লক্ষ্মী মেয়ের আজ কোনও লক্ষ্মণরেখা নেই

বদলে গেছে লক্ষ্মীর সংজ্ঞা। সমাজের একটা অংশ দিব্য মেনে নিয়েছে অলক্ষ্মী লক্ষ্মীদের। শুধু মেয়েরাই নয়, সময়বিশেষে লক্ষ্মী হয়ে ওঠে ছেলেরাও। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন বিশুদ্ধ লক্ষ্মী-কথায় রমাপদ পাহাড়ি

Must read

লক্ষ্মীর পাঁচালি। এ এক্কেবারে পেঁচো জায়গা। ঊনকোটি সত্তর প্যাঁচ-পয়জারের অকুস্থল। খুঁটে খুঁটে খট্টাসের মতো পড়লে, ব্যোমকে যাবেন। কী আছে এতে? পতিনিন্দা— উঁহুঁ, নৈব নৈব চ। স্বামীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার স্বপ্নেও ‘ন চিন্তনে’! শ্বশুরবাড়ি দজ্জাল হলেও, মন্থরার মতো নিন্দুকীর গঞ্জনাতেও বউমাটিকে হয়ে থাকতে হবে গজগামিনী। সকালে বউমার সুখনিদ্রা? ও-মা, কস্মিনকালেও না। ইঁদুর ধরার কলের মতো, এ যেন ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ ধরার কলকাঠি।

আরও পড়ুন-রাজনীতি করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত বিজেপি

পোশ্ন হল, এমন ধারার নারায়ণের পাঁচালি আছে কোনও? পুরুতঠাকুরের কাছে একবার খোঁজ নিন প্লিজ। যদি খানা-তল্লাশি করে খুঁজে পান, কাগজের দপ্তরে একখান পাঠান। গৃহপ্রবেশের মন্ত্রতন্ত্র বলে ভুল করবেন না, যেভাবে মেয়েদের ‘লক্ষ্মী’ বানানোর জন্য পাঁচালি ‘তৈয়ারি হইয়াছে’ তেমন করে পুংপ্রবরদের কিন্তু নারায়ণ বানানো হয়নি। কেন? উত্তর মেলা মুশকিল। বরং মা-বাবারা চান, ছেলে যেন রূপে গুণে স্বয়ং মহাদেব হয়। যার গার্হ্যস্থ্যে মন থাকবে না বিন্দুবিসর্গ, হাজা-গাঁজায় হেজেগেজে মজা নিলেও সাত খুন মাপ। যত্রতত্র মস্তিমৌজ— ও তো পুরুষের স্বভাব। তা নইলে পুং কিসে!
বদলে গেছে জমানা

আরও পড়ুন-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে দ্বিতীয়, প্রথম হওয়ার যুদ্ধে রাজ্য, সর্বাধিক কর্মসংস্থান

বদলে গেছে লক্ষ্মীর সংজ্ঞা। অভিধানে যদিও ঠাঁই পায়নি। কিন্তু সমাজের একটা অংশ মেনে নিয়েছে এই অলক্ষ্মী লক্ষ্মীদের। কানে নেকব্যান্ড, হাতের ল্যাপটপে টপাটপ। মুখে খই ফুটছে একালের লক্ষ্মীদের। হেভিওয়েট চাকরি সামলে আচ্চা-বাচ্চা-কাচ্চার ন্যাপি সামলাতেও ওস্তাদ এ যুগের লক্ষ্মীরা। জানেন, কোয়ালিটি টাইম কীভাবে কাটাতে হয় পরিবারের সঙ্গে।
জারা হটকে এ যুগের বঙ্গ ললনারা। লিভ ইন থেকে ‘লেফট’ করে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এ যুগের লক্ষ্মীরা রেলা দেখান। ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’ হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁরা অতটা শুদ্ধাচারিণী নন। বিয়ের বয়স তাই বাড়ে। চাকরি করতে দিতে হবে, এমন সিদ্ধান্তে সায় দিলে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। ডিভোর্সি হয়ে একক দায়িত্বে যেমন সন্তান সামলানোয় পাঙ্গা দেখায়, তেমনি দ্বিতীয় বিয়েতে প্রথম পক্ষের সন্তান থাকলে, তার দায়িত্বও বুঝিয়ে দেয় হবু হাজব্যান্ডকে।

আরও পড়ুন-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে দ্বিতীয়, প্রথম হওয়ার যুদ্ধে রাজ্য, সর্বাধিক কর্মসংস্থান

পোস্টারে লক্ষ্মী ছেলে
ছেলের সামনেও স্বয়ং ‘লক্ষ্মী’ দণ্ডায়মান। তাই বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই হয়েও ‘সরস্বতী ছেলে’ নয়, ‘লক্ষ্মী ছেলে’। আসলে, প্যায়সা কা কা‘মাল’। সরস্বতী লক্ষ্মীর সামনে নতশির। ট্যাঁকে বা বুকপকেটে, পার্সে বা গুগল পে-তে টঙ্কার ঝনঝনানি থাকলে স্বামী নামক আসামি থেকে ফ্যামিলিও ঝামেলিতে যায় না আজকাল। খঞ্জনা নদীতীরের অঞ্জনা নামের মেয়েটিকে মনে মনে গঞ্জনা দিলেও— মুখে কিন্তু ‘বউমা আমার লক্ষ্মী মেয়ে’।
একটু উলট কথায় আসি। সম্প্রতি রুপোলি আকাশে মুক্তির ডানা মেলেছে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি ‘লক্ষ্মী ছেলে’। কৌশিক-চূর্ণির নাড়িছেঁড়া ধন উজানই এ ছবিতে লক্ষ্মী মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে লক্ষ্মী ছেলে। ধর্ম এখানে পণ্য।
সমাজের বিধি মানলেই ‘লক্ষ্মী’। বিধির বাম-গতি হলেই কুলের অঙ্গার। ধর্মের দোহাই দেওয়া এ সমাজে কার হাতে থাকে আসল-নকল ‘লক্ষ্মী ছেলে-মেয়ে’দের বিচারদণ্ড? প্রশ্ন-জবাব দুটোই ছুঁড়েছেন পরিচালক।

আরও পড়ুন-ত্রিকোণ প্রেম! হরিদেবপুরের যুবক খুন, আটক বান্ধবী

ঋতুস্রাবে আচারের বয়াম ছুঁলে আচার-নিয়মের ব্যারাম ঘটে। ঠাকুরঘরে উঁকি-ঝুঁকি তো চাঁদ ছোঁয়ার শামিল। নজরুল কবি যতই ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’ বলে গালমন্দ করুন না কেন, জাত-পাতের মানদণ্ডে নিম্নবর্গীয় তকমা থাকলেই সে দুয়ার মাড়ালে হায় হায়…। তার ওপর ‘লক্ষ্মী ছেলে’র আবার দৈব অঙ্গ। সে যে খোদ ঈশ্বর। বিষ্ণুর অবতার। অথবা দেবী লক্ষ্মীর। সমাজের ধারণা, এ মেয়ে তো মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়!
সমাজের এমন মাথার ব্যামো সারাতে হাজির আবার ভিন ধর্মের মানুষ। এতটা সহ্য করতে পারে সমাজ? ‘লক্ষ্মী ছেলে’ আমির হুসেন তার প্রমাণ।
স্থান হিঙ্গলগঞ্জ। সেখানেই জন্ম নেয় চার হাত-ওয়ালা মেয়ে। শোরগোল পড়ে যায় আশেপাশের গ্রামে। মুশকিলটা হল, সেই দৈবী মেয়ের জন্ম হয়েছে এমন বাড়িতে, যে বাড়ি লোকে ছুঁৎমার্গের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যেত। দুয়ারে পা রাখা দূরস্থান, বাড়ির আশপাশেও ঘেঁষতেন না বাবু-বিবিরা। চার হাতের সেই কন্যাই পরিবারকে জাতে তুলল। নাম রাখা হল ‘লক্ষ্মী’। লক্ষ্মীর আশীর্বাদ নিতে গ্রামের পর গ্রাম ভিড় জমাল। পুণ্যার্থীদের টাকায় ফুলে-ফেঁপে উঠল গ্রামের মোড়লের ক্যাশবাক্স। এবং তারপর…
এবার না হয়, জনাকয়েক ‘বেয়াড়া লক্ষ্মী’র হদিস নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন-মালবাজারের ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে উঠে এল তথ্য

লক্ষ্মীরূপে কন্যাপুজো
কপালে চোখ তুললেন যে বড়! হ্যাঁ মশাই হ্যাঁ। এমনটাই নজির গড়েছেন নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের বিশ্বাস দম্পতি। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন নাড়িছেঁড়া ধনকে লক্ষ্মীরূপে পুজো করে অনন্য নজির গড়েছেন নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের শ্যামনগর গ্রামের বাসিন্দা দেবাশিস বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী মিতালী বিশ্বাস। এই দম্পতির একমাত্র কন্যা দেবাদৃতা। লক্ষ্মীপুজোর দিন লক্ষ্মী সাজিয়ে এক হাতে পদ্ম আর অন্য হাতে কলস নিয়ে রাজসিংহাসনে বসিয়েছেন বিশ্বাস দম্পতি। পুরোহিত ডাকিয়ে পুজোও করিয়েছেন। দুর্গাপুজোয় কুমারী পুজোর মতোই।
কেন এমন ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত? দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, সংসারে কন্যাই হল লক্ষ্মী। আর তাই লক্ষ্মী জ্ঞানে নিজের মেয়েকেই আমরা পুজোর আসনে বসালাম। কোন কন্যাকেই অবহেলা নয়। বরং কন্যা সন্তান লক্ষ্মী রূপে পূজিত হোক ঘরে ঘরে।’

আরও পড়ুন-পুলিশের প্রশ্নে চুপসে গেলেন সৌমেন্দু

স্বপ্নবাজ তাসলিমা
এ মেয়ের চোখে স্বপ্ন ছিল। পাথর ভাঙার স্বপ্ন। হতচ্ছাড়া মেয়েটি যতই গাল খায়, ততই সে তার হতচ্ছাড়া জীবনকে ভালবাসতে শেখে। উইকি থেকে গুগুল থেকে সে মেয়ে জানতে চায় আরও আরও। বরফের পাহাড়কে পায়ের ভৃত্য করে এগিয়ে চলে। হাসিল করে ডাক্তারি বিদ্যা। ক্যামেরা হাতে মৃত্যুকে পরোয়া না করে ‘এক্সক্লুসিভ’ ছবি তোলে। সে মেয়ে বলে, ‘নস্যির মতো যে সকল বাধাকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, ফুঁয়ের মতো বাতাসে উড়িয়ে দিতে পারে সেই মেয়েই এভারেস্ট জয় করে। সবাই পারে না কিন্তু কেউ কেউ পারে। বলছি না, সকল মেয়েকে এভারেস্টের চুড়ো ছুঁতে দিতেই হবে। একশোজনের মধ্যে অন্তত একজন স্বপ্নবাজ মেয়ের প্রয়োজন।’
এমন গভীর বিশ্বাসে বিশ্বাসী তাসলিমা আক্তার। প্রতিবেশী দেশের মেয়ে। চিকিৎসা বিদ্যার পাশাপাশি এমন ব্যতিক্রমী মেয়ের সাহিত্যচর্চাও চলে সমানভাবে।

আরও পড়ুন-বলি থেকে টলি বয়কট ট্রেন্ডে নাকাল সবাই

লক্ষ্মীরূপে কৃষ্ণকলি
জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘কৃষ্ণকলি’। মুখ্য চরিত্রে কৃষ্ণাঙ্গী শ্যামা। ঘরে ঘরে সিরিয়াল কিলার, থুড়ি সিরিয়ালের দর্শকদের মুখে ‘লক্ষ্মী মেয়ে’। আটপৌরে শাড়িতে, বিনুনিতে, কিন্নরকণ্ঠী এ মেয়েতে মন মজে। কিন্তু আদপে এ মেয়ে অমন ঘেরাটোপের জীবনে অভ্যস্ত নয়। বাস্তবে খুল্লমখুল্লা। কী পোশাকে, কী আশাকি কথায়।
অভিনেত্রী তিয়াশা রায়। ‘কৃষ্ণকলি’ ফিরেছেন ছোটপর্দায় ‘লক্ষ্মী’ হয়ে। বছরজুড়ে কম ঝক্কিঝামেলা যায়নি তাঁর ওপর দিয়ে। তবুও তিনি নিজেকে সামলে নিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় খোলামেলা পোশাকে হাজির ‘লক্ষ্মী মেয়ে’। বেশ ফুরফুরে মেজাজে তিনি। গুঞ্জন, তিয়াশা-সুভানের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে। ২০১৭ সালে তাঁরা বিয়ে করেছিলেন। তবে এই বিষয়ে মুখে কুলুপ।

আরও পড়ুন-সাহিত্যে নোবেল পেলেন ফরাসি সাহিত্যিক অ্যানি

পাওলিন লক্ষ্মী ঋতাভরী
ডাকনামে পাওলিন। মেধাবিয়ানায় এভারেস্ট ছুঁই ছুঁই। কলকাতার হরিয়ানা বিদ্যামন্দির থেকে সিবিএসসি বোর্ডে পড়াশোনা। ২০১১ সালে উচ্চমাধ্যমিকে সারা ভারতে প্রথম স্থান অর্জন। যাদবপুর ইউনিতে গ্র্যাজুয়েশন। বর্তমানে বেশ কিছু কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসডার। মডেলিং, ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। মায়ের সঙ্গে গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালান। পছন্দ টইটই করে ঘুরে বেড়ানোয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর হটেস্ট হট পোশাকে উপস্থিতি, নেটিজেনদের হৃৎপিণ্ডে হৃদকম্পন আনে। এমন বেয়াড়া মেয়ে কিনা লক্ষ্মীপুজোতেও সিদ্ধহস্ত। কবি, অভিনেত্রী, পরিচালক মা শতরূপা সান্যালকে ধনদেবীর আরাধনায় হাতে হাত মেলান। শাড়িতে হয়ে ওঠেন মোহময়ী। মুঠোফোনে লেন্সবন্দি করতে ভোলেন না মাকে। এমন মেয়ের গুণপনায় স্বয়ং লক্ষ্মী দেবীও না লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠেন!
পুরুষদের ক্রিকেট ম্যাচে প্রথম মহিলা রেফারি নামে লক্ষ্মী। জিএস লক্ষ্মী। প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার। ২০১৯ সালে তাঁর মুকুটে যুক্ত হয়েছে নতুন পালক। পুরুষদের একদিনের ক্রিকেট ম্যাচে প্রথম মহিলা রেফারি হিসাবে দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের দ্বিতীয় লিগের তৃতীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচে রেফারি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন লক্ষ্মী।

আরও পড়ুন-আটমাসের শিশুকন্যা-সহ ভারতীয় বংশোদ্ভূত চারজনকে অপহরণ করে খুন

শারজা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। সেখানে লক্ষ্মীর তত্ত্বাবধানে খেলেছিল সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্মীর কেরিয়ারে এটি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এর আগে ওই বছরই মে মাসে আইসিসি ম্যাচ রেফারিদের ইন্টারন্যাশনাল প্যানেলে প্রথম মহিলা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।
ছোট্ট থেকেই টম বয়। ব্যাটে-বলের ঠোকাঠুকিতে নিত্য অভ্যস্ত। কলেজে ভর্তি হওয়াও ক্রিকেটের হাত ধরেই। লক্ষ্মীর কথায়, ‘‘দাদা আর বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতাম। আমার একটা ন্যাচারাল বোলিং অ্যাকশন ছিল। সেটা দেখেই কলেজ আমায় ভর্তি করে নেয়। তার পর থেকে প্রায় দু-দশক ধরে ঘরোয়া ক্রিকেটে আমার রাজ্যের হয়ে খেলেছি।’’
এমন লক্ষ্মীরা ঘরে ঘরে জন্ম নিক। দাপট দেখাক। আগল ভাঙুক। অচলায়তনের রুদ্ধদ্বার খুলুক। আজকের লক্ষ্মীরা যে রক অ্যান্ড রোল। তাদের হৃদয় শুধু যুথী অনাঘ্রাতা হয়েই রূপকথার ভোমরার মতো বাঁচবে, এ কথা আজ রূপকথার মতোই।
আকাশে-বাতাসে লক্ষ্মী মেয়ের যে আর কোনও লক্ষ্মণরেখা নেই।

Latest article