বিজেপি বণিকের পার্টিই বটে। সুনিপুণ দক্ষতায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশের তকমা সরিয়ে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার একের পর এক কৌশল অবলম্বন করে চলছে চরম দুঃসাহসিকতায়। ঠিক যেমন পন্থা ইংরেজরা নিয়েছিল। ব্যবসার ছদ্মবেশে উপনিবেশের ছক সাজানো ছিল। অমনি বিজেপিও মনুসংহিতার প্রয়োগে দেশে ধর্ম ব্যবসার ফাঁদ পেতেছে।
আরও পড়ুন-বামেরা আগে নিজেদের দুর্নীতিটা দেখুক
বলা হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র আমাদের এই ভারতবর্ষ। যার মন্দির মসজিদ চার্চ গুরুদুয়ারা যাই বলুন, সেটা যদি পার্লামেন্ট অর্থাৎ সংসদ ভবন হয় তো দেবতার নাম সংবিধান। এই সংবিধানের শপথ নিয়ে সংসদ ভবনে ভারতবাসী তথা নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধেয়দের সুরক্ষাপ্রদানের নীতি তৈরি হয়। যেখানে চলে না কোনও ধর্মীয় আচার, কোনও জাতিগত বৈষম্য, কোনও ভাষার অগ্রাধিকার। ভারতীয় পার্লামেন্ট বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যকে ধরে রাখার ধাত্রীভবন।
আরও পড়ুন-সিসিটিভি ফুটেজে কোন্নগরের মানুষ দেখল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের নমুনা
কিন্তু গতকাল আমরা কী দেখলাম, সংবিধানের মূল কাঠামোর উপর আঘাত হেনে প্রধানমন্ত্রী নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করলেন হিন্দু সাধুসন্ত পরিবৃত হয়ে। হিন্দু আচার রীতি মেনে পুজো মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে সাধুরা নরেন্দ্র মোদির হাতে তুলে দিলেন সেঙ্গল অর্থাৎ রাজদণ্ড। আমি স্তম্ভিত। ভাষাহীন। এটা কী হচ্ছে ? এমন করে স্বাধীনতা উত্তর ইতিহাসে পড়া রাজার অভিষেক হত এভাবে। এ কী অনাচার!! গণতান্ত্রিক দেশে রাজতান্ত্রিক ভন্ডামির নির্লজ্জ নিদর্শনের সাক্ষী রইল দেশ।
আরও পড়ুন-সাক্ষীদের পাশে কুম্বলে-ভাজ্জি
এরা এতটাই সাম্প্রদায়িক যে আইনসভার বিল আইন হয়ে সংবিধানে যুক্ত হয় যাঁর হাত দিয়ে সেই মহামান্য রাষ্ট্রপতিই নতুন আইনসভা উদ্বোধনে নিমন্ত্রিত নন। কী করে হবেন নিমন্ত্রিত… এক তো উনি মহিলা, দ্বিতীয়ত, উনি হিন্দু তো ননই, বরং দলিত সম্প্রদায়ের। আর এই মুসলিম, দলিত, আদিবাসী এরা বিজেপির চক্ষুশূল। হিন্দু বাদে সকল ধর্ম জাতই ওদের কাছে মানুষ নয়।
ভাবতে ঘৃণা বোধ হয় যে এমন অশিক্ষিত, অসভ্য, বর্বর, কট্টর সাম্প্রদায়িক এজেন্ডানির্ভর একটি রাজনৈতিক দল ভারত শাসন করছে। যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হিন্দুত্বের মহিমাকীর্তন। হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানের এজেন্ডায় জারিত এরা। কট্টরতায় দেশের ঐক্যকে প্রতিনিয়ত এরা পায়ের তলায় পিষে ধর্ম জাতির ভেদাভেদ করে চলেছে। গান্ধী, নেতাজি, নেহরু, প্যাটেলদের সর্বধর্মসমন্বয় সমৃদ্ধ উদারতার লেশমাত্র নেই এদের ভিতর।
আরও পড়ুন-এটাই অবসরের সেরা সময়, কিন্তু…আর একটা বছর, আমার উপহার: ধোনি
গতকাল সকালেই কাগজে দেখেছি দিল্লি ইউনিভার্সিটি তাদের পাঠক্রম থেকে উর্দু কবি মহম্মদ ইকবালকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব এনেছে। যাঁর লেখা বিখ্যাত গান ‘‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা”… দেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে এখনও। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই গানটি। কিন্তু এই ভণ্ড হিন্দুবীরদের সেটা পছন্দ নয়। কারণ দেশভক্তির ঠেকা ওদেরই কুক্ষিগত একটা ধারণা। সেখানে মুসলিম মানেই দেশদ্রোহী। তাই লাও প্রস্তাব। মুছে বাদ দাও যেখানে যত মুসলিমের কীর্তি। যার সূচনা হয়েছিল বাবরি মসজিদকে গুঁড়িয়ে, শেষ হবে হয়তো দেশকে টুকরো টুকরো করে।
এদের কীর্তিকলাপ তালিবানি জঙ্গিদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। বামিয়ান উপত্যকায় ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মর্যাদাপ্রাপ্ত বিশালাকার বুদ্ধমূর্তিগুলোকে একসময় ধ্বংস করেছিল ওরা। আসলে ধর্মকে ব্যবহার করে যারা ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছতে চায় তাদের ভিতরে মনুষ্যত্ব, ন্যায়নীতির কোনও স্থান নেই। আছে শুধু হিংসার দ্বারা ভয় ভীতির সঞ্চার করে মানুষকে উত্ত্যক্ত করার এক অদম্য স্পৃহা।
আরও পড়ুন-সই চাওয়ায় ধোনি অবাক হয়েছিল: সানি
তবে এটা বলাই যায়, হিন্দুরাষ্ট্রের বীজ রোপণ করার আরও কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করা হয়ে গেল। এদের থেকে দেশ ও দেশবাসীকে বাঁচাতে গেলে চব্বিশের নির্বাচন ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছে। এই নির্বাচনে আপন স্বার্থ সরিয়ে দেশের স্বার্থরক্ষায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোটই একমাত্র উপায় এই ভণ্ডদের সরানোর জন্য।
আজ শুধু মনে পড়ছে, এদেশ স্বাধীন করতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়ার সেই আগুনে দিনগুলোয় মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া সংগ্রামীদের কথা, যাঁদের বলিদান এদেশের মাটিতে লেখা আছে…
ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
সত্যিই পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষায় দেশকে বাঁচাতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়েই লড়তে হবে। ঠিক যেভাবে ইংরেজদের থেকে রাজদণ্ড কেড়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে সেকুলার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গোটা বিশ্বের সম্মান আদায় করে নিয়েছি আমরা। মুছে ফেলা যাবে না সেই ইতিহাস।