ভূকম্পের অঙ্ক

সম্প্রতি ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে নেপাল। রিখটার স্কেলে যার পরিমাপ ছয় দশমিক তিন। সেই সঙ্গে কেঁপে উঠেছিল দিল্লিও। কেন হয় ভূমিকম্প? কেনই বা আগে থেকে এই বিপর্যয়ের আঁচ মেলে না। ভূমিকম্প নিয়ে বিস্তারিত জানালেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমোস্ফিয়ারিক সায়েন্সের অতিথি অধ্যাপক এবং আবহাওয়াবিদ ড. রামকৃষ্ণ দত্ত

Must read

আধুনিক বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে। মহাকাশে মানুষের প্রেরিত পাইওনিয়ার ১০ মহাকাশযান থেকে এখন বেতার তরঙ্গ হয়ে সিগনালগুলো আসতেই সময় লাগে প্রায় ১২ ঘণ্টা। মানুষ মহাশূন্যে প্রায় ৪ লক্ষ কিমি পথ পেরিয়ে চাঁদে পৌঁছেছে। যদিও পাইওনিয়ার চলে গেছে তার চেয়েও অনেক কোটি গুণ দূরে। কিন্তু পৃথিবীর অভ্যন্তরে মানুষ সম্প্রতি যেতে পেরেছে মাত্র ৬ কিলোমিটার, তাও মাটির ভিতরে নয় মহাসমুদ্রের ভিতরে। আর খনন মাত্র ১২ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত করা গেছে। যেহেতু বেতার তরঙ্গ পৃথিবীর অভ্যন্তরে একেবারেই অচল। কাজেই রিমোট সেনসিং উপগ্রহের ব্যবহার পৃথিবীর অভ্যন্তরে সম্ভব হচ্ছে না। সময় ও গভীরতা অনুযায়ী পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুসন্ধান একেবারে যৎসামান্য। এই সব নানা কারণে ভূমিকম্পের (earthquake) পূর্বাভাস এখনও স্থান কালের সাপেক্ষে প্রায় অসম্ভব। প্রাচীন কালে নানা প্রাণীর অস্বাভাবিক আচরণ থেকে অনেকে ভূকম্পের অনুমান করতেন। শোনা যায় চিন দেশে সাপের অস্বাভাবিক ভাবে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা দেখে ভূকম্পের অনুমান করা হত।

ভূকম্পের (earthquake) কারণ
নানা কারণে ভূকম্প হয়। উৎসস্থলের গভীরতা ও বিশেষত্ব অনুযায়ী টেকটোনিক, ভলকানিক, প্লুটোনিক ইত্যাদি নাম দেওয়া হয়েছে। ভূমিকম্পের উৎসস্থল সমুদ্র অথবা ভূপৃষ্ঠের নিচে থাকে। একে হাইপোসেন্টার বলে। সাধারণত হাইপোসেন্টার সমতলের ১০ কিলোমিটার থেকে শুরু করে অনেক গভীরে হতে পারে। উৎসস্থল (হাইপোসেন্টার)-এর ঠিক ওপরে সমতলে অবস্থিত জায়গাকে বলে এপিসেন্টার। উৎসস্থলে ভয়ানক ঘর্ষণ বা বিস্ফোরণের ফলে নানা ধরনের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এখনও পর্যন্ত ১৫ ধরনের থেকেও বেশি রকম তরঙ্গের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে প্রাইমারি তরঙ্গ (P-WAVE) যা উৎসস্থল (হাইপোসেন্টার) থেকে সবদিকে প্রায় ৭ কিমি প্রতি সেকেন্ড বেগে প্রবাহিত হয়। স্থিতিস্থাপক মাধ্যম ছাড়া প্রবাহিত হয় না। সেকেন্ডারি তরঙ্গ, সারফেস ওয়েভ বা এস ওয়েভ (S-WAVE) ভূপৃষ্ঠ দিয়ে প্রায় ৪ কিমি প্রতি সেকেন্ড প্রবাহিত হয়। এটি ভূপৃষ্ঠের উলম্ব তির্যক তরঙ্গ, গতির উল্লম্ব দিকে কম্পন হয়, জলের মধ্যে দিয়ে যেতে পারে না। ভূকম্পের ধংসলীলার জন্য দায়ী ‘লাভ ওয়েভ’ (আবিষ্কারক অগাস্টাস এডওয়ার্ড হাফ লাভ-এর নাম অনুযায়ী), একটি ভূপৃষ্ঠের অনুভূমিক তির্যক তরঙ্গ। এর গতি প্রায় এস-ওয়েভের সমান। এস-ওয়েভ আর লাভ ওয়েভের সমন্বয় গতি অনেকটা সাপ ও ব্যাঙের গতির মতো। ব্যাঙ গতির উলম্ব দিকে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে, আর পেছনে সাপ গতির অনুভূমিক দিকে এঁকে-বেঁকে (সর্পিল গতিতে) ব্যাঙের পেছনে তাড়া করছে। বিজ্ঞানের ভাষায় হরাইজন্টাল পোলারাইজেশন আর ভার্টিকাল পোলারাইজেশন। ভূকম্পে ভূপৃষ্ঠের সর্পিল গতি বা লাভ ওয়েভ ভয়ানক বিধ্বংসী। বাতাসে বেতার তরঙ্গ বা ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভ অনেকটা সাপ ও ব্যাঙের সমন্বয় গতির মতো। ভূকম্প রোধক কাঠামোতে এই দুই ধরনের কম্পনই সহ্য করার ক্ষমতা থাকা চাই। অর্থাৎ কাঠামোতে কোনও অনুনাদ হবে না ভূকম্পের জন্য।

সিসমোগ্রাফ
শিল্প-উন্নয়নের পর নানা ভাবে ভূকম্প মাপার যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। এদের সিসমোমিটার বলা হয়। ১৯২১-এ প্রথম কার্যকরী সিসমোগ্রাফ উদ্ভাবন করেন উড এন্ড অ্যান্ডারসন। এর বর্ধনক্ষমতা ২৮০০, এটি লেখচিত্রের সাহায্যে প্রাইমারি ওয়েভ ও সেকেন্ডারি ওয়েভের আগমনকাল আর সেকেন্ডারি ওয়েভের এমপ্লিচুড লিপিবদ্ধ করে রাখে। আর দোলকের দোলনকাল দশমিক ৮ সেকেন্ড যা অনেক বড় বড় কাঠামোর দোলনকালের সমান। হাওড়া ব্রিজের উলম্ব দোলনকালের মান আর সৈন্যবাহিনীর মার্চপাস্টের দোলনকালের মান প্রায় সমান, তাই যাতে অনুনাদ না হয় সেজন্য সৈন্যবাহিনীর হাওড়া ব্রিজের ওপর মার্চপাস্টের অনুমতি নেই।

আরও পড়ুন-মোদির ভারতের নিয়ম হল জ্ঞানের প্রদীপ নিভিয়ে চল

ধরে নেওয়া যাক কোনও এক স্থানে ভূকম্পে এই দুই তরঙ্গের সময়ের ব্যবধান ২৫০ সেকেন্ড। তাহলে ভূকম্পটি (earthquake) হয়েছে ওই সিসমোগ্রাফ থেকে (৭-৪) ২৫০=৭৫০ কিলোমিটার দূরে। এতেও কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না কোথায় ভূকম্প ঘটেছে। এই রকমই ধরে নেওয়া যাক আরও দুটি বিভিন্ন জায়গায় দুটি সিসমোগ্রাফ যা ওই একই ভূকম্পের দূরত্ব গণনা করে দিচ্ছে যথাক্রমে ৭০০ কিমি ও ৮০০ কিমি। তাহলে এই তিন জায়গায় ৩টি বৃত্ত যথাক্রমে ৭০০, ৭৫০ ও ৮০০ ব্যাসার্ধ নিয়ে অঙ্কন করলে যে স্থান ঘিরে রাখবে, সেটাই হবে ওই ভূকম্পের এপিসেন্টার। এইরকম যত বেশি সংখ্যক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হবে ততই নিখুঁতভাবে সুনির্দিষ্ট করা যাবে এপিসেন্টার।

উপরন্তু ওই সিসমোগ্রাফ থেকে সেকেন্ডারি কম্পনের এমপ্লিচুডও পাওয়া যাচ্ছে। আর রিখটার স্কেল (চার্লস রিখটার ১৯৩৫) এবং নমগ্রাম টেবিল যেখানে এমপ্লিচুড আর দূরত্ব বসলেই ভূকম্পের তীব্রতা পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে এটি লগারিদমিক সমীকরণ। রিখটার স্কেলে পাঁচের থেকে নয় মাত্রার তীব্রতা ১০০০০ গুণ বেশি।

ধরনের সিসমোমিটার, যেমন ব্রডব্যান্ড, GSN (গ্লোবাল সিসমোলজিক্যাল নেটওয়ার্ক), অ্যাটমিক সিসমোমিটার ইত্যাদি যাতে ৫০০০-১০০০০ কিলোমিটার দূরত্বের সঙ্কেতও নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করে। এই সমস্ত সিসমোমিটারের তথ্য স্যাটেলাইটের সাহায্যে নেটওয়ার্ক করে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যেখানেই— এমনকী যে কোনও মহাসাগরেও ভূকম্প হলেও ২ মিনিটের মধ্যেই কখন, কোথায় এবং তীব্রতা ইন্টারনেটে প্রদর্শিত করছে। এতে উদ্ধারকারী দলের নানারকম সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হচ্ছে। আর সমুদ্রের মধ্যে বা সমুদ্রতীরে রিখটার স্কেলে ৭ বা তার থেকে বেশি তীব্রতার ভূকম্প (earthquake) হলে ভয়ানক সুনামি বা জলোচ্ছ্বাস অবধারিত। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের সুমাত্রায় যে অতি-ভয়ানক সুনামি হয়েছিল তার ভূকম্পন মাত্রা নয় দশমিক একের থেকে বেশি ছিল। মৃত্যু হয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ মানুষের। সম্প্রতি ৯/১১/২০২২-এ নেপালের পশ্চিম সীমান্তে ভূকম্পের স্থান, কাল এবং তীব্রতা এভাবেই জানতে পারা গেছে। আধুনিক সিসমোমিটার এতই সংবেদনশীল যে এটা ক্রসবর্ডার ট্রেসপাসার ধরতেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

Latest article