উষ্ণ আবহাওয়া আকারে ছোট হচ্ছে পাখিরা

আবহাওয়ার পরিবর্তন পৃথিবীর জীবজন্তুদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে বিশ্ব উষ্ণায়নে ক্ষুদ্রাকৃতি হয়ে যাচ্ছে পাখিদের শরীর। লিখেছেন অর্পণ পাল

Must read

বিশ্বের আবহাওয়া যে প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, এটা আমরা সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারছি সবসময়েই। আর আবহাওয়ার এই পরিবর্তন যে নানা জাতের জীবজন্তুর ওপরেও প্রভাব ফেলছে, সে ব্যাপারগুলোও অজানা নেই আর। কিন্তু পাখিদের শরীরও যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে, এ খবরটাও বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন সদ্যই। গত প্রায় চল্লিশ বছরে কুড়িটিরও বেশি প্রজাতির পাখি আকারে ক্ষুদ্রকায় হয়ে চলেছে। তাঁরা হিসেব করে দেখেছেন, প্রতি দশ বছরে তাদের দেহের আকার কমেছে এক থেকে দুই শতাংশ।

ব্রাজিলের অ্যামাজনের জঙ্গলে গত বেশ কয়েক বছর ধরেই গবেষকেরা কাজ করে চলেছেন নানা ধরনের পাখি নিয়ে। তাঁদের কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। সেই তখন থেকে তাঁরা নানা ধরনের পাখি ধরেছেন, তাদের দেহের নানা বিষয় পরিমাপ করছেন, আবার ছেড়েও দিচ্ছেন। প্রথম যখন এই গবেষকেরা এখানে আসেন, তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এখানে বসবাসকারী পাখিদের সঙ্গে যে-সব এলাকায় মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে, সেখানে বসবাসকারী পাখিদের মধ্যে কোনও তফাত তৈরি হচ্ছে কি না, সেটা বুঝে নেওয়া। এ-জন্য তাঁরা গত চল্লিশ বছরে প্রায় আশিটি প্রজাতির এগারো হাজার পাখি নিয়ে তাদের দেহের ওজন, দৈর্ঘ্য ইত্যাদি মেপেছেন। পাশাপাশি তাঁরা সংগ্রহ করেছেন এই এলাকার আবহাওয়াজনিত বিভিন্ন তথ্যও। আর এই কাজটাই করতে গিয়ে এঁরা জানতে পেরেছেন পাখিদের আকারে (বা আয়তনেও) ছোট হওয়ার মতো আরও আকর্ষণীয় বিষয়টি। তাঁদের খুঁজে পাওয়া এই কৌতূহলজনক বিষয়টি প্রতিবেদনের আকারে প্রকাশ পেয়েছে ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ পত্রিকায়।

শুধু দেহের আকার কমে যাওয়াই নয়, ওই গবেষকেরা দেখেছেন, পাশাপাশি একটু একটু করে বড় হচ্ছে কোনও কোনও পাখির লেজও। প্রায় একষট্টি রকমের প্রজাতির পাখির লেজের দৈর্ঘ্য বড় হয়েছে গত এই চার দশকে, জেনেছেন বিজ্ঞানীরা। লেজের বড় হওয়ার কারণ মূলত ওই পাখিদের উড়তে সুবিধে হওয়া। এ-ছাড়াও জানা গিয়েছে, দেহের আকার ছোট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে ওই পাখিদের ওজনও। গত চল্লিশ বছরে এই এলাকার উষ্ণতা বেড়েছে প্রায় এক থেকে দেড় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির জীবন যাপনে রয়েছে বৈচিত্র্য, তবু সব প্রজাতির ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গিয়েছে একটাই সাধারণ বিষয়— ওজন আর আকারে হ্রাস। যা তাদের খাদ্যাভ্যাস বা জীবন যাপনে পরিবর্তনের কারণে না, ঘটছে আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্যই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ওই গবেষক-বিজ্ঞানীরা।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বেন উইঙ্গার নামে এক পক্ষী-বিশেষজ্ঞ এর আগে বলেছিলেন প্রায় একই কথা। তিনি বেশ কিছু পরিযায়ী পাখি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে দেহের আকার কমছে তাদেরও। ব্রাজিলের জঙ্গলের পাখিদের ছোট হওয়ার খবর পেয়ে তাঁর মনে জেগে উঠছে এই চিন্তা, আবহাওয়ার পরিবর্তন তাহলে কি দৈহিক বদল ঘটাচ্ছে বিশ্বের যাবতীয় পাখিরই? সে-উত্তর দেওয়া এক্ষুনি, কঠিনই।

আরও পড়ুন: কোর্টের সম্মতিতে সাদরে মৃত্যুবরণ এস্কোবারের

পাখিদের দেহের বাইরের তলের ক্ষেত্রফল যত কম হবে, ত্বকের মধ্যে দিয়ে তাপ বিকিরণ ততই কম হবে। যে-সমস্ত এলাকার উষ্ণতা কম, সেখানে অসুবিধা হয় না। কিন্তু যেখানে আবহাওয়া গরম, সেখানে পাখিরা পড়বে সমস্যায়। সেই কারণেই হয়তো ওইসব এলাকায় পাখিরা দেহকে ছোট করে আনে, যাতে দেহের আয়তনের তুলনায় বাইরের তলের ক্ষেত্রফলের অনুপাত না কমিয়ে তাপ বিকিরণ কম রাখা যায়। ভাইটেক জিরিনেক নামে একজন পরিবেশবিদ গবেষক এই ধারণা ব্যক্ত করেছেন ওই প্রতিবেদনে। তিনিই এই দলের সঙ্গে মিলিত হয়ে গত চল্লিশ বছর ধরে অ্যামাজনের গহীন অন্দরে, যেখানে সভ্যতার সংস্পর্শে (অর্থাৎ মানুষ নির্মিত নগরসভ্যতা) পাখিরা প্রায় আসেই না, সেখানে গিয়ে নানান প্রজাতির পাখিদের নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে যে শুধু নগর সভ্যতাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, এর প্রভাব পড়ছে অ্যামাজনের গহন অরণ্যে থাকা জীবজন্তুদের ওপরেও, তাঁদের এই গবেষণা সেই তত্ত্বকেও প্রতিষ্ঠিত করল। আগামী দিনে পশুপাখিদের জীবনযাপনে আরও কত ধরনের প্রভাব ফেলছে বিশ্ব উষ্ণায়ন, সে-নিয়ে আরও নানা বিচিত্র খবর আমরা পাব, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারি।

Latest article