কিছু করণীয় নেই। উল্লেখযোগ্য, এই বিধি বা Rules কেউ অমান্য করতে পারেন না। ২০১৯-এর এই বিধি কলকাতা হাইকোর্ট বা দেশের শীর্ষ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বলা হয়নি, এই বিধি রাজ্য বিধানসভা প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় আইন-বিরোধী অথবা ভারতীয় সংবিধানের কোনও ধারা-বিরোধী। আইনের কচকচানি চলতেই থাকবে। সংবিধান বিশ্লেষণ, বিতর্ক, আলোচনা চলবে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে টানাপোড়েনও চলবে। কিন্তু এর জন্য যদি রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় (যেটা প্রায় হতে চলেছে), লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়, তার পরিণতি হবে মর্মান্তিক এবং ভয়াবহ। পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। তাই রাজ্যের স্বার্থে এবং জাতীয় স্বার্থে আচার্য-রাজ্যপাল এবং ব্যাপক জনাদেশ নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য ফিরে আসা নির্বাচিত রাজ্য সরকারের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া অত্যন্ত জরুরি। (শেষ)