আলোকবর্ষের উজ্জ্বল বিভা

Must read

টেলিস্কোপে চোখ রেখে প্রবীণ অধ্যাপক ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন, ছাত্ররা, ওই যে দূরে সাদা-হলদে ছোট আকৃতির যে তারাটি দেখা যাচ্ছে, তার নাম কি জানো?
কৌতূহলী দৃষ্টিতে ছাত্রেরা এক এক করে টেলিস্কোপে চোখ রাখছে এবং অবাক বিস্ময়ে জ্বলজ্বলে সেই উজ্জ্বল তারাটির দিকে বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। তাদের মধ্যে একজন তো স্যারকে জিজ্ঞাসাই করে বসল— স্যার, তারাটির নাম কি?
উত্তরে সেই অধ্যাপক মুচকি হেসে বললেন, শুনলে অবাক হবে ওই তারাটি একজন ভারতীয় বাঙালি মহিলা বিজ্ঞানীর নামে। ধীর কণ্ঠে বললেন, ওই তারাটির নাম ‘বিভা’। একজন বাঙালি মহিলা বিজ্ঞানীর নামেই রাখা হয়েছে। তিনি ড. বিভা চৌধুরি (Dr. Bibha Chowdhury)। যিনি মহাজাগতিক রশ্মি ও কণার বিষয়ে গবেষণা করে মহাকাশ গবেষণার দুনিয়ায় সাড়া ফেলেছিলেন আজ থেকে কত বছর আগে। আবিষ্কার করেছিলেন যথেষ্ট তথ্য। সেই আবিষ্কারের কাহিনি রোমাঞ্চকর শুধু নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মরণীয়ও বটে।

সেদিন তাঁর যথার্থ স্বীকৃতি না মিললেও পরবর্তীতে সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন এই বিজ্ঞানীর কৃতিত্বকে। তাঁরই গবেষণার পথ ধরে নোবেল পেয়ে পদার্থ বিজ্ঞানী ড. সিসিল পাওয়েল উচ্চারণ করেছিলেন এই বিজ্ঞানীর নাম। ড. চৌধুরি মহাজাগতিক রশ্মি ও কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে যথেষ্ট তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন। এক দিকে বিশ্বযুদ্ধ, অন্য দিকে পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশের মহিলা বিজ্ঞানী। স্বভাবত পরিকাঠামো ও প্রচারের অভাবে গবেষণার শেষ প্রান্তে পৌঁছতে না পারার জন্য সম্ভাব্য নোবেল পুরস্কার থেকে তিনি সেদিন বঞ্চিত হন। তবে গবেষণা সম্পূর্ণ করতে পারলে ড. বিভা চৌধুরির সঙ্গে তাঁরই সিনিয়র ও মেন্টর শিক্ষক বিজ্ঞানী ড. দেবেন্দ্রমোহন বসুও আজ নোবেল প্রাপকদের নামের সারণিতে স্থান পেতেন। কে এই দেবেন্দ্রমোহন বসু? ড. দেবেন্দ্রমোহন বসু সম্পর্কে বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর আপন ভাগ্নে এবং প্রথিতযশা ডাক্তার স্যার নীলরতন সরকারের বড় জামাই। এই দেবেন্দ্রমোহন বসুর সাহচর্যেই গবেষণা শুরু করেছিলেন সেদিনের সেই মহিলা বিজ্ঞানী। আজ ভাবলে অবাক লাগে।

দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানে বিরল কৃতিত্বের জন্য ড. বিভা চৌধুরির (Dr. Bibha Chowdhury) মৃত্যুর ৩০ বছর পরে ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর আইইউ (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন) প্যারিসে এক সভায় তাঁর নামে একটি নক্ষত্রের নাম রাখে। নক্ষত্রটির নাম ‘বিভা লাইটবিম’। নক্ষত্রটি আকারে সূর্যের থেকে বড় এবং ৩৪০ আলোকবর্ষ দুরে অবস্থিত। এর আগে যার নাম ছিল HD 86081। এটি সৌরজগতের বাইরে সেক্সটান নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে অবস্থিত। নক্ষত্রটির এক্সোপ্ল্যানেটের নাম রাখা হয়েছে সংস্কৃত শব্দ “সান্তামাসা”, যার অর্থ মেঘে ঢাকা।

আরও পড়ুন-অভিনব রেডিও

ড. বিভা চৌধুরি (১৯১৩-৯১) (Dr. Bibha Chowdhury) ভারতীয় উপমহাদেশের এক প্রতিভাময়ী বাঙালি মহিলা বিজ্ঞানী। পিতা প্রখ্যাত চিকিৎসক বঙ্কুবিহারী চৌধুরি, মাতা ঊর্মিলা চৌধুরি। ঊর্মিলাদেবীর বোন নির্মলাদেবী বিখ্যাত ডাক্তার স্যার নীলরতন সরকারের সহধর্মিণী। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে বিভা তৃতীয়। ছাত্রাবস্থা থেকেই মেধাবী বিভা বেথুন স্কুলে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় অর্নাস-সহ স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ) থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশান করেন।
পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিত অধ্যাপক ড. দেবেন্দ্রমোহন বসুর গবেষক দলে যোগ দিতে চাইলে মহিলা বলে প্রথমে ড. বসু আপত্তি তোলেন। পরে অবশ্য বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ড. বসু যোগদান করলে বিভা চৌধুরি তাঁরই অধীনে গবেষণায় যোগদান করেন।
বসু বিজ্ঞান মন্দিরে বিভা চৌধুরি ড. ডি এন বসুকে মেন্টর করে শুরু করলেন তাঁর মহাকাশ গবেষণার যাত্রা। মহাজাগতিক রশ্মি (Cosmic Ray) ও কণা পদার্থবিজ্ঞান (Particle Physics) নিয়ে গবেষণা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মহাজাগতিক রশ্মি ও কণা পদার্থবিজ্ঞান কি?

মহাজাগতিক রশ্মি (Cosmic Ray) হল বহির্বিশ্ব থেকে আসা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধূলিকণার স্রোত যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আলোর গতিতে প্রবেশ করে বাতাসে ভেসে বেড়ানো বিভিন্ন পদার্থের নিউক্লিয়াসের সঙ্গে সংঘর্ষে নতুন কণার সৃষ্টি করে। এই নতুন কণাকে বিজ্ঞানের ভাষায় পজিট্রন, নিউট্রন, নিউট্রিনো, মেসন প্রভৃতি সেকেন্ডারি মহাজাগতিক রশ্মি বলে। মহাজাগতিক রশ্মিতে শতকরা ৮৯ ভাগ প্রোটন, ৯ ভাগ বিকিরণ এবং ২ ভাগ কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও লোহার ভারী নিউক্লিয়াস থাকে। এদের প্রাইমারি মহাজাগতিক রশ্মি বলে। আর কণা পদার্থবিজ্ঞান (Particle Physics) হল উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞান। এর কাজ হল পদার্থ এবং বিকিরণের মৌলিক উপাদান ও তাদের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করা। এখানে কণা বলতে প্রোটন কণা, গ্যাসের কণা এমনকী ধূলিকণাও বলা যেতে পারে।
ড. বিভা চৌধুরির (Dr. Bibha Chowdhury) প্রথম গবেষণা পত্রের নাম ছিল Studies in nuclear disintegration by the photographic plate method-1, Disintegration of samarium necleus by cosmic rays। মহাজাগতিক রশ্মির সামনে উন্মুক্ত ফটোগ্রাফিক প্লেট ধরে পরীক্ষা চালানোর জন‍্য শিক্ষক-ছাত্রী উভয়েই দীর্ঘদিন সান্দাকফু পর্বতশৃঙ্গে প্রায় ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় এবং ভুটান সীমান্তে ফারি জং এলাকায় বসবাস করেছিলেন। সাধারণত এই ধরনের পরীক্ষা মেঘ-কক্ষের (cloud chamber) সাহায্যে করা হয়। একটি বদ্ধ সরঞ্জামের মধ্যে ইথানল বা অন্য পদার্থের বাষ্পপূর্ণ অবস্থাকে মেঘ-কক্ষ বলে। এই কক্ষের মধ্য দিয়ে কোনে‌ও উচ্চশক্তিসম্পন্ন কণা চলে গেলে জেট বিমানের মতো একটি রেখাপথ তৈরি হয়। এই রেখাপথটি অদৃশ্য হওয়ার আগেই তার থেকে কণাটির ভর, আধান কিংবা ভরবেগ সংক্রান্ত নানান তথ্য জানা যায়। কিন্তু এই ভাবে মহাজাগতিক কণার ভর নির্ণয়ে সমস্যা তৈরি হওয়াতে এর বিকল্প উপায় হিসাবে ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন দেবেন্দ্র ও বিভা। এই পথের প্রথম সন্ধান দিয়েছিলেন মারিয়েটা ব্লাউ নামে এক পদার্থবিজ্ঞানী। ব্লাউ-এর এই উপায়টা ভারতে বিজ্ঞান কংগ্রেসে বলেছিলেন বোথে ও টেলর নামে দুই বিদেশি বিজ্ঞানী। সেই কাজকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁরা।
ফটোগ্রাফিক প্লেটে থাকা আয়োডাইড সিলভার অর্থাৎ সিলভার (রুপা) ও আয়োডিনে ভেঙে তা সিলভার প্লেটে আটকে যায়। এই সিলভার বিন্দুগুলো ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে বোঝা যায় যে মৌলিক কণা কোন পথ দিয়ে গিয়েছে। এই ভাবে ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করে বিভা চৌধুরি ও ড. ডি এন বসু পাই-মেসন এবং মিউয়ন কণার ভর, গতিবেগ, আধান নির্ণয় করে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় একই শিরোনামে ১৯৪১ ও ১৯৪২ সালে পরপর দুটি প্রবন্ধ লেখেন। হাফটোন ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহারের ফলে পাই-মেসন ও মিউয়ন কণার অস্থিত্ব আবিষ্কার করলেও ওই কণাগুলোর ভর নির্ণয়ে ত্রুটি ছিল। এই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার ফলে যথেষ্ট পরিকাঠামোর অভাবে ফুলটোন প্লেট সংগ্রহ করে নিখুঁত পরীক্ষা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নানা প্রতিবন্ধকতায় থেমে গেল গবেষণার অগ্রগতি। তা ছাড়া প্রচারও তাঁদের অন্তরায় হয়।
বিজ্ঞানের পথ চলা থেমে থাকে না। তাঁদের গবেষণার পথ ধরেই সাত বছর পর ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী ড. সিসিল পাওয়েল উন্নতমানের ফুলটোন ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করে পাই-মেসন ও মিউয়ন কণার সঠিক ভর নির্ণয় করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। যদিও তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পিছনে আরও কয়েকটি আবিষ্কার ছিল। প্রসঙ্গক্রমে জানাই ড. পাওয়েল তাঁর গবেষণাপত্রে বিভা চৌধুরি ও ড. বসুর পরীক্ষার কথা উল্লেখ করেছিলেন।

এর পর বিভা চৌধুরি (Dr. Bibha Chowdhury) ১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার শহরে চলে আসেন এবং মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণারত স্যার প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের অধীনে বিস্তৃত বায়ু ঝরনা (Extensive Air Shower) নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। ১৯৪৯ সালে ‘এক্সটেন্সিভ এয়ার শাওয়ারস উইথ পেনিট্রেটিং পার্টিকেলস’ নামে একটি গবেষণাপত্র জমা দিয়ে ১৯৫২ সালে ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি অর্জন করেন। স্থানীয় ‘হেরাল্ড’ পত্রিকায় তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ও তাঁর একটি সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যে ১৯৪৯ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত টাটা মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিভা চৌধুরির নাম প্রস্তাব করেন স্বয়ং বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। ওই বছরেই বিভা চৌধুরি ওই পদে যোগদান করেন। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি টাটাতে কর্মরত ছিলেন। ইতিমধ্যে ১৯৫৪ সালে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে একজন অতিথি অধ্যাপক হিসাবে বক্তব্য রেখেছিলেন। এর পর তিনি আমেদাবাদে ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে যোগদান করেন। সেখানে ডিরেক্টর বিক্রম সারাভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বিখ্যাত কোলার গোল্ড ফিল্ডস পরীক্ষা চালিয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। শেষদিকে ড. বিভা চৌধুরি সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও দ্য ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্সেও গবেষণা করেছিলেন। জীবনের শেষদিন পযর্ন্ত ড. বিভা চৌধুরি বিভিন্ন গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও এই মহান বিজ্ঞানী আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আজও আমাদের মধ্যে বিরাজমান।

Latest article