কোটি কোটি টাকা খরচ করে অমিত শাহের ধর্মতলার সভা কি ভারতীয় জনতা পার্টির (Bharatiya Janata Party) কাছে হিতে বিরপীত হল? এই প্রশ্ন উঠেছে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে। বুধবারের সমাবেশে যোগ দেওয়া গেরুয়া শিবিরের নেতা-কর্মীদের একাংশও সন্দিহান। তাদের সন্দেহ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা দলের শীর্ষকর্তার ঢাকঢোল পেটানো সভা আখেরে তৃণমূল কংগ্রেসের সুবিধা করে দিল না তো?
অমিত শাহের সভা চলাকালেই কার্যত রাজ্যবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গরিব এবং সাধারণ মানুষের বঞ্চনার অভিযোগকে ‘অগ্নিকন্যা’ স্বমূর্তি ধারণ করে, ফের সবার সামনে আনেন। সবাই জানেন, ১০০ দিনের কাজ, আবাস এবং গ্রাম সড়ক যোজনার প্রকল্পের টাকা দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে।
এই সব ইস্যু যে বিগত বিধানসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটে এ রাজ্যে বিজেপিকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে, সেটা দলের রাজ্য নেতৃত্বের পর্যবেক্ষণে আগেই ধরা পড়েছে। বঙ্গবাসীর নাড়ি টিপে যিনি দক্ষ চিকিৎসকের মতো সবটা বুঝতে পারেন তিনি আর কেউ নন, তাঁর নাম মমতা। লোকসভা ভােটের মুখে ধর্মতলায় বাজার গরম করতে শাহ-শােয়ের বেলুন বুধবারই ফুটো করে দেন তৃণমূলনেত্রী। বিধানসভার ভিতরে এবং বাইরে তিনি বাংলার প্রতি ‘বঞ্চনা’ নিয়ে মুখর হন। দলীয় বিধায়কদের সঙ্গে বিধানসভায় বি আর আম্বেদকরের মূর্তির নিচে এই ইস্যুতে ধরনাতেও নেতৃত্ব দেন মমতা।
সমাবেশে যোগ দেওয়া বিজেপির নেতা-কর্মীদের আশা ছিল, অমিত শাহ বাংলায় বঞ্চনা নিয়ে মুখ খুলবেন। বিশেষ করে ১০০ দিনের কাজের টাকা কেন বাংলা পাচ্ছে না, তার বিশদ ব্যাখ্যা দেবেন। না, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিষয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। ভাসা ভাসা কিছু তথ্য জাহির করে অমিত শাহ ভাষণ শেষ করে দিয়েছেন। আসলে ১০০ দিনের কাজে তো দেশের মধ্যে পারফরম্যান্সে বাংলা আছে সবার উপরে। কী করে অমিত শাহ রাজ্যকে দুষবেন?
বিজেপি কর্মীরা এখন এলাকায় গিয়ে কী জবাবদিহি করবেন জনগণের কাছে? ইতিমধ্যে কেন্দ্রের কাছে বকেয়া টাকা আদায়ের আন্দোলন দিল্লির রাজপথে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মমতা। কিছুদিন আগে রাজধানী কাঁপিয়ে দিয়ে এসেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৯ লক্ষ মানুষের ১০০ দিনের কাজের টাকা না পাওয়ার ইস্যু লোকসভার ভোটের আগে কীভাবে মোকাবিলা করবে বিজেপি?
যে তিনটি প্রকল্পে টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্র, সবগুলোই সাধারণ মানুষে কাছে স্পর্শকাতর ইস্যু। তৃণমূল কংগ্রেস ইস্যুগুলি নিয়ে রাজ্য জুড়ে আন্দোলনের ঝড় তুলেছে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে ২ মাস ধরে অভিষেক যে নবজোয়ার কর্মসূচি পালন করেন তা বস্তুত জনজোয়ারে পরিণত হয়। পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীরা এই জোয়ারে ভেসে যায়। গেরুয়া শিবিরের কর্তারা দিল্লিতে বিজেপি, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে বার্তা পাঠান, মানুষের জীবন এবং জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত স্পর্শকাতর প্রকল্পগুলির টাকা আটকে রাখা মোটেই উচিত হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং দলের সম্পর্ক বাংলার মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।
বুধবারের সমামেশে অমিত শাহের সভা যখন কার্যত সুপার ফ্লপ করেছে। তখন প্রচারের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়কদের ধর্না-আন্দোলন। তাতেই হতাশ এবং নিজেদের দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ বিজেপি বিধায়করা বিধানসভা চড়াও হয়েছেন। দলেরই এক রাজ্য নেতা একান্তে কবুল করেন, আমরা তৃণমূল কংগ্রেসের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। অমিত শাহের সভার সব আলো কেড়ে নিল তো বিধানসভায় মমতার আন্দোলন! ২০১৪ সালে ৩০ নভেম্বর ধর্মতলাতে একই জায়গায় সভা করেছিল বিজেপি। সেদিনও দলের নেতারা ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা যে রাজ্যপাটে বসতে চলেছি, সমাবেশের চোহারা সেটাই বলে দিচ্ছে।’ তারপরে ২০১৬ এবং ২০২১ সালে বিধানসভার দুটি নির্বাচন চলে গিয়েছে। বিজেপি কতটা এগিয়েছে, সেটা বাংলার মানুষ দেখতেই পাচ্ছে। দেড় বছর আগে বিধানসভার নির্বাচনের প্রচারে এসে অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘এবার ১০০ পার হবে!’ ফলাফলে দেখা গেল, জোড়াফুল ২০০ পেরিয়ে ২১৩ আসন পেয়ে গেল!
এবার বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝানো হয়েছিল, ২১ জুলাই তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিবছর যেরকম সভা করে, তাকেও ছাপিয়ে যাবে অমিত শাহের সমাবেশ! কোথায় কী? প্রথমে ধর্মতলা সভার জন্য বাজেট ধরা হয়েছিল ২ কোটি টাকা। কিন্তু সভার পর প্রাথমিক হিসাবে পদ্মফুল শিবির দেখছে, খরচ হয়েছে ৬ থেকে ৭ কোটি টাকা। ৮টি ট্রেন এবং কয়েক হাজার বাসের ভাড়া গোনা হয়েছে। ভূরিভোজের ব্যবস্থা ছিল ঢালাও। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের ২১ জুলাই ধর্মতলার সমাবেশ সাংবাদিক হিসাবে ২৭-২৮ বছর ধরে দেখেছি। প্রতিবছর কলকাতা অচল হয়ে যায়। জোড়াফুলের কর্মী-সমর্থকদের শুধু পদধ্বনি নয় যে আবেগ-উচ্ছ্বাস বছরের পর বছর দেখেছি তার ছিয়েফোঁটা ছিল কি বুধবারের সভায়? আর ভিড়? অমিত শাহ যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন কে সি দাসের মিষ্টির দোকানের সামনের রাস্তায় মানুষজন অবাধে ঘোরাঘুরি করছে। টেলিভিশনের পর্দায় এ-ছবি সবাই দেখেছে। তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সমাবেশকে তুলনা করতে গিয়ে বিজেপি নেতারাই কি দলকে হাস্যকর করে তোলেননি? বাকি রইল বিজেপির (Bharatiya Janata Party) ঘরোয়া বিপদ! কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য দলকে বার্তা দিয়েছিলেন, সাবধান, অমিত শাহ যাচ্ছেন, তাঁর সামনে নিজেরা এমন কিছু করবেন না, যাতে দলের মান-সম্মান নষ্ট হয়। যথারীতি বিজেপি’র যুযুধান নেতৃবৃন্দ মঞ্চে অত্যন্ত সুবোধ বালকের মতো আচরণ করেছেন। তাঁদের দেখে বোঝা যায়নি, দলেরই সমর্থকরা সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের কারও ছবি রাস্তায় ফেলে পায়ে করে মাড়িয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে আটকে রেখে বিক্ষোভ করেছে। সবই হয়েছে নেতাদের উসকানিতেই।
ধর্মতলার মঞ্চ সুরক্ষিত থাকলেও, বিজেপি’র কোন্দল বে-আব্রু করে দিয়েছেন দলেরই সর্বভারতীয় সম্পাদক অনুপম হাজরা। রাজ্য থেকে একমাত্র দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পদাধিকারী সভা শেষ হতে না হতেই বীরভূমে সাংবাদিক বৈঠকে অভিযোগ করেছেন, ধর্মতলার মঞ্চে তাঁকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি! কারণ? অনুপমের অভিযোগ, বিজেপির (Bharatiya Janata Party) রাজ্য নেতারা জানেন, অমিত শাহের সামনেই তিনি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে পারেন, এই ভয়েই সভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। পরিশেষে দলের কেন্দ্রীয় এই নেতা কামান দেগে বলেছেন, বিজেপি এ-রাজ্যে লোকসভার ভোটে পাঁচটা আসন পেলে হয়!
তাহলে তো বলাই যায়, এত ধুমধাম করে অমিত শাহের শো তো বিজেপির অন্দরের অন্ধকারকে আরও গভীর করল। কয়েক মাস পরেই লোকসভার ভোট। ধর্মতলার সমাবেশ দলের পক্ষেই বুমেরাং হল না তো?
আরও পড়ুন- বেনিয়ম বরদাস্ত নয়, স্বাস্থ্যসাথীতে বাদ ১৪২ নার্সিংহোম