আর দু’দিন বাদেই তিনি পা দেবেন অষ্টআশিতে। ভারতরত্ন অধ্যাপক চিন্তামণি নাগেশান রামাচন্দ্রা রাও (Chintamani Nagesa Ramachandra Rao), যিনি সিএনআর রাও (CNR Rao) নামেই বেশি পরিচিত, তাঁর জন্মদিন আসছে এই তিরিশে জুন। এখনকার ভারতবর্ষে যে ক’জন আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী জীবিত আছেন, নিঃসন্দেহে সিএনআর রাও তাঁদের মধ্যে প্রবীণতম। বিশ শতকের ভারতে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা বা সি ভি রামন যেমনভাবে বিশ্বজোড়া বিজ্ঞানীমহলের সম্ভ্রম আদায় করতে পেরেছিলেন নিজেদের প্রতিভা আর কাজের গুণে, সিএনআর রাও সেই রত্নসভার এখনও অবধি শেষ প্রতিনিধি।
বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা সিএনআর রাওয়ের (CNR Rao) গবেষণার মূল ক্ষেত্র কঠিন বস্তুর রসায়ন (বা সলিড স্টেট কেমিস্ট্রি), তবে এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাঁর আন্তর্জাতিক মানের কাজ রয়েছে। পাঁচ দশক ধরে বিজ্ঞান গবেষণায় লিপ্ত অধ্যাপক রাও এখনও কর্মক্ষম, বেঙ্গালুরুর বাড়িতে এবং গবেষণাগারে বসে তিনি কাজ করে চলেছেন গ্রাফিন নামের এক ধরনের অতি-পাতলা পদার্থ এবং কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষ নিয়ে। এই বয়সেও তিনি নিয়মিত সভাসমিতিতে হাজির থাকেন, লেখাপড়ায় নিয়োজিত থাকেন এবং সময়-সুযোগ পেলেই সভাসমিতিতে দর্শক-ছাত্রদের কাছে ভারতবর্ষকে আগামী দিনে কীভাবে বিজ্ঞান গবেষণার মানচিত্রে উজ্জ্বল একটি বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা সহজ হয়, সে স্বপ্ন দেখিয়ে চলেন।
সিএনআর রাও-এর (CNR Rao) পড়াশুনোয় মাথা ছোট থেকেই বেশ তুখড়। আর বাড়িতেও পেয়েছিলেন পড়াশুনোর উপযুক্ত পরিবেশ, যেহেতু তাঁর বাবা ছিলেন একজন স্কুল পরিদর্শক এবং তিনিই একমাত্র সন্তান। একইসঙ্গে মায়ের কল্যাণে ছোট থেকেই সাহিত্যের প্রতিও একটা আকর্ষণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাঁর মায়ের প্রথাগত পড়াশুনো বিশেষ না থাকলেও নিজে নিজেই বই এবং সংবাদপত্র পড়ে পড়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখে নিয়েছিলেন, ছেলেকে তিনিই বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটান।
১৯৩৪ সালের তিরিশ জুন পরাধীন ভারতের মহীশূর প্রদেশের ব্যাঙ্গালোর-এ তাঁর জন্ম। প্রাথমিক স্তরের পড়াশুনো করেন বাড়িতেই, এবং ব্যাঙ্গালোরেই স্কুলের পড়াশুনো শেষ করে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাশ করেন মাত্র সতেরো বছর বয়সে এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি করেন উনিশ বছর বয়সে, ততদিনে অবশ্য দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: বিভেদ বিদ্বেষ নয়, সম্প্রীতিই ভারত-ভাগ্যের ভবিষ্যৎ
স্কুলে পড়াশুনো করার সময়েই ১৯৪৬ সালে তাঁর একবার সুযোগ হয় নোবেলজয়ী অধ্যাপক সি ভি রামনের লেকচার শোনবার। সেই অভিজ্ঞতাই তাঁকে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার দিকে চালিত করবার প্রধান অনুঘটক হিসেবে দেখা দেয়, এ কথা নিজেই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন অধ্যাপক রাও। এমএসসি পাশ করবার পর বছরখানেক রাও পড়াশুনো করেন খড়গপুর আইআইটি-তে, কিন্তু তিনি বোঝেন, উচ্চমানের গবেষণার জন্য বিদেশে যাওয়া জরুরি। তাঁর তখন প্রবল ইচ্ছে নোবেলজয়ী অধ্যাপক লিনাস পাউলিং-এর কাছে গবেষণা করবার, কিন্তু পাউলিং-এর নির্দেশেই রাও চলে যান আমেরিকায়, সেখানকার পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন পাউলিং-এর ছাত্র অধ্যাপক আর এল লিভিংস্টোন-এর অধীনে। গবেষণার শেষে পিএইচডি পাওয়ার পর অধিকাংশ ছাত্রের মতো বিদেশযাপনে অংশ না নিয়ে রাও (CNR Rao) ফিরে আসেন ভারতেই, চাকরি নেন ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি)-এ, লেকচারার হিসেবে, পরে অবশ্য চলে যান আইআইটি কানপুরে। ওখানকার রসায়ন বিভাগের প্রধান পদেও আসীন হন যথাসময়ে। ১৯৭৬ সালে রাও আবার ফিরে আসেন আইআইএসসি-তে, এবার এখানে একটি নতুন বিভাগ সম্পূর্ণ তাঁরই উদ্যোগে স্থাপিত হয়। আট বছর পরে রাও এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হন, আমাদের হয়ত মনে পড়বে, কলকাতা থেকে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে ১৯৩৩ সালে নোবেলজয়ী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামন এই প্রতিষ্ঠানে এসে এই পদেই যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৮৯ সালে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্মশতবার্ষিকীতে রাও-এর উদ্যোগেই জওহরলাল নেহরু ইনস্টিটিউট সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চ স্থাপিত হয়।
এবার তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে কিছু কথা বলা দরকার। রাও-এর গবেষণার মূল বিষয় বর্ণালির বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনও পদার্থের আণবিক গঠন সম্বন্ধে ধারণা তৈরি করা। বিভিন্ন ধরনের বর্ণালি-বিশ্লেষণ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, সেগুলোর সাহায্যেই বিভিন্ন ধাতব অক্সাইড এবং সালফাইড ধরনের যৌগকে নিয়ে তিনি কাজ করেন।
এ-ছাড়া আরও একটি ক্ষেত্রে রাও-এর বেশ কিছু ভাল কাজ রয়েছে, তা হল ধাতব বস্তুর অতিপরিবাহিতা। আমরা জানি যে ধাতব বস্তু সাধারণত তড়িতের সুপরিবাহী হয়, অর্থাৎ ওদের মধ্যে দিয়ে তড়িৎ ভাল যাতায়াত করতে পারে। সম্প্রতি কিছু বিশেষ ধরনের ধাতব যৌগ-পরিবাহী পদার্থ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে দিয়ে তড়িৎ বিনা বাধায় প্রবাহিত হতে পারে, এই পদার্থগুলিকেই অতিপরিবাহী নাম দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে খুব কম তাপমাত্রায় এ ধরনের পদার্থকে অতিপরিবাহী হিসেবে দেখানো যাচ্ছে, আগামী দিনে হয়ত ঘরের তাপমাত্রাতেও অতিপরিবাহী পদার্থ সুলভ হবে।
অধ্যাপক রাও আর তাঁর সহকারীরা এরকমই কিছু অতিপরিবাহী পদার্থকে নিয়ে কাজ করেন, যেগুলির মধ্যে মূলত ছিল কিছু অক্সাইড ধরনের যৌগ, যার মধ্যে রয়েছে বেরিলিয়াম বা তামার মতো চেনা ধাতুও।
সম্প্রতি রাও নজর দিয়েছেন ন্যানো-কণাবিদ্যার দিকে। ইদানীং ন্যানো-বিজ্ঞান বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে গবেষকদের মধ্যে। এক মিটার দড়িকে একশো কোটি টুকরো করলে তার এক একটা টুকরোর দৈর্ঘ্য হবে এক ন্যানোমিটার। অধ্যাপক রাও তাঁর গবেষণাগারে এরকম বেশ কিছু ন্যানোপদার্থ তৈরি করতে পেরেছেন, যেগুলোর পুরুত্ব ন্যানোমিটার অর্ডারে থাকে। এই ধরনের পদার্থকে নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছু কাজ করা সম্ভব যেগুলো সাধারণ দৃশ্যমান বস্তুরা দেখায় না।
মূলত অধ্যাপক রাওয়েরই উদ্যোগে আর ব্যবস্থাপনায় ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক তৈরি করে ন্যানো সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ। ভারতের আধুনিক ন্যানো-গবেষণাক্ষেত্রে তিনি মহিরুহের মতো বিরাজ করছেন।
অধ্যাপক রাও যে বিশ্বের কতগুলি প্রতিষ্ঠানের সাম্মানিক বা নির্বাচিত সদস্য, তাই তালিকা দিতে বসলে শেষ করা যাবে না, তবু কয়েকটা বলি— তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি, আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স, ফ্রেন্স আকাদেমি অব সায়েন্স, জাপান অ্যাকাডেমি— এরকম বহু বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সদস্য। বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেছেন, পেয়েছেন অসংখ্য সম্মান (যেমন শুধু সাম্মানিক ডক্টরেট পেয়েছেন চুরাশিটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, যার মধ্যে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও, এখান থেকে তাঁর আমলে ডক্টরেট পেয়েছিলেন মাত্র তিনজন— ইন্দিরা গান্ধী, মনমোহন সিং এবং তিনি, আর তাঁদের আগে পেয়েছিলেন একজনই— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!), ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ দিয়েছে, এবং ২০১৪ সালে পেয়েছেন ভারতরত্ন। তিনিই ভারতের তৃতীয় বিজ্ঞানী, সি ভি রামন আর এপিজে আবদুল কালাম-এর পর, যিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, বিজ্ঞান ক্ষেত্রটিতে একমাত্র নোবেল ছাড়া এই গ্রহের যাবতীয় পুরস্কার পাওয়া হয়ে গিয়েছে তাঁর।
এখনও অবধি তিনি লিখেছেন দেড় হাজারের বেশি বৈজ্ঞানিক পেপার, এবং পঞ্চাশটির বেশি বই। এত বিশাল মাপের কাজ করলেও রাও নিজে কিন্তু ভারতের আগামী দিনে বিজ্ঞান গবেষণা ক্ষেত্রে আরও বেশি করে ছাত্রদের এগিয়ে আসবার ব্যাপারে সবসময়েই চিন্তিত। ছাত্রদের মধ্যে তাত্ত্বিক গবেষণার বদলে আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তির দিকে যাওয়ার প্রবণতা তাঁকে ভাবায় সবসময়।
ভারত যেমন বিজ্ঞান গবেষণা মানচিত্রে উজ্জ্বল স্থানে আসুক এটা আমরা চাইব অবশ্যই, তেমনই অধ্যাপক রাও আমাদের মধ্যে আরও অনেক বছর এইভাবে কর্মক্ষম হয়ে থাকুন, জন্মদিনের প্রাক্কালে এই প্রার্থনা আমাদের সকলেরই।