ভাষার সঙ্গে মিশে থাকে মানুষের আত্মপরিচয়। ভাষার সঙ্গে আবার জুড়ে আছে সংস্কৃতি। মাতৃভাষার কোলেপিঠে বড় হতে হতে আমরা প্রকৃতপক্ষে চিনতে শিখি ঐতিহ্যকে, চিনতে শিখি পূর্বজকে, চিনতে শিখি মাটি-মানুষের নিজস্ব সত্তাকে। ব্যক্তিমানুষই হোক আর জনগোষ্ঠীই হোক, একবার তার মাতৃভাষা কেড়ে নিলে তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। জীবন-জগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক শূন্য হয়ে যাবে। ভাষা সেজন্য মহাপৃথিবীর সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র। শুধু আবেগ নয়, সেখানে মিশে থাকে বিকাশ আর সম্ভাবনার আত্মচিহ্ন। সমাজ-ইতিহাস-সাহিত্য-সংস্কৃতি যেমন ভাষানির্ভর, তেমনই তার দোসর দর্শন-নৃতত্ত্ব-রাজনীতিচর্চাও। প্রত্যেক মানুষের চিন্তার প্রবাহ ভাষার হাতেই নির্ধারিত। আয়ু জুড়ে সেজন্য নিজস্ব মাতৃভাষার গরিমা বহন করতে হয়, বুকে জড়িয়া রাখতে হয় ভাষার অহংকার। একুশে ফেব্রুয়ারি সেই আত্মশ্লাঘা ঘোষণার আন্তর্জাতিক পরিসর।
১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর…। তাঁদের রক্তশপথ একুশ শতকেও সমুজ্জল। মাতৃভাষার প্রতিটি অক্ষর সেই শহিদদের অম্লান গাথা মনে করিয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির অঙ্গীকার মূর্ত হয়ে থাকে মাতৃভাষার একেকটি উচ্চারণে। প্রসঙ্গত মনে পড়বে, ১৯৬১ সালে ১৯ মে বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের কথা। বাংলা ভাষার জন্য শিলচরে প্রাণ দিয়েছিলেন একাদশ শহিদ। সেই এগারোজনের মধ্যে আছেন মহিলা ভাষা-শহিদ কমলা ভট্টাচার্য। অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে ১৬ মার্চ বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন সুদেষ্ণা সিন্হা। মাতৃভাষার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালবাসা যেন ধ্বনিত হয় এই শহিদদের নামের সঙ্গে।
একুশে ফেব্রুয়ারি। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day)। বাংলাভাষার সূত্রে বিশ্বমায়ের, বিশ্বময়ীর বহু স্নেহচ্ছায়ার গৌরবময় স্বীকৃতি। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর ঘোষণা তারপর ২০০২ সালে এবং ২০০৭ সালে তাকে মান্যতা দেয় ইউনাইটেড নেশন্স বা রাষ্ট্রপুঞ্জ। বিশ্বের অজস্র মাতৃভাষার সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের সংকল্প গোটা দুনিয়া জুড়ে উচ্চারিত হয়। আজ সংকট তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, বড় ভাষা, বড় সংস্কৃতি তাদের শক্তি দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে দুর্বলতর ভাষাগোষ্ঠীকে। ভাষাতাত্ত্বিকেরা উদ্বিগ্ন। একটির পর একটি ভাষা নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি-রণনীতিতে বলীয়ান জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা-সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছে অন্য ভাষাগোষ্ঠীর কাঁধে।
আরও পড়ুন:পঞ্চায়েত ভোটে ৬৫ হাজার প্রার্থীর খোঁজে এজেন্সি নামাল বিজেপি
সেসব মূল্যবান ভাষাকে বাঁচাবে কে?
উপনিবেশবাদী প্রভুরা এককালে এসব কাজ করেছে আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা- কানাডা-অস্ট্রেলিয়া জুড়ে। আজ তাদেরই উত্তরসূরিরা নানা মুখোশে, নানা পোশাকে দেশদুনিয়ায় সমান সক্রিয়। ভাষার বিশ্বপরিসরে থাকা উচিত গণতন্ত্র। সব ভাষার সমান অধিকার। তার বদলে চলছে ভাষার মাৎস্যন্যায়। ভারতের স্বাধীনতার পর রাজ্যগঠনে প্রধান এক বিষয় ছিল ভাষা। সংবিধানের দায়বদ্ধতাকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। ভাষা এবং ভাষিক সংখ্যালঘুকে গণতন্ত্রের স্বার্থে রক্ষা করতে হবে। এক ভাষার চাপে অন্য ভাষা যেন বিপন্ন হয়ে না পড়ে।
সারা বিশ্বজুড়ে একটা চক্রান্ত চলছে। ভিন্ন মুখোশে আমাদের দেশেও চলছে ষড়যন্ত্র। সব ভাষাকে প্রান্তিক করে, স্বার্থান্বেষীরা কোনও একটি ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যত। কখনও অজুহাত অর্থনীতি, কখনো অজুহাত ধর্মীয় সংকীর্ণতা, কখনো অজুহাত ক্ষমতার দম্ভ। এই একচালা বিশ্বব্যবস্থা বস্তুত অমানবিক এক স্বৈরতান্ত্রিক ইশারা। বহু ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের বহুস্বর এবং বহুশরিকের বহুবর্ণিল পৃথিবীই আমাদের কাম্য। ভারতের সংবিধানে ২২টি ভাষার স্বীকৃতি সেই বহুস্বরবিশিষ্ট মাতৃভূমির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
একুশে ফেব্রুয়ারি (International Mother Language Day) আমাদের মনে করিয়ে দেয় মূলত দুটি দায়িত্বের কথা। স্ব-স্ব মাতৃভাষার প্রতি অনিঃশেষ অহংকার পোষণের আর অন্য ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার। বাংলাভাষাকে প্রতিটি নিঃশ্বাসে বহন করতে হবে, রক্ষা করতে হবে, বিকশিত এবং ফুল্ল-কুসুমিত করে তুলতে হবে। যেকোনও আগ্রাসন যা আমার ভাষার মুখ মলিন করতে উদ্যত, তাকে রুখে দিতে হবে। পাশাপাশি, অন্য ভাষাকে সম্মানের সঙ্গে প্রণতি জানাতে হবে, তাকে পারলে জানতে হবে। তার প্রতি কোনও অন্যায় হলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে একজোট হতে হবে। প্রশ্নটা গণতন্ত্রের। ভাষারক্ষার অধিকার, সর্বার্থেই মানুষের অধিকার। আয়ুজুড়ে যেন ভাষার অহংকার ঝলমল করে। সবার ভাষার। আমার ভাষার। বাংলাভাষার।