শনিবারের রাত। ঘড়ির কাঁটা ৯টা ছুঁই-ছুঁই। প্রত্যয়ী এক যৌবন নিষ্ক্রান্ত হল সিবিআই জেরার শেষে। টানা সাড়ে ৯ ঘণ্টা জেরার পর। চেহারায় এতটুকু ক্লান্তির ছাপ নেই। যেটা আছে, চোখে-মুখে শরীরী ভাষায়, সেটা হল হার না-মানা জেদ, মিথ্যার বেসাতি না-করা প্রতিস্পর্ধা, আপস না-করতে চাওয়া অকুতোভয় হিম্মত।
এক কথায় উপস্থিত সাংবাদিককুলকে জানিয়ে দিলেন সাড়ে ন’ঘণ্টা ধরে চলা নাটকের নির্যাস।
‘‘শূন্য। অশ্বডিম্ব। যাঁরা ডেকেছিলেন আমাকে, তাঁদেরও সময় নষ্ট হয়েছে, আমারও।”
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee)। বাংলার নবজোয়ারের গণপ্লাবন যাঁকে অভিযাত্রায় অভিষিক্ত করছে রোজ, সেই অনতশির যুবনেতা। তৃণমূল কংগ্রেসের আগামী। তিনি স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কেন নবজোয়ারের পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচি স্থগিত রেখে তিনি ছুটে এসেছেন সিবিআইয়ের প্রশ্নের সামনে।
‘‘সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছি। বিচারাধীন হলে তো আর আসার দরকার পড়ে না। তাও এসেছি।”
দিল্লির পোষা কুকুর নয়, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের নির্দ্বিধ উচ্চারণ। অস্পষ্টতাহীন দার্ঢ্য। ধোঁয়াশা-মুক্ত বিবৃতি। বুঝিয়ে দেওয়া, চাইলে আড়াল নিতে পারতাম, খেলতে পারতাম লুকোচুরি, কিন্তু আমি তো নির্দোষ, তাই আমার আবডালের দরকার পড়ে না।
উন্নত শির যৌবনের হিম্মত হ্রেষা।
শাণিত যুক্তি আর প্রতিস্বিক প্রতি-প্রশ্নের স্পষ্টতা। এই তাঁর হাতিয়ার। প্রতিটি শব্দে বুঝিয়ে দিলেন, এই অভিমন্যু চক্রব্যুহ ভাঙতে শিখে গিয়েছেন রৌদ্রের কাছে, ঝড়ের কাছে, জনতার ঢেউয়ের কাছে থাকতে থাকতে।
শনিবার রাতে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে নবজোয়ারের কান্ডারি বুক চিতিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের যা বললেন, তার চুম্বক এরকম :
তৃণমূলের নবজোয়ার যাত্রাকে তদন্তের নামে রুখে দেওয়ার জন্য এটা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তাঁকে সমন পাঠানো হয়েছে।
কুন্তল ঘোষ চিঠি লিখেছিল বলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Abhishek Banerjee) সিবিআই ডেকেছে। সুদীপ্ত সেনের চিঠিতেও তো শুভেন্দু অধিকারী, অধীর চৌধুরী, সুজন চক্রবর্তীর নাম ছিল। তাঁদের তো ডেকে পাঠানো হয়নি! তাঁদের বেলায় কি তবে আলাদা নিয়ম? এমতাবস্থায় সিবিআইকে কি নিরপেক্ষ বলা যায়?
সময় নষ্ট করে বারবার তাঁকে ডাকার দরকার নেই। তাঁর বিরুদ্ধে সত্যি কোনও তথ্য থাকলে সেটা জনসমক্ষে আনা হোক। ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
যেসব এজেন্ট ও লোকেদের নাম অভিষেকের সামনে সিবিআই-এর পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি লোক মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব মেদিনীপুরের। সেই জেলার দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি নারদ-কাণ্ডে এফআইআর নেম। অথচ তাঁকে তলবের মুরোদ নেই সিবিআই-এর।
অভিষেককে করা ৯০ শতাংশ প্রশ্নই ‘বোগাস’। তা সত্ত্বেও সব প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন।
অমিত শাহ টেলিভিশন চ্যানেলে বলেছিলেন, মোদির নাম নিলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিল সিবিআই। অমিত শাহকে কি সেই বক্তব্যের জন্য ডাকা হয়েছে? ক্ষমতা থাকলে সিবিআই তাঁকে ডেকে দেখাক!
অনুব্রত মণ্ডলের কন্যা সুকন্যাকে ডেকে গ্রেফতার করেছে ইডি। জানতে চেয়েছে কেন তাঁর ১৫০ গুণ সম্পত্তি বেড়েছে? কেউ দোষ করে থাকলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। কিন্তু ১৬ হাজার গুণ সম্পত্তি বাড়িয়ে অমিত শাহের ছেলে জয় শাহ ফুর্তি করে বেড়াবে, আর অনুব্রত-কন্যা হাজতে থাকবে, এটা দ্বিচারিতা।
সারদা, নারদা থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল চুরির তদন্ত— সবেতেই সিবিআই ব্যর্থ। তা-ও এসব নাটক করে তৃণমূল কংগ্রেসের নবজোয়ার কর্মসূচিতে বিঘ্ন তৈরির চেষ্টা করছে। স্বয়ং প্রকৃতি তার তাবৎ প্রতিকূলতা নিয়ে যে কর্মসূচিতে ব্যাঘাত ঘটাতে ব্যর্থ, এজেন্সি নামিয়ে, চক্রান্ত করেও তাকে আটকানো যায়নি, যাবে না।
রৌদ্রের প্রখর দহন যাঁকে ক্লান্ত করতে পারেনি, প্রভঞ্জনের অভিঘাত যাঁকে বিচলিত করতে পারেনি, মুষলধারার বর্ষণে যিনি সিক্ত হন কিন্তু নতিস্বীকার করেন না, সেই উন্নত-শির যৌবন ২০২৩-এর মে মাসে, শনিবাসরীয় রাতে আমাদের সামনে যেন তুলে আনলেন ইতিহাসের একটা পৃষ্ঠা। এবং যুগপৎ তারই বিপ্রতীপে আগামীর ইঙ্গিত।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দের কথা। সেই প্রেক্ষিতে আসন্ন ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রসঙ্গ।
নরেন্দ্র মোদি তো দুবার ভারত জয় করতে পেরেছেন। দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারেরও স্বপ্ন ছিল, গান্ধার থেকে শুরু করে উত্তর ভারত তথা নন্দরাজ্য মগধ দখল করে গঙ্গা সমীপবর্তী অঞ্চল করায়ত্ত করে পূর্বের সমুদ্রতট পর্যন্ত আধিপত্য কায়েম করা। গান্ধার ও সংলগ্ন রাজ্যের অধিপতিরা বিনাযুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু পুরু, আলেকজান্ডার ও তাঁর সেনাবাহিনীকে ঝিলম নদীর তীরেই রুখে দিয়েছিলেন। তাঁর সাহসিকতায় বিস্মিত আলেকজান্ডারকে ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। কারণ, একজন সামান্য দেশীয় রাজা পুরু যদি এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন তাহলে প্রবল শক্তিধর নন্দসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গ্রিক সেনা লড়বে কীভাবে?
ইতিহাস শিখিয়েছে, কেউ অপরাজেয় নয়। কেউ অপরাজেয় ছিল না কোনও দিন। থাকবেও না আগামীতে।
মোদির অশ্বমেধের ঘোড়ার রশিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee) টান দিয়েছেন। মাথার ওপর রয়েছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগামীর অনিবার্য ইতিহাস তাই ধীরে কিন্তু স্পষ্টাক্ষরে রচিত হচ্ছে।
কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়। আবার কেউ ইতিহাস পাঠ না করেই ইতিহাস তৈরি করতে চায়।
সত্যি সেলুকাস! …
আরও পড়ুন: ২ হাজারের নোট নিয়ে চরম বিভ্রান্তি, ফর্ম ফিলাপ, পরিচয়পত্র কেন?