তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বশাসনে ভারতীয় কান্ডারিরা

অ্যান্ড্রয়েড, সার্চ, ইউটিউব, মোবাইল অ্যাপ, গুগল ম্যাপ থেকে তথ্য প্রযুক্তির দুনিয়ার অনেক কার্যকরী ও সংক্ষিপ্ত নাম আজ আমাদের হাতে হাতে ফিরছে।

Must read

অ্যান্ড্রয়েড, সার্চ, ইউটিউব, মোবাইল অ্যাপ, গুগল ম্যাপ থেকে তথ্য প্রযুক্তির দুনিয়ার অনেক কার্যকরী ও সংক্ষিপ্ত নাম আজ আমাদের হাতে হাতে ফিরছে। আর সেইসব তথ্যপ্রযুক্তি ও  ইন্টারনেট দুনিয়ার সাম্রাজ্যের জয়যাত্রার গতিরথ ছুটে চলেছে প্রবল বেগে। তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ায় আজ গুগল, হটমেল, জি মেল, ইয়াহু-র মতো কত নাম। সেই যাত্রায় ভারতীয় মেধা ও অন্বেষার জয়যাত্রার নতুন করে আলোকপাত করলেন সুন্দরারাজন পিচাই। তথ্যপ্রযুক্তির তামাম দুনিয়ায় আজ উল্লেখযোগ্য এই ভারতীয়ের নাম।

আরও পড়ুন-লক্ষ্মীপ্যাঁচা, লক্ষ্মীর প্যাঁচা নাকি প্যাঁচাই লক্ষ্মী

সেই জয়যাত্রার মুকুটে আজ অনেক ভারতীয় প্রতিভার নাম উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত। সত্য নাদেল্লা, সঞ্জয় মেহরোত্র, রাকেশ কাপুর, রাজীব সুরি, শান্তনু নারায়ণ থেকে ইন্দ্রা নুয়ি, রুচি সাংভি, পদ্মশ্রী ওয়ারির-এর মতো অনেক নাম। তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার দুই বৃহত্তর সাম্রাজ্যের একটি মাইক্রোসফট অন্যটির নাম গুগল। এই দুই মহান সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বের দুই প্রধান কর্মকান্ডারিই আজ ভারতীয়। মাইক্রোসফটের কান্ডারি যদি হন হায়দ্রাবাদি সত্য নাদেল্লা। তবে আবিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়া দখলে রাখা গুগল-এর বর্তমান চিফ এগজিকিউটিভ অফিসারের পদটিও এক ভারতীয় মেধার দখলে। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ-এর হাত থেকে গুগলের রাজ্যপাট এখন ৪৩ বছরের সুন্দরারাজন পিচাই-এর হাতে। তামিল নাড়ুর এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি দুনিয়ার অধীশ্বরের স্বপ্নপথের যাত্রা শুরু হয়েছিল ধাতুবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা দিয়ে। পরবর্তীকালে ইন্টারনেট দুনিয়ার বর্তমান দিগন্তবিস্তারী নাম এই সুন্দরারাজন। খড়গপুরের মেটালার্জিক্যাল অ্যান্ড মেটিরিয়াল ইঞ্জিনিয়িরিং এর এই কৃতী ছাত্রটি সেখান থেকে পাশ করে স্নাতকোত্তর পড়তে চলে যান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই তাঁর জীবনের নতুন যাত্রাপথ শুরু।

আরও পড়ুন-লক্ষ্মী মেয়ের আজ কোনও লক্ষ্মণরেখা নেই

গুগল আজ বিশ্বের প্রতি প্রান্তে ঘরে-ঘরে ছড়িয়ে পড়া একটি নাম। যার হাত ধরে আজ বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আমরা মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারি, খুঁজে নিতে পারি আমাদের ইপ্সিত হাজারো প্রশ্নের উত্তর— জ্ঞানবিজ্ঞান তথা অন্যান্য তথ্যভাণ্ডার থেকে বিনোদন সাম্রাজ্য পর্যন্ত— কী নয়? সেই বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি সাম্রাজ্যের প্রধান হয়ে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন, ভারতীয় মেধাসম্পন্ন সুন্দরারাজন পিচাই। বিশ্বের বৃহত্তম ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গুগল-এর সর্বোচ্চ পদে এই ভারতীয়ের উত্তরণ নতুন করে আমাদের মনে পড়িয়ে দিল রাজীব সুরি, শান্তনু নারায়ণ-এর মতো তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতী ভারতীয়ের নাম যাঁরা বিশ্বজোড়া এই প্রতিষ্ঠানগুলির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। যে সব ভারতীয় আজ বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার প্রধান হয়ে তাঁদের মেধার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি তথা অন্যান্য প্রশাসনিক শীর্ষস্থানীয়ের সেই দলে শুধু পুরুষরাই নন, পদ্মশ্রী ওয়ারির, রুচি সাংভি ও ইন্দ্রা নুয়ির মতো মহিলারাও রয়েছেন।

আরও পড়ুন-রাজনীতি করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত বিজেপি

চেন্নাইয়ের এক তামিল পরিবারে জন্ম ইন্দ্রা নুয়ির। চেন্নাইয়ের হোলি অ্যাঞ্জেলস বিদ্যালয় থেকে পাশ করে ১৯৭৪ সালে মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ভারতে জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানিতে প্রোডাক্ট ম্যানেজার হয়ে কর্মজীবন শুরু করে বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুতকারক সংস্থা পেপসিকোর প্রধান পদের দায়িত্বে। ২০০৮ সালে বিখ্যাত ফোবর্স পত্রিকা পৃথিবীর ১০০ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী মহিলার তালিকায় যাঁকে তৃতীয় স্থানে নির্বাচন করেছিল। ফরচুন পত্রিকার বিচারে ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর-পর তিন বছর বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মহিলা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ইন্দ্রা নুয়ির পুরো নাম ইন্দ্রা কৃষ্ণমূর্তি নুয়ি। জন্ম ১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর। কলকাতার আইআইএম থেকে ডিগ্রি অর্জন করে তাঁর কর্মজীবনের যাত্রা। ১৯৯৪ সালে পেপসিকোতে অংশগ্রহণের পর ক্রমশ কোম্পানির সিইও হন তিনি। কোম্পানির বিশ্বপরিচালন ব্যবস্থাকে তিনি এক দশকেরও বেশি ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পেপসিকোর ৪৪ বছরের ইতিহাসে এই কৃতী ভারতীয় প্রথম চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার হন।

আরও পড়ুন-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে দ্বিতীয়, প্রথম হওয়ার যুদ্ধে রাজ্য, সর্বাধিক কর্মসংস্থান

ইন্দ্রা নুয়ির মতোই বাইরের বিশ্বে প্রধান হয়ে তাঁর উজ্জ্বল কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে চলেছেন পদ্মশ্রী ওয়ারির। অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয় ওয়াড়ার এক তেলুগু পরিবারের কন্যা। কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি করেন দিল্লি আইআইটি থেকে। মাস্টার্স ডিগ্রি করেন কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে। কর্মজীবনের এক পর্যায়ে তিনি কর্তৃত্ব নেন মার্কিন দুনিয়ার অন্যতম সিসকোর মতো প্রতিষ্ঠানের। ২০১৪ সালে হন চিফ টেকনিক্যাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি অফিসার অব সিসকো এবং মোটোরোলার সিটিও। ফোবর্স পত্রিকা এই ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে বিশ্বের ৭১ তম সফল কর্মোদ্যোগীর তকমা দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-ত্রিকোণ প্রেম! হরিদেবপুরের যুবক খুন, আটক বান্ধবী

এমনই এক সফল ভারতীয় রাজীব সুরি। বর্তমানে ফিনল্যান্ডের পাকাপাকি বাসিন্দা। দিল্লিতে ১৯৬৭ সালে জন্ম এক পাঞ্জাবি পরিবারে। বাবা-মা কুয়েতবাসী হলে তিনিও কুয়েত যান, সেখানেই পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা। তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় এক উজ্জ্বল নাম। ইলেকট্রনিক্স ও কমিউনিকেশনে ব্যাচেলর ডিগ্রি করেন, তারপর তথ্য প্রযুক্তি দুনিয়ায় প্রবেশ। সেখান থেকে বিশ্বের অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তি
সংস্থা নোকিয়ার চিফ এগজিকিউটিভ অফিসারের পদ সামলেছেন বেশ কিছুদিন। বর্তমানে তিনি ব্রিটিশ স্যাটেলাইট টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিতে সিইও-র পদে রয়েছেন।

আরও পড়ুন-মেক্সিকোতে বন্দুকবাজের হানা, মৃত মেয়র-সহ ১৮

আর অ্যাডোব সিস্টেম-এর সিইও শান্তনু নারায়ণের নাম তো বিশ্বময়। হায়দরাবাদে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাবা ছিলেন প্লাস্টিক ব্যবসায়ী। হায়দরাবাদের পাবলিক স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ডিগ্রি করেন ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমবিএ করেন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। মাস্টার অব সায়েন্স করেন বাউলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে। অ্যাপল থেকে কর্মজীবন শুরু। তাঁর হাত দিয়েই সিলিকন গ্রাফিক্স, পিকট্রা-র বা ডিজিট্যাল ফটো শেয়ারিং ইন্টারনেট প্রযুক্তির নানান দিগন্ত খুলে যায়। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৯৮-এ অ্যাডবে কর্মসূত্রে যুক্ত হন, দায়িত্ব পান ভাইস প্রেসিডেন্ট অব ওয়ার্ল্ডওয়াইড প্রোডাক্ট রিসার্চ-এর।

আরও পড়ুন-বলি থেকে টলি বয়কট ট্রেন্ডে নাকাল সবাই

২০০৭ সাল থেকে ব্রুস চিজেন-এর স্থানে উত্তরণ ঘটে এই তথ্যপ্রযুক্তির মেধাসম্পন্ন মানুষটির। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ ও তার কর্ণধার বারাক ওবামারও তিনি ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইসরি বোর্ডের অন্যতম সদস্য এই মুহূর্তে। আর এক সিলিকন সম্রাট বিনোদ খোসলার নিবাস পাকাপাকি ভাবে বর্তমানে আমেরিকায়। বাবা ছিলেন দিল্লিতে ইন্ডিয়ান আর্মির কর্মী। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই আগ্রহ জন্মায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দিল্লির বাসিন্দা এই কিশোরটি তার স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, দিল্লি থেকে ডিগ্রি করেন। তারপর কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি করার পর এমবিএ করেন স্ট্যানফোর্ড স্কুল অব বিজনেস থেকে। সান মাইক্রোসিস্টেম দিয়ে যাত্রা শুরু।

আরও পড়ুন-আটমাসের শিশুকন্যা-সহ ভারতীয় বংশোদ্ভূত চারজনকে অপহরণ করে খুন

বর্তমানে খোসলা ভেঞ্চার্স বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের নাম। তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার সুচনাকাল থেকেই সিলিকন সাম্রাজ্যে ভারতীয় মেধার পরিচয়, প্রভাব ও প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন তাঁরা। ভারতে জন্মে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ শুধু নয়, অন্যত্রও তাঁদের মেধার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। সেই তালিকায় অন্যতম নাম বিনোদ খোসলা থেকে রুচি সাংভি, সাবির ভাটিয়া, বিবেক গুনদোত্রা, ওম মালিক এমন অনেক দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব তাঁদের শিক্ষা ও প্রাচুর্যের পরিচয় দিয়ে চলেছেন। বিশ্বের বাজারে তাঁরা তথ্য প্রযুক্তির নানান আবিষ্কার ও প্রসার ঘটিয়ে এক-একজন দিকপাল হয়ে উঠেছেন। তেমনই এক কৃতী ভারতীয় কন্যা রুচি সাংভি। ‘ফেসবুক’ এক প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার। আর বিবেক গুণদোত্রাকে ‘মাইক্রোসফট ম্যান’ বলেই বিশ্ব চেনে। ওম মালিককে চেনে প্রথম টেকনোলজি নিউজ ব্লগার হিসেবে। শুধু তথ্যপ্রযুক্তিই নয়, প্রশাসন থেকে রাজনীতি, অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রে আজ অনেক ভারতীয় আমেরিকা, চিন, জাপান প্রভতি বিশ্বের বহু দেশের উচ্চস্থানে তাঁদের কর্মদক্ষতা ও মেধার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। যে তালিকায় উঠে এলেন সুন্দররাজন পিচাই। তামিলনাড়ু থেকে গুগল সম্রাট হয়ে উঠে শুধু ভারতেরই নয়, বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষ তাকিয়ে তাঁর দিকে, দেখতে চাইছে আরও নতুন জগৎ তাঁরই জাদুহাত ধরে।

Latest article