কথামুখ
ফণিভূষণের স্ত্রী মণিমালিকা স্বামীকে ঢাকাই শাড়ি এবং বাজুবন্ধ জোগাবার-যন্ত্র বলেই মনে করতেন। মণিমালিকা শুধুই নিতেন, প্রতিদানে স্বামীকে কিছুই দিতেন না। তাঁর নিরীহ স্বামী ভাবতেন দানই প্রতিদান পাওয়ার উপায়। ফণিভূষণের ব্যবসায় হঠাৎ একটি ফাঁড়া উপস্থিত হল। ফণিভূষণ মণিমালিকার কাছে কয়েকদিনের জন্য গহনা চাইলেন। কারণ গয়না বন্ধক রাখলে অনেক টাকা মিলবে। কিন্তু গয়না যে মণিমালিকার প্রাণ। তাই দিতে অস্বীকৃত হলেন। অগত্যা অন্য উপায়ে টাকা সংগ্রহে ব্যস্ত হলেন ফণিভূষণ। অর্থ সংগ্রহের পর দিন দশেকের জন্য ফণিভূষণ গেলেন শহরে। মণিমালিকার ধারণা হল পরে হয়ত তাঁর স্বামী এই গয়নায় হাত দেবেন। তাই মধুসূদনকে নিয়ে মণিমালিকা পিত্রালয় রওনা হলেন।
আরও পড়ুন-“ভানুমতীর স্বয়ম্বর”
ফণিভূষণ ফিরে এলেন। এসে দেখলেন বাড়িতে তাঁর স্ত্রী নেই। স্ত্রী-বিহনে যখন ফণিভূষণ একাকী, তখন এক রাত্রে স্ত্রীর আসা যেন অনুভব করলেন ফণিভূষণ। ফণীভূষণের আনা গয়নার উপর আচমকা হাত এসে পড়ল এক কঙ্কালের। সেটি হল মণিমালিকার। এমন এক অতিপ্রাকৃত গল্প লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গল্পগুচ্ছের অন্তর্গত সাড়া জাগানো গল্পের নাম ‘মণিহারা’। ১৯৬১ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে নানান কর্মকাণ্ড চলছে, তখন বরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের তিনটি নায়িকাপ্রধান ছোটগল্প নিয়ে নির্মাণ করলেন এক অসাধারণ চলচ্চিত্র। তার নাম ‘তিন কন্যা’। তিনটি গল্পের অন্যতম হল ‘মণিহারা’। অপর দুটি গল্প হল ‘সমাপ্তি’ ও ‘পোস্টমাস্টার’। মণিহারা ছবির জন্য সত্যজিৎ রায় নিয়ে এলেন এক নতুন নায়িকাকে। তাঁর নাম কণিকা মজুমদার। ডাগর দুটি চোখ, নিটোল নাক, স্লিম চেহারা নিয়ে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন কণিকা। প্রথম চরিত্রটি নেগেটিভ রোল। তবু দর্শকদের তিনি টানতে পারলেন, তার মূলে রয়েছে কণিকার অসাধারণ অভিনয়-ক্ষমতা। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় পাশে সমান দাপটের সঙ্গে মণিমালিকা চরিত্রে অভিনয় করে তিনি অভিনয়জীবনের যাত্রা শুরু করলেন। দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা পেলেন কণিকা।
আরও পড়ুন-খোলা চিঠি
জন্মকথা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
কণিকা মজুমদারের জন্ম ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহ জেলায়। ম্যাট্রিক পাশ করার পরে বিয়ে হয়ে যায়। গোঁড়া ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে বলে অভিনয়ের প্রতি দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও ছবিতে কাজ করতে পারেননি। এমনকী বিখ্যাত পরিচালক নীতিন বসুর ছবিতে কাজ করার সুযোগও গ্রহণ করতে পারেননি। তবে আরেক ব্রাহ্ম সত্যজিৎ রায়ের ডাককে উপেক্ষা করতে পারেননি। ফলে প্রথম আত্মপ্রকাশ সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’ ছবিতে। নাচ জানেন, গান জানেন, ছবি আঁকতে জানেন, সেন্ট এন্ড্রুজ কেজি স্কুলের শিক্ষিকার কাজ করেছেন বেশ কিছুদিন। কিন্তু টান অভিনয়ের দিকে। ফলে ছবির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়লেন কণিকা মজুমদার।
আরও পড়ুন-টেলি-ইন্ডাস্ট্রিতে জোয়ার, সরগরম টেকনিশিয়ানস স্টুডিও
অভিনয়জীবনের জয়যাত্রা
কণিকা মজুমদারের দ্বিতীয় ছবি মৃণাল সেন পরিচালিত ‘পুনশ্চ’। তাঁর বিপরীতে নায়ক হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তৃতীয় যে ছবিতে তিনি নায়িকা হলেন তার নাম ‘অগ্নিশিখা’। ছবির পরিচালক হলেন রাজেন তরফদার। বিপরীতে নায়ক বসন্ত চৌধুরি। বসন্ত চৌধুরির বিপরীতে তিনি আবার নায়িকা হলেন ‘সঞ্চারিণী’ ছবিতে, যার পরিচালক সুশীল মজুমদার। তিনি নায়িকা হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে আবার ‘আগুন’ ছবিতে। পরিচালক অসিত সেন। ঋত্বিক ঘটকের চিত্রনাট্যে শক্তিপদ রাজগুরুর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘কুমারী মন’ ছবির নায়িকাও কণিকা মজুমদার। ‘কাঞ্চনকন্যা’ ছবিতে কণিকা মজুমদারের বিপরীতে নায়ক হলেন সত্যজিৎ রায়ের আরেক সৃষ্টি অরুণ মুখোপাধ্যায়। এর মধ্যে কুমারী মন এবং অগ্নিশিখা ছবি দুটিতে কণিকা অভিনয় প্রতিভার বিশেষ নজির রেখেছেন।
আরও পড়ুন-কপ্টার ভেঙে মৃত ১৪
উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর কাজ
উত্তমকুমারের জীবদ্দশায় যে অভিনেত্রী উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করলেন না, তাঁর অভিনয়জীবন খানিকটা বৃথাই বটে। কণিকা মজুমদারের ক্ষেত্রে অবশ্য সে আক্ষেপ নেই। কারণ উত্তমকুমারের বিপরীতে কণিকা প্রথম যে ছবিতে কাজ করলেন তা সুপার ডুপার হিট ছবি। ছবির নাম ‘দুটি মন’। পরিচালক পীযূষ বসু। কণিকা মজুমদার অনাবৃত পিঠে খাটে শুয়ে আছেন উত্তমকুমারের জন্য। এমন দৃশ্য প্রথমে সেন্সর থেকে আটকে দিয়েছিল। পরে অবশ্য সে-দৃশ্য বহাল রেখে প্রাপ্তবয়স্কদের ছবি (এ সার্টিফিকেট নিয়ে) হিসেবে ‘দুটি মন’ মুক্তি পেল ১৯৭০ সালে। রুদ্রকান্তর চরিত্রে উত্তমকুমার এবং নীলিমার চরিত্রে কণিকা মজুমদার প্রাণবন্ত অভিনয় করেছিলেন। কণিকা-উত্তমের যৌনমিলনের দৃশ্যগুলির টানেই ছবিটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। কণিকার আরেক স্মরণীয় অভিনয় ‘হার মানা হার’ ছবিতে। সেখানে সুচিত্রা সেন নায়িকা নীরার চরিত্রে।
আরও পড়ুন-মাঝ আকাশে বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি, রক্ষা ২২২ যাত্রীর
উত্তমকুমার বিনোসেনের চরিত্রে আর প্যারালাল নায়িকা প্রতিমার ভূমিকায় কণিকা মজুমদার। আবার নেগেটিভ রোল। কাহিনিকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিচালক সলিল সেন। কণিকার আক্রোশে সুচিত্রা-উত্তমের জীবন কীভাবে তছনছ হয়ে যাচ্ছে এমন মর্মান্তিক কাহিনি নিয়ে হার মানা হার ছবিটি। সুচিত্রা-উত্তমের সঙ্গে কণিকাকে আবার পাওয়া যায় বিজয় বসু পরিচালিত ‘নবরাগ’ ছবিতে। সময় থাকতে থাকতে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিলেন কণিকা। সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে (কাহিনিকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়) তিনি অভিনয় করলেন দময়ন্তীর চরিত্রে। এখানেও উত্তমকুমারকে কণিকা পেলেন। উত্তমকুমার সেখানে ব্যোমকেশের চরিত্রে। ছবিটির সাসপেন্স উত্তম-কণিকা পর্বেই। অগ্রগামী পরিচালিত ‘বিলম্বিত লয়’ এবং অগ্রদূত পরিচালিত ‘সোনার খাঁচা’ ছবি দুটিতেও কণিকা চরিত্রাভিনয়ের নানা দিক তুলে ধরেছিলেন। দুটি ছবিতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন উত্তমকুমার।
আরও পড়ুন-ঋষিকে প্রধানমন্ত্রী পদে মানতে রাজি নন বরিস
অন্যান্য ছবিতে
তাঁর অভিনয়
কণিকা মজুমদারের অপর কয়েকটি ছবি হল যথাক্রমে বসন্ত বিলাপ, রাগ-অনুরাগ, তিলোত্তমা, প্রিয়তমা, জন্মভূমি, শর্মিলা, রানুর প্রথম ভাগ, বন্দি বিধাতা, চাঁদের কাছাকাছি, জীবন সৈকতে, সোনা বৌদি, পৃথিবীর শেষ স্টেশন, প্রথম প্রেম, ছন্দনীড়, মন্দির, দুষ্টুমিষ্টি ইত্যাদি ছবি।
মঞ্চাভিনয়ে কণিকা মজুমদার
ছবিতে কাজ করতে করতেই তিনি পেশাদারি মঞ্চে অভিনয়ের জন্য ডাক পেলেন। একসময় বিশ্বরূপা থিয়েটারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন কণিকা। ‘হাসি’ নাটকে তৃপ্তি মিত্রের পাশে কণিকা। ‘ঘর’ নাটকে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের পাশে কণিকা। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ নাটকে সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে কণিকা। এ-নাটকে লক্ষ্মীর চরিত্রে কণিকা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুপ্রিয়া দেবীর প্রথম মঞ্চে অভিনয় ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ নাটকে। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নাটকে পটেশ্বরীর চরিত্রে সুপ্রিয়া, ‘জবা’র চরিত্রে কণিকা। ‘কোথায় পাব তারে’ এবং ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ নাটকদুটিতেও অভিনয় করলেন কণিকা। সব ক’টি নাটকই অভিনীত হয়েছে বিশ্বরূপা থিয়েটারে। সুকণ্ঠের জন্য কণিকা মজুমদার নিয়মিত নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন রেডিওর নাটকগুলিতে। বিপরীতে তিনি কখনও পেয়েছেন নির্মল কুমারকে কখনও-বা প্রেমাংশু বসুকে।
আরও পড়ুন-ঋষিকে প্রধানমন্ত্রী পদে মানতে রাজি নন বরিস
শেষ সময়ের কথা
একটা সময় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন অভিনয়ের সব মাধ্যম থেকে। কোনও সাক্ষাৎকার বা অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন না। তিনি শেষ জীবনটা কাটিয়ে ছিলেন অস্তরাগ নামের এক বৃদ্ধাশ্রমে। স্মৃতি সততই সুখের— এই আপ্তবাক্যটা হয়তো সত্যি। একটা সময় তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলাম কলকাতা দূরদর্শনের ক্লোজআপ অনুষ্ঠানের জন্য। গিয়েও ছিলাম সেই অস্তরাগে। কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হল গিরিশচন্দ্রের সেই বিখ্যাত কথা ‘দেহপট সনে নট সকলি হারায়’। চুল সব সাদা হয়ে গিয়েছে। দাঁত পড়ে গেছে। চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা। কেন তিনি বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন, তার উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন— মেয়ে তাঁকে বিদেশে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেও তিনি সেখানে যেতে চাননি। তাই তিনি রয়ে গেছেন এই অস্তরাগ বৃদ্ধাশ্রমে। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৮৪ বছর বয়সে কণিকা মজুমদার পরপারে চলে গেছেন। তিনি চলে গেছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর স্মরণীয় কিছু অভিনয় আমরা— তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের দর্শকেরা অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব।