গৌরচন্দ্রিকা মৃত্যুর পূর্বে পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কচূড়ামণি শেষ পর্যন্ত অল্পবয়সি অম্বরনাথকে টোলের অধ্যাপক ও জমিদার বংশের গৃহদেবতা রাধাবল্লভের পুরোহিত পদে বসিয়ে দিলেন। জমিদার চিন্তায় পড়লেন তাঁর কন্যা বাণীর কথা ভেবে। রাধাবল্লভের নিত্যপূজা বাণী করেন। নতুন পুজারির সামান্যতম ত্রুটি বাণী মেনে নিতে পারবেন না। বাস্তবে এমনটাই হল। বাণী আর অম্বরনাথের মধ্যে টক্কর লেগেই গেল। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে সেই অম্বরনাথকেই বিয়ে করতে হল বাণীকে। বাণী অম্বরনাথকে জানালেন বিয়ের সময় থেকে কোনও সম্বন্ধ থাকবে না তাঁদের মধ্যে। অম্বরনাথ জানালেন বিয়ের সময় থেকে নয় সমস্ত শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান পালন করার পর থেকে। পুরোহিত শাস্ত্র পড়ছেন আর বাণীর বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। সকালে উঠেই অম্বরনাথ আসামে রওনা দিলেন। সকলের কাছে বিদায় নিলেন। শুধু বাণীর কাছ থেকে নয়। সবচেয়ে যে আপন সেই বাণী হয়ে রইলেন সবচেয়ে পর। নিষ্কৃতি দিয়ে গেলেন স্বামী। কিন্তু আনন্দিত হতে পারলেন না কেন বাণী? মন্ত্রের সেই ধ্বনি বাজে তাঁর কানে ‘যদিদং হৃদয়ং মম তদস্তু হৃদয়ং তব’। মন্ত্রের এত শক্তি। সেই লক্ষ্মীমন্ত বাণীকে যেতেই হল অম্বরনাথের কাছে। এই হল অনুরূপা দেবীর কাহিনি নিয়ে তৈরি ‘মন্ত্রশক্তি’ ছবির গল্প। এখানে অম্বরনাথ হলেন উত্তমকুমার। বাণী হলেন সন্ধ্যারানি। লক্ষ্মীর ছাপ রয়েছে যে গুটিকয়েক নায়িকার মুখে তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছেন সন্ধ্যারানি। কখনও নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করেননি। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, সেইসব রমণীর চরিত্রে বারংবার ডাক পড়েছে তাঁর। ব্রতচারিণী, কঙ্কাবতীর ঘাট, সূর্যমুখী, মায়ার সংসার প্রভৃতি ছবির নাম উল্লেখ করা যায় যেখানে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে। তিনি সর্বংসহা, চোখের জলে যাঁর ফল্গুধারা, স্নেহ-মমতায় তিনি সবার উপরে।
আরও পড়ুন-নোবেলের মঞ্চ মিলিয়ে দিল রাশিয়া-ইউক্রেনকে শান্তি পুরস্কার দুই দেশের মানবাধিকার সংগঠনকে
সন্ধ্যারানিকে লক্ষ্মী সম্বোধনে উত্তমকুমার নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে কোনও এক ফ্লোরে সন্ধ্যারানি কারও সন্ধানে ঢুকে পড়েছিলেন। টেকিং চলছিল। ডিরেক্টর সন্ধ্যারানিকে চিনতে না পেরে কটু কথা বলে ফ্লোর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। সেই অপমানে চোখের জল ফেলে বেরিয়ে এসেছিলেন সন্ধ্যারানি। হঠাৎ মুখোমুখি মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে। চোখের জলের কারণ জানতে পেরে তিনি ফ্লোরে ঢুকে নবাগত পরিচালককে প্রচলিত ছাঁচে ধমক দিলেন। বললেন ‘‘জানো কাকে ফ্লোর থেকে বার করে দিয়েছ? ইনি হলেন বাংলা ছবির লক্ষ্মী। বাংলা ছবি ব্যবসা করেছে এই শিল্পীর সুবাদে।” এ-কথা অতিশয়োক্তি নয়। প্রচুর প্রচুর বাংলা ছবির প্রযোজক দুহাতে ব্যবসা করেছেন যেসব ছবিতে প্রধান চরিত্রে সন্ধ্যারানি।
আরও পড়ুন-তিথিনক্ষত্র মেনে দ্বাদশীতে কঙ্কালীতলায় হল কুমারীপুজো
কাননদেবীর কথা ফ্লোরের মধ্যে মন খারাপ করে বসে আছেন কাননদেবী, বাংলা ছবির প্রথম স্টার নায়িকা গায়িকা। পাশেই বসেছিলেন অন্ধ গায়ক-অভিনেতা কৃষ্ণচন্দ্র দে। তিনি বললেন, ‘‘রাধার মুখ ভার কেন? শ্রীমতী মুখ ভার করে থাকলে শ্রীকৃষ্ণ এসে বসবেন কোথায়?” কাননদেবী অবাক হয়ে গেলেন অন্ধ মানুষ তাঁর মনের কথা জানলেন কী করে? পরে কাননদেবীকে হয় রাধে অথবা শ্রীমতী নামে সম্বোধন করতেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। কাননদেবী তাঁর প্রোডাকশন হাউসের নাম রেখেছিলেন শ্রীমতী পিকচার্স। কাননদেবীর লক্ষ্মীশ্রী মুখের টানে দর্শকেরা বারংবার ছুটেছেন মেজদিদি, দেবত্র, ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত, অন্নদাদি ছবি দেখতে। বিষ্ণুমায়া ছবিতে তিনি লক্ষ্মী চরিত্রে।
আরও পড়ুন-তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বশাসনে ভারতীয় কান্ডারিরা
অনুভা গুপ্তার কথা নানান ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনুভা গুপ্তা। অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে নেগেটিভ চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। কিন্তু সেই তিনি যখন সুপার ডুপার হিট ‘রত্নদীপ’ ছবিতে বৌরানি হন তখন সেই বৌরানিকে দেখে রাখাল ভট্টাচার্য (বিকাশ রায়) সমীহ করেন, দূরত্ব বজায় রাখেন। ‘কবি’ ছবিতে ঠাকুরঝির মুখ দেখে নিতাই কবিয়াল (রবীন মজুমদার) পর্যন্ত বিভ্রান্ত হন। তিনি তাঁর রূপে গুণে অনন্যা হয়ে উঠেছিলেন ‘অনন্যা’ ছবিতে। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিতে তাঁর জবা চরিত্রটি আমরা কোনও দিন ভুলব না। ‘লক্ষ্মীনারায়ণ’ ছবিতে তিনি মা লক্ষ্মীর ভূমিকায় ছিলেন।
সুচিত্রা সেনের কথা বাংলা ছবির লক্ষ্মীলাভে যে নামটি সবার উপরে উঠে আসে তিনি অবশ্যই সুচিত্রা সেন। অগ্রিম টিকিটে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়ে থাকে তাঁর নামে। টিকিট ব্ল্যাক হয় তাঁর নামে। গোড়া থেকেই তিনি তাঁর অপরূপ কোমলে কঠোরে মেশানো ব্যক্তিত্ব দিয়ে দর্শক মনোরঞ্জন করেছেন বারংবার। তিনি বিজয়িনী। ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্রে দেবকীকুমার বসু সাধে কি নিয়ে ছিলেন সুচিত্রা সেনকে! ‘কমললতা’ ছবিতে তিনি কমললতা। ‘চন্দ্রনাথ’ ছবিতে তিনি সরযূ। দীপ জ্বেলে যাই ছবিতে তিনি রাধা মিত্র।
আরও পড়ুন-রাজনীতি করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত বিজেপি
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের কথা সব যিনি নির্বিচারে সইতে পারেন, সংসারকে ধরে রাখতে যিনি নিজের জীবন বাজি রাখতে পারেন, এমন সব চরিত্রে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় দ্বিতীয়রহিত। শ্রেয়সী, উত্তরায়ণ, নিশিপদ্ম, কাল তুমি আলেয়া, বালুচরী, মুক্তিস্নান প্রভৃতি ছবিতে তিনি দর্শকদের কাঁদিয়ে ভাসিয়েছেন। লক্ষ্মীর মতো চরিত্রগুলির লাঞ্ছনা দর্শকরা নিতে পারেননি বলে চোখের জল ফেলেছেন। পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ থেকে তিনি উঠে এসেছেন। তাই তিনি দর্শকদের পালস বুঝতে পারতেন। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন যে তাঁকে স্টার থিয়েটারে লক্ষ্মী বলা হত। কোনও বাড়তি কথা নয়।
আরও পড়ুন-বিরাটের রেস্তরাঁর উদ্বোধন আজ, কিশোরকুমারের বাংলো
মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কথা মলিনা দেবী, সন্ধ্যারানির ছাঁচে মাধবী মুখোপাধ্যায় শরৎ-কাহিনিতে বারংবার এসেছেন। লেখকের উপন্যাসে বর্ণিত লক্ষ্মীশ্রী চেহারা যে মাধবী মুখোপাধ্যায়েরও। বিন্দুর ছেলে, রামের সুমতি, বিরাজবৌ, নিষ্কৃতি ছবিগুলোর কথা তার প্রমাণ বহন করে। সুবর্ণলতা ছবিতে নামভূমিকায়। স্ত্রীর পত্র ছবিতে তিনি মৃণাল। অসংখ্য ছবিতে তিনি দর্শকদের আনতে পেরেছেন তাঁর অভিনয়ের জন্য বটে, এ-ছাড়া মুখটির জন্যও বটে।
সন্ধ্যা রায়ের কথা সন্ধ্যা রায়ের মুখে রয়েছে তেমনি লক্ষ্মীর ছাপ যা দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহমুখী করেছে বারংবার। সূর্যতপা, শুভদৃষ্টি, আলোর পিপাসা, নিমন্ত্রণ, পালঙ্ক, বাবা তারকনাথ, বৌমা প্রভৃতি ছবিতে বড় পর্দা জুড়ে তাঁর মমতাময়ী মুখ, চোখের জল দর্শকরা উপেক্ষা করতে পারেননি কখনও।
আরও পড়ুন-অনাদরের লক্ষ্মী
মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়ের কথা ‘বালিকা বধূ’র রজনীর লক্ষ্মীশ্রী মুখ কে ভুলতে পারবেন? তাই প্রথম ছবিতেই মৌসুমি চট্টোপাধ্যায় কিস্তিমাত। ধারাবাহিকভাবে এল পরিণীতা, মা ও মেয়ে, অনিন্দিতা, দাবি প্রভৃতি ছবি। দাবি ছবিতে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে এনেছি/ সুগন্ধী ধূপ জ্বেলে আসন পেতেছি/ এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে/ আমারই ঘরে থাকো আলো করে’ সময়কে হার মানানো এই গানটি ছিল মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়ের লিপে।