মুসলিমদের উৎসবের ইতিবৃত্তে দুই ইদের উপস্থিতি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য— ইদ-উল-ফিতর ও ইদ-উল-আজহা। ইদ-উল-ফিতরে মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের বৈচিত্র্য যেমন রান্নাঘরের শোভাবর্ধন করে তেমনই ইদ-উল আজহায় (বকরি ইদ) মাংসের নানা লোভনীয় পদ। ইদ হেঁশেলের নারীর ব্যস্ততা ও তাঁদের হাতে তৈরি লা-জবাব খানার কথা লিখলেন সামিমা মল্লিক
রসনা, রসুই আর রমণী— এই ত্রয়ী শব্দবন্ধ যেন এক অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ত্রিবেণী কেশবিন্যাসের ন্যায় গ্রন্থিত। রসনা পরিতৃপ্তি নিমিত্তে রসুইয়ে আর রসুইয়ে প্রাণসঞ্চারণ হল রমণী। বলা যায়, এই তিন শব্দের সম্মিলিত স্বাদ ও সুগন্ধের মূর্ছনা আমাদের জিহ্বা তথা চেতনাকেও আবিষ্ট করে যখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কোনও পালপার্বণ উঁকি মারে।
আরও পড়ুন-ফ্রক পরিহিতা অমলা
অন্তঃপুরচারী মুসলমান নারীদের ইদের প্রস্তুতি ও রসুই ঘরে তাদের রান্নার ব্যঞ্জনাদির রকমফের সম্বন্ধে আমরা খুব কমই জানি। মুসলমানদের খুশির উৎসবের ইতিবৃত্তে দুটি ইদের উপস্থিত অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য— ইদ-উল-ফিতর ও ইদ-উল-আজহা। দুটি ইদেই নানান সুস্বাদু রসনাতৃপ্তির জন্য রান্নাবান্না হয়। ইদ-উল- ফিতরে মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের বৈচিত্র্য যেমন রান্নাঘরের শোভাবর্ধন করে তেমনই ইদ-উল-আজহায় (বকরিদ) মাংসের নানা লোভনীয় পদ খাদ্যরসিক তথা খাদ্য বেরসিককেও প্রলুব্ধ করে।
আরও পড়ুন-ভাল নেই বিশ্বের বিধবারা
বকরিদের রান্নার প্রস্তুতি চলে দু’দিন আগে থেকেই। বাড়ির মেয়ে-বউরা রান্নাঘরের সমস্ত বড় বড় তিজেল ও তামার পাতে মোড়া সাবেকি হাঁড়ির সম্ভার ভাঁড়ার ঘর থেকে বার করে তা পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে নেয়। অন্দরে ব্যবহৃত রান্নাঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আসন্ন ইদের খাদ্য প্রস্তুতির আনুসঙ্গিক মশলাপাতি, তেল ও প্রয়োজনীয় নানা উপকরণ তারা ফর্দ করে আনিয়ে রাখে। কারণ, বকরিদের বিপুল রান্নার আয়োজন অর্থাৎ সমরাঙ্গনে সব্যসাচীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যুদ্ধবিজয়ী হওয়ারই সমতুল্য। আশপাশে প্রতিবেশিনীদের মধ্যে যারা রান্নায় সাহায্য করতে পারবে তাদেরও অগ্রিম বলে রাখা হয়। হাঁড়ি, কড়াই, হাতা, খুন্তি, তেলমশলা, বাসমতী চাল, মেঝেতে পাতার বড় প্লাস্টিক, পেপার কাপ, প্লেট সবই বাজার থেকে আনিয়ে রাখা হয়।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতের প্রচারে কাল কোচবিহারে মুখ্যমন্ত্রী
আসন্ন বকরিদের পূর্বদিনের রাত্রেই মেয়েরা চালের গুঁড়ো দিয়ে ‘খামির’ করে চালের আটার নিটোল নিখুঁত গোল গোল রুটি প্রস্তুতে ব্যস্ত থাকে। একসঙ্গে অনেক মেয়ে বসে উৎফুল্ল মেজাজে গল্প, রঙ্গ-রসিকতা করতে করতেই রুটির পাহাড় বানিয়ে নেয়। পরের দিন সেই রুটি যেন দীর্ঘক্ষণ নরম ও ভাল থাকে তার জন্য পাতলা কাপড়ের আচ্ছাদন দিয়ে তা সংরক্ষিত করা থাকে। এরপর নারকেল নিঃসৃত দুধ বার করে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে ফ্রিজে রাখা থাকে। যেন পরের দিন ভোরে নানাধরনের সিমুই রান্নায় নারকেল দুধ ব্যবহারে সিমুইয়ের স্বাদে উৎকর্ষ বৃদ্ধি করতে পারে। খাদ্য বৈচিত্র্যে মুসলমান হেঁশেলের আপাত সাধারণ নারীরাও উৎসবের দিন তাদের প্রাত্যহিক ব্যবহৃত প্রিয় রান্নাঘরের একমেবাদ্বিতীয়ম অধীশ্বরীতে রূপান্তরিত হয়। এদের হাতের অদৃশ্য জাদুর স্পর্শে প্রতিটি রান্না যে কোনও পাঁচতারার শেফের প্রতিপক্ষতাকেও হারাতে পারে। এই ইদের দিনে কোনও কোনও বাড়িতে রন্ধনপটীয়সী মহিলারা ‘জালি পরোটা’ বা ‘চিটা রুটি’ বানায়। সুগন্ধী আতপ চাল ও ময়দার মিশ্রণে তৈরি, প্রায় তেলবিহীন শুভ্র, মিহি রেখাচিত্রের ন্যায় আলপনার আকারে এই পরোটাগুলোর অভিজাত্য ও সৌন্দর্য খাদ্যরসিকের থালায় নজর কাড়ে। বাড়ির মায়েদের কত সাবেকি রান্নার রেসিপি গুপ্তকুঠুরিতে লুণ্ঠিত মহামূল্যবান সম্পদের মতো যে রাখা ছিল— তা এই দিনগুলোয় রন্ধনের আত্মলুব্ধকারী সুগন্ধেই অনুভূত হয়।
আরও পড়ুন-বাহিনী দিতে ব্যর্থ কেন্দ্র, বিজেপির নাটক, কোর্টে ধাক্কা
বকরিদের দিনে প্রথমেই যে রান্না বাড়ির সকলের জন্য প্রস্তুত করা হয়, তা হল ‘কালো ভুনা’। গরম তেল সোনালি বেরেস্তার অহঙ্কারে, আদা রসুনের রস আর টকদইয়ের আদর মেখে, ফিউব আকারে কার্তিক মাসে যখন মাখো মাখো একটা সম্পর্ক গড়ে বেরেস্তার সঙ্গে সখ্যতা বাড়ায়— ঠিক তখনই গোটা গোলমরিচ ও সোয়াসস, গোটা গরমমশলা ও তাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে মাংসের সুগন্ধ আরও বাড়িয়ে দেয়। এরপর আদা সরু ফালি ফালি করে কেটে রান্নায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সব শেষে একটা জলন্ত অঙ্গারে ঘি ও লবঙ্গ দিয়ে রূপালি তবকে রেখে পরিপূর্ণ সিদ্ধ কালাভুনার মধ্যে দিয়ে ঢাকনা চাপা দেওয়া হয়। যেন ধূমায়িত প্রহেলিকার অন্তরালে আবছা কালো পাহাড়। রাঁধুনির অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা যেন সোনায় সোহাগা— ভিন ভিনে আত্মলুব্ধকারী সুগন্ধে রান্নাঘরে তাণ্ডব— তার ওপর রান্নাঘরের একদিকে লা জবাব নানা কাবাবের আয়োজন চলে। তবে সামি কাবাবের চাহিদাই এই দিনে সর্বাপেক্ষা বেশি থাকে। রান্না মাংসে ও ছোলার ডালের বৈরিতাকে যেন প্রেসার কুকারের এক সিটির ধাক্কায় অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্ক তৈরির ষড়যন্ত্র করে সেদ্ধ মাংস ও ছোলার ডালকে মিক্সারে কাবাবচিনি, গোলমরিচ, শুকনো লঙ্কা, নুন, আদা, রসুন ও গোটা ধনে, জিরের মিশেলে পিষে ফেলে এক অবিভেদ্য পেস্ট করা হয়। স্বাদ ও বন্ধনের অটুট অবস্থানের জন্য ডিমের সগর্বে প্রবেশ— নিপুণ হাতে চ্যাপ্টা আকার আর কাবাবের পেটের মধ্যে মিহি পেঁয়াজ ও লঙ্কার তীব্রতায় লেবুর রসের সামান্য ইলশেগুঁড়ির ফোঁটা— প্রস্তুত মসৃণ, বাদামি গোলাকার সামি কাবাব।
আরও পড়ুন-রক্ত যাক, দেশের জন্যে লড়ব: বৈঠকের পর বার্তা তৃণমূল নেত্রীর
অতিথি অ্যাপায়নের জন্য মাংসের রেওয়াজি রেজালাও মুসলমান রান্নাঘরের এক অনন্য সংযোজন। ঈষৎ সাদা থকথকে মিশ্রণের মধ্যে নরম হাড়যুক্ত মাংসের উঁকিঝুঁকি— ইন্দ্রিয় অবশ করে দেওয়া সুঘ্রাণ— গোটা মশলা ব্যবহৃত এই ব্যঞ্জনটি ইদের হেঁশেলের বিশেষ স্থানাধিকার করে রেখেছে আবহমান কাল থেকেই।
এবার বলি, মাংস সংরক্ষণের লুপ্তপ্রায় কিছু সাবেকি প্রক্রিয়ার কথা। তেলে ফেলা মাংস, মরিচ মাংস বা জ্বাল দেওয়া মাংসের কথা শুধুমাত্র মুসলমান রান্নাঘরের নিজস্ব অপ্রকাশিত কিছু রেসিপি। বাড়ির মেয়েরা যেন দীর্ঘমেয়াদি সখ্যের চুক্তি করে নেয় মাংসের সঙ্গে। বড় তিজেল হাঁড়িতে অধিক পরিমাণে তেল দিয়ে তাতে নুন ও লঙ্কার গুঁড়ো ও রসুনবাটা দিয়ে মাংসগুলো ঢেলে প্রায় দু-তিন ঘণ্টা উনুনে জ্বাল দেওয়া হয়। অথবা শুধুমাত্র হলুদ ও নুন দিয়ে মাংস জ্বাল দেওয়া হয় দীর্ঘক্ষণ। দুই তিন দশক আগেও ফ্রিজের ব্যবহার গ্রামগঞ্জে ছিলই না। সেই প্রাচীন সময় থেকেই এই পদ্ধতির ব্যবহারে মাংস দীর্ঘদিন সংরক্ষিত হতে। সেই পদ্ধতির অনুসরণ আজও অব্যাহত।
আরও পড়ুন-ভয়াবহ বন্যা অসমে, সরানো হল লক্ষ লক্ষ বাসিন্দাকে
ইদের দিনে আরও নানান রান্না ও ঝঞ্ঝাট সামলে, সন্ধেবেলায় প্রায় নিঃশেষিত প্রাণশক্তি নিয়ে কচিকাঁচাদের নিয়ে বাড়ির মেয়েরা কাঠকয়লার উনুনের সামনে সোৎসাহে বসে যায় শলাকাবিদ্ধ মাংসের দগ্ধকরণে। যার পোশাকি নাম শিক কাবাব। হালকা থেঁতো করা মাংস, পেঁপের রস, লেবু, গোলমরিচ, নুন ও তেলের সংমিশ্রণ শিকে গেঁথে গনগনে আগুনে পোড়ানো। এই তন্দুরি সুঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে সমগ্র ইন্দ্রিয় আচ্ছন্ন করে। গোধূলির অস্তগামী আরক্তিম আকাশ আর লেলিহান শিখায় শিকের কাবাবের আত্মাহুতি যেন মজলিশি সন্ধ্যার বৈঠকের সৌন্দর্যে সঠিক উদরপূর্তির আয়োজন। নরম লাচ্চা পরোটা সহযোগে ক্লান্ত সন্ধেবেলায় সকলে গোল হয়ে বসে যখন এই শিক-পরোটার আস্বাদ গ্রহণ করে তখন চোখে-মুখে এক অপার্থিব তৃপ্তি তাদের সারাদিনের ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন-প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের নয়া দাবি
বাড়ির পরিবার-পরিজন ও অতিথিদের এই সন্তুষ্টি ও তৃপ্তিপ্রদানকারী অন্তঃপুরচারিণী নারীরা তখনও ব্যস্ত থাকে হেঁশেলের হাঙ্গামা সামলাতে, রান্নাঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়, গোলাপি শাহি শরবত প্রস্তুতে অথবা মাংস বিলিবণ্টনের মাত্রানিরূপণে।
দিনভর স্বতঃপ্রণোদিত আত্মনিয়োগেও যেন ক্লান্তি নেই তাদের — নেই ফুরসত — তারা নিজেরাও বোধ করি যেন চায় না, বয়ে যাওয়া দিনটার সমাপ্তি। যোদ্ধার আনন্দ রণক্ষেত্রে পারদর্শিতায় জয়ী হওয়ায়, রান্নাঘরে রমণীদের তৃপ্ততা তেমনি অন্যের রসনাতৃপ্তির সন্তোষসাধনে। অপ্রতিরোধ্য মানসিক বলে একচ্ছত্র রসুইঘরে— হাতা-খুন্তিকে অবলম্বন করে উনুনে আতপের সঙ্গে যুদ্ধ করে, আপন সৃজনস্পর্ধায় সৃজিত করে নানা রসনাতৃপ্তির ব্যঞ্জন। বলা বাহুল্য, নিপুণ হস্তদক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ভালবাসা ও মনের মাধুরী রমণীর রসুইঘরের রসনাতৃপ্তির অদৃশ্য উপকরণের রহস্য বা মশলা— যা আমাদের গতানুগতিক স্বাদহীন, পানসে জীবনের উদ্দীপক—বাঁচার প্রেরণা ও মাধুর্য।