পৃথিবীর মৃত্যু

ভাবলেই কেমন লাগে তাই না! পৃথিবীর ধ্বংসের কারণ হিসেবে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। তা হলে এতদিন ধরে গড়ে-ওঠা এই সভ্যতার শেষ গতি কী? কী হবে নীল গ্রহের? লিখলেন অর্পণ পাল

Must read

প্রায় চারশো কোটি বছর আগে পৃথিবীতে (Future of Earth) দেখা দিয়েছিল প্রথম প্রাণ। তখন পৃথিবীর আবহাওয়া মোটেই আজকের মতো এত শান্ত ছিল না। মাঝেমধ্যেই আকাশ থেকে ধড়াম-ধড়াম করে এসে পড়ত বিরাট বড় সব পাথর আর উল্কার চাঁই। সৃষ্টি হত গভীর সব গর্ত। মৃত্যু হত কত প্রাণের। তবু ওইরকম কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও প্রাণের বিকাশ হয়েছে, এককোশী থেকে ধীরে ধীরে উদ্ভব হয়েছে বহুকোশী প্রাণী আর উদ্ভিদের, বিবর্তনের ধাপে সব শেষে হাজির হয়েছে আজকের মানুষ।

আর যবে থেকে মানুষ বুঝতে শিখেছে বা জানতে পেরেছে প্রাণ-সৃষ্টির সূচনা থেকে আধুনিক সভ্যতার বিকাশ-ধারার এই পুরো সময়ধারার গতিপথ, তার মনে মাঝেমধ্যেই এই প্রশ্ন জেগে উঠেছে যে তাহলে এত দিন ধরে গড়ে-ওঠা এই সভ্যতার ভবিষ্যৎ কী? পৃথিবী নামের আস্ত এই গ্রহটির অবস্থাই-বা কী হতে চলেছে আগামী দিনে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, শেষ অবধি কী গতি হবে এই নীল গ্রহটির?
মহাকাশের অতিকায় বস্তুদের সৃষ্টি বা বিনাশের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখন অনেক কিছুই জেনেছেন। যেমন একটা তারা বা নক্ষত্রের মৃত্যুর অনেকরকম উপায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। প্রকাণ্ড এক ‘সুপারনোভা’ বিস্ফোরণ ঘটে তারাটি ফেটে পড়তে পারে, বা অন্যদিকে তারাটি ক্রমে জ্বালানি ক্ষয় করতে করতে আকারে ছোট হয়ে একসময় হয়ে যেতে পারে বামন-তারা বা নিউট্রন-কণা-ভর্তি তারা বা একেবারে অদৃশ্য ব্ল্যাক হোল। কিন্তু আমাদের এই গ্রহের অন্তিম দশা কী হতে পারে? সেরকমই কিছু সম্ভাবনা আমরা খতিয়ে দেখব এই লেখায়।

গ্রহাণুপাত
পৃথিবীর ধ্বংসের কারণ হিসেবে অনেকেই অনেক কিছুকেই দায়ী করেন। আজ থেকে সাড়ে ছ-কোটি বছর আগে মেক্সিকোয় যে প্রকাণ্ড একটি গ্রহাণু আছড়ে পড়েছিল, তাতে ডায়নোসর নামের প্রাণীটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী থেকে। আর ডায়নোসরেরা যদি সে-যাত্রা টিকে যেত, আজকের পৃথিবীর চেহারা অন্যরকম হত বলে অনেকে মনে করেন। অদূর ভবিষ্যতে তেমন সম্ভাবনা না থাকলেও অনেক কোটি বছর পরে পৃথিবীতে যে অমন একটা-আধটা গ্রহাণু এসে পড়বে না, কে বলতে পারে?

ডি অক্সিজেনেশন
দ্বিতীয় একটি সম্ভাবনা, যার নাম ‘ডি-অক্সিজেনেশন’। আজ থেকে প্রায় আড়াইশো কোটি বছর আগে পৃথিবীতে অক্সিজেন নামক গ্যাসটির অস্তিত্ব প্রথমবার নির্মিত হয়েছিল। সায়ানো ব্যাকটেরিয়া (নীল-সবুজ) নামে এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র প্রাণীই ছিল এই অক্সিজেন গ্যাস তৈরির পিছনে আসল কারণ। তারপরেই ধীরে ধীরে পৃথিবীতে (Future of Earth) প্রাণের বিকাশ হয়। আবার এর উলটো ঘটনাও ঘটেছিল, ইতিহাসে তার সাক্ষ্য আছে। আজ থেকে সাড়ে চার কোটি বছর আগে পৃথিবীতে অক্সিজেনের পরিমাণ হঠাৎ করেই একবার খুব কমে যায়। প্রাণীদের শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াটাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। ‘লেট অরডোভিসিয়ান মাস এক্সটিংক্টশন’ নামে ওই ঘটনার পরে মৃত্যু হয় পৃথিবীর মোট প্রাণীর প্রায় আশি শতাংশেরই। বিজ্ঞানীদের অনেকেই এখন চিন্তা করছেন যে আগামী দিনে এইরকম ঘটনা আবার ঘটতে পারে কি না।

আরও পড়ুন: নেতাজি চিরঞ্জীবী বললেন

গামা রশ্মি
আরও একটি বিপদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এর নাম গামা রশ্মি। আমরা অনেকেই জানি যে তেজস্ক্রিয় তিন ধরনের রশ্মির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর আর সবচেয়ে শক্তিশালী রশ্মির নাম গামা রশ্মি। আর এই রশ্মি যদি অতিমাত্রায় এসে পৌঁছয় পৃথিবীর আবহমণ্ডলে, সেই ঘটনার নাম হবে ‘গামা রে বার্স্ট’ বা GRB। তবে এই ঘটনা এখনও বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ধারেকাছে নিজেদের চোখে দেখতে পাননি, এইটাই যা বাঁচোয়া। কিন্তু এরকম কোনও ঘটনা যদি আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যে কোথাও ঘটে, তবে তার অভিঘাত এসে পৌঁছতে পারে পৃথিবীতেও, আর যার ফলে ঘটতে পারে অসংখ্য প্রাণী-মৃত্যুও। বেশিক্ষণ না, মাত্র দশ সেকেন্ড যদি এই গামা রশ্মির স্রোত পৃথিবীর দিকে আসবার সুযোগ পায়, আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে রাখা ওজোন স্তরটিকে ছিঁড়ে একাকার করে দেওয়ার জন্য ওইটুকু সময়ই যথেষ্ট। আর ওজোন স্তর ফুটো হলে কী ঘটতে পারে, সে আশা করি না বললেও চলবে।

অক্সিজেন লেভেল
এখানে এটাও বলে রাখা দরকার যে গামা রশ্মির প্রবল ওই আগমন যদি অদুর ভবিষ্যতে না-ও ঘটে, পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণী এমনিতেই বিপদে পড়বে কারণ অক্সিজেন-লেভেল আগামী দিনে কমবেই। অনেকে বলছেন, সমুদ্রের মধ্যে অক্সিজেনের লেভেল বা পরিমাণ ইতিমধ্যেই দিনে-দিনেই কমছে। যে কারণে মারা পড়ছে বহু সামুদ্রিক ছোট-ছোট প্রাণীই।
আর সে দিনও বেশি দূরে নয় যখন সমুদ্রের জলতল বেড়ে সমুদ্র-তীরবর্তী এলাকা এমন জলমগ্ন হবে যে তাতে বিপদে পড়বে বহু কোটি মানুষ, এ ব্যাপারটা ঘটবে আমাদের জীবদ্দশাতেই। সুতরাং সব মিলিয়ে পৃথিবীতে প্রাণের ভবিষ্যৎ মোটেই সুখকর নয়। বিজ্ঞানীরা একটা হিসেব করে বলেছেন যে আগামী প্রায় একশো কোটি বছর পরে পৃথিবীতে প্রাণ বলে কিছু প্রায় থাকবেই না আর।

তবে এতক্ষণ যা বললাম এ সবই হচ্ছে পৃথিবীর (Future of Earth) বুক থেকে অধিকাংশ প্রাণী বা উদ্ভিদদের ধ্বংস হওয়ার সম্ভাব্য কিছু কারণ। কিন্তু এ সবের পরে একদিন তো গোটা পৃথিবীটাই টিকে থাকবে না আর। সে দিন অবশ্য আসতে এখনও অনেক দেরি, কিন্তু আমরা যেহেতু পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়েই আলোচনা করতে বসেছি, সুতরাং যত দূরেই থাক, সে দিনের দিকে একবার চোখ মেলে তাকানো অবশ্যই দরকার।
সূর্য যে আস্তে আস্তে তার জ্বালানি ক্ষয় করে ফেলছে, একথা সকলেরই জানা। আর সূর্যের জ্বালানি যত শেষ হয়ে আসবে, ওর আকার তত বাড়তে থাকবে। একসময় সূর্য বাড়তে বাড়তে ধরে ফেলবে পৃথিবীকেও। ততদিনে পৃথিবীতে প্রাণ বলে কিছু থাকবেই না আর, তাই সূর্য যে গিলতে এসে গিয়েছে পৃথিবীকে, সে-দৃশ্য দেখবার জন্য থাকব না আমরা কেউই। শুধু কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, সেই দিন পৃথিবী এক প্রকাণ্ড লাল রসগোল্লা হয়ে আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে সূর্যের আরও বেশি উজ্জ্বল মুখের গহ্বরে।

Latest article