অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছিলেন জয়া মিত্র (Jaya Mitra)। ছিলেন সৌন্দর্যের পূজারি, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী। জন্ম ১৯৩৬ সালে ২ ফেব্রুয়ারি। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে রক্ষণশীল পরিবারে। বাবা বৈদ্যনাথ ঘোষ। মা নীহারকণা দেবী। দাদা অলোক ঘোষ। বাড়িতে ভোরবেলা থেকে শুরু হত পূজা-অর্চনা, সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি এবং রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা থেকে পাঠ। অনেক সাধুসন্তের যাতায়াত ছিল। ছোটবেলা থেকে এই পরিবেশে ও যৌথপরিবারে বড় হওয়ায় সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন তাঁর চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যায়। বাড়িতেই শুরু পড়াশুনা। ১৯৪৩ সালে, সাত বছর বয়সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন মিশনারি ডাফ স্কুলে। মিশনারি স্কুল, তাই বাইবেল পড়তেই হত। প্রভু যিশুর জীবনী নিয়ে নাটক হত বছরের শেষে। কিন্তু স্কুলটি তখন ছিল ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। ক্লাসে বরাবর প্রথম হতেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর সেতার, পিয়ানো ও নাচ শিখতেও শুরু করেন। এরপর প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করে ১৯৫২ সালে বেথুন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার জন্য ভর্তি হন। বেথুনে পড়ার সময়ই তিনি তাঁর মামার সঙ্গে পণ্ডিচেরি যান। সেই প্রথম ছিল তাঁর বাইরে যাত্রা। এই যাত্রাই বদলে দেয় তাঁর জীবন। জানা যায়, তাঁদের থাকার জন্য শ্রীমায়ের নির্দেশে খুলে দেওয়া হয়েছিল আশ্রমের দিলীপকুমার রায়ের বাড়িটি। বাড়ির ভিতর ঢুকে তিনি রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। দর্শনের লাইনে শ্রীমাকে দেখে তিনি মুগ্ধ হন ও তারপর সারা আশ্রমে ছায়ার মতো তিনি তাঁকে অনুসরণ করেন। কলকাতায় ফেরার আগে দর্শনের সময় শ্রীমায়ের হাত থেকে আশীর্বাদস্বরূপ একটি গোলঞ্চ ফুল পান। শ্রীমা এই ফুলের পাঁচটি পাপড়ির নাম দিয়েছিলেন Sincerity, aspiration, devotion, faith & surrender. সেটি ছিল ১৯৫৩ সাল। পণ্ডিচেরি থেকে ফিরে আসার পর তাঁর মনের মধ্যে সর্বদাই শ্রীমায়ের কথা মনে হতে থাকে। ইতিমধ্যে আইএ পড়তে পড়তে বাবা-মা তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। সেটি ছিল ১৯৫৪ সাল।
১৯৬৩ সালে তাঁর বাবার মৃত্যু হয় এবং তিনি গভীরভাবে শোকাহত হন। ১৯৬৫ সালে তাঁর পরিচয় হয় প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি ছিলেন শ্রীমায়ের যন্ত্র। পেশায় তিনি ছিলেন গ্লাসগো থেকে পাশ করা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। জয়াদেবী প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্যের মারফত শ্রীমায়ের কাছে হাতে তৈরি করা কুশন কভার ও তাঁর অন্যান্য শিল্পকর্ম পাঠাতেন। প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্য সকলের কাছে ড্যাডি বলে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ১৩ নভেম্বর টালিগঞ্জে লক্ষ্মী হাউসে শ্রীমায়ের আশীর্বাদ নিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক বিভাগ ‘শক্তি সেন্টার’। শ্রীমা-ই এই নামকরণ করেন।
১৯৭০ সাল থেকে জয়াদেবীর (Jaya Mitra) নিয়মিত পণ্ডিচেরি যাওয়া শুরু হয়। তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে শ্রীঅরবিন্দের প্রচার করেন। ১৯৭১-’৭২ সালে মধ্যমগ্রামে শ্রীঅরবিন্দের শতবর্ষ পালন করেন।
১৯৭২ সালে শ্রীঅরবিন্দের জন্মশতবার্ষিকীতে অরুণ ঠাকুর লক্ষ্মী হাউসে নার্সারি স্কুল করার প্রস্তাব করেন শ্রীমায়ের কাছে। শ্রীমা সানন্দে সম্মতি দেন ও নামকরণ করেন অরুণ নার্সারি স্কুল। ১৯৭৫ সালে অরুণ ঠাকুর মৃত্যুশয্যায় শুয়েই লক্ষ্মী হাউস পরিচালনার জন্য একটি সংগঠন তৈরি করেন ও নামকরণ করেন শ্রীঅরবিন্দ ইনস্টিটিউট অফ কালচার। এই ইনস্টিটিউটের সভাপতি করেন প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্যকে। আগে তিনি কলকাতায় এলে থাকতেন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে শ্রীমায়ের নির্দেশে এই ইনস্টিটিউটেই থাকতেন। প্রথম প্রথম জয়াদেবী শ্যামবাজার থেকে আসা-যাওয়া করতেন ড্যাডির সঙ্গে দেখা করতে ও পরে তাঁর দেখাশোনার ভার পড়ে জয়াদেবীর উপর।
১৯৭৫ সাল থেকে শুরু হয় জয়াদেবীর ইনস্টিটিউটে কর্মজীবনের অধ্যায়। এই প্রতিষ্ঠানে পাড়ার ছেলেরা আসত ফুল চুরি করতে। এই ছেলেদের নিয়ে উদ্যোগী হয়ে তিনি ড্যাডিকে বলে ‘দেবসংঘ’ নাম দিয়ে খেলাধুলোর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তখন থেকে ‘আমাদের আশ্রম’ বলে তারা চারদিক দেখাশোনার ভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। ‘আশ্রম’ নামটা কিন্তু পাড়ার ছেলেদের দেওয়া।
অগ্নিযুগের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। যিনি বিশ্ববিখ্যাত হন মহাযোগী ঋষি অরবিন্দ নামে। তাঁর বিপ্লবী জীবনের প্রধান কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ১৯০৬ থেকে ১৯১০ সালের গোড়া পর্যন্ত তিনি কলকাতায় ছিলেন। তারপর পণ্ডিচেরিপর্ব।
আরও পড়ুন-শনিবার দঃ২৪ পরগণা জেলার কোভিড পর্যালোচনা বৈঠক করবেন অভিষেক বন্দোপাধ্যায়
১৯৭৭ সালে সবার উৎসাহে পণ্ডিচেরি থেকে শ্রীঅরবিন্দের স্মারক আসে ২৪ জুন। দেবতা এলেন ঘরে। তিনি ধ্যানঘরে প্রতিষ্ঠিত হন। লক্ষ্মী হাউস শ্রীঅরবিন্দের পবিত্র আশ্রমকেন্দ্রে উন্নীত হয়। জয়াদেবী প্রতিদিন নিজ হাতে সামাধি সাজাতেন। ১৯৭৮ সালে শ্রীমায়ের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রীমায়ের উপর নিশিকান্ত, দিলীপকুমার রায় এবং অন্যান্য সবার গান সুচিত্রা মিত্র, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্য নামী শিল্পীর কণ্ঠে জয়া মিত্রের গ্রন্থনা অবলম্বনে গ্রামোফেন কোম্পানি একটি এলপি রেকর্ড (ডিস্ক) বার করে। গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে এ-ব্যাপারে সহযোগিতায় ছিলেন বিমান ঘোষ ও ভাষ্যপাঠ করেন বিকাশ রায়।
মায়া মিত্র পণ্ডিচেরি চলে যাওয়ার পর সাংস্কৃতিক বিভাগ শক্তি সেন্টারের দায়িত্ব তাঁর ওপর এসে পড়ে। শ্রীঅরবিন্দের ‘সাবিত্রী’ নাটকের নৃত্যরূপ দেন জয়াদেবীর (Jaya Mitra) উৎসাহে অলকানন্দা রায়, শান্তি বসু। ১৯৮০ সালে ‘বন্দে মাতরম্’ মঞ্চস্থ হয়। কেন্দ্রীয় ভূমিকায় ছিলেন পদ্মশ্রী সংযুক্তা পাণিগ্রাহী।
অরুণ নার্সারি স্কুলটি ১৯৮১ সাল থেকে জয়াদেবী দেখাশোনা করেন অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ‘ফিউচার ফাউন্ডেশন স্কুল’ প্রতিষ্ঠত হয়। তিনি স্কুলের অধ্যক্ষা ছিলেন। এইজন্য তিনি ইংরেজিতে এমএ ও বিএড পাশ করেন তাঁর ব্যস্ত কর্মসূচির মধ্যে।
১৯৮২ সাল থেকে সংযুক্তা পাণিগ্রাহী প্রতিমাসে চারদিন করে আসতেন কর্মশালা করবার জন্য। সারা শহর চমকে উঠেছিল জয়াদেবী পরিকল্পিত ‘রাগ ও রূপে’র নৃত্যরূপ দেখে। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের উপদেশ অনুযায়ী তাঁর ভাষ্যরচনার নৃত্য ও সঙ্গীতরূপ দিয়েছিলেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, সংযুক্তা পাণিগ্রাহী এবং শাশ্বতী সেন। কত্থক ও ওডিশির মিলনে এতবড় নৃত্যানুষ্ঠান আগে কোনওদিনও হয়নি।
১৯৯০ সালে কলকাতার ৩০০ বছরের উৎসবেও ইনস্টিটিউটকে যুক্ত করেন। প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। এই মেলায় বিভিন্ন জায়গা থেকে শিল্পীরা আসতেন তাঁদের পশরা নিয়ে। এর সঙ্গে ছিল স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বার্ষিক অনুষ্ঠান। আসতেন জয়াদেবীর (Jaya Mitra) শুভাকাঙ্ক্ষী শিল্পীরা। আসতেন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, পণ্ডিত রশিদ খান, পণ্ডিত যশরাজ, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, সংযুক্তা পাণিগ্রাহী, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো নামী শিল্পীরা। তাঁর আমন্ত্রণে খুশি হয়ে আসতেন বাউল ও পটশিল্পীরা। তিনি পটশিল্পীদের সবার সামনে তুলে ধরেন ও তাঁর সাহায্যে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে তাঁদের পশরা নিয়ে উপস্থিত হন। ইতিমধ্যে শান্তিসুধা ঘোষ তাঁর গড়িয়ার বাড়িটি জয়াদেবীর হাতে তুলে দেন জনহিতকর কাজের জন্য। জয়াদেবী সেখানে ধূপ তৈরি ও তাঁতে গামছা ইত্যাদি তৈরির ব্যবস্থা করেন। সেইসব জিনিস পণ্ডিচেরির আশ্রমবাসীদের ব্যবহারের জন্য পাঠাতে থাকেন। পল্লিবাসীদের নিয়ে নবান্ন উৎসব করেন তাঁদের উৎসাহিত করার জন্য।
শ্রীঅরবিন্দের বিপ্লবীজীবনের কাহিনি ও এই মহানগরীর যে গৃহ ও স্থানগুলি তাঁর সংগ্রামীজীবনের স্মৃতিবিজড়িত সেগুলির ইতিহাস তুলে ধরার জন্য জয়াদি বিশেষভাবে সচেষ্ট হন। এই কাজের জন্য তিনি বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতা পান।
১৯৯০ সালে কলকাতা পৌরসংস্থার উৎসাহ ও সহযোগিতা এবং শ্রীঅরবিন্দ ইন্সটিটিউট অফ কালচারের উদ্যোগে গঠিত হয় শ্রীঅরবিন্দ ও কলকাতা স্মৃতিরক্ষা কমিটি। কমিটির কার্যালয় ছিল রিজেন্টি পার্কের লক্ষ্মী হাউস। সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক নিশীথরঞ্জন রায়। অন্যান্য সদস্যর মধ্যে ছিলেন কলকাতার মেয়র কমল বসু, ডিপুটি মেয়র মণি সান্যাল, মেয়র-কাউন্সিলের অধ্যক্ষ পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত, বিচারপতি শ্যামল সেন, অধ্যাপক গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক শান্তিময় রায় ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সকলেই আগ্রহে জয়াদেবীর আহ্বানে এই প্রশংসনীয় উদ্যেগে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রথমে শ্রীঅরবিন্দের স্মৃতিবিজড়িত তিনটি স্থানে ‘শ্রীঅরবিন্দ স্মৃতিফলক’ বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। ওই স্থানে বা গৃহগুলি হল ড. বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, ৪ নং শ্যামপুকুর লেন, ১০২ শ্রীঅরবিন্দ সরণি। ২ মে ১৯৯০ সালে ফলক বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ ১৯০৮ সালের ২ মে ১০২ শ্রীঅরবিন্দ সরণির বাড়ি থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে।
বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের এক স্মরণীয় দিন ২ মে, ১৯৯০। শ্রীঅরবিন্দ ও কলকাতা স্মারকফলক উন্মোচন উপলক্ষে শ্রীঅরবিন্দ ইনস্টিটিউট অফ কালচার একটি স্মারক প্রচারপত্র প্রকাশ করে। ২ মে ১৯৯০ সালে স্মৃতিফলক স্থাপন অনুষ্ঠান হয় ও ফলক উন্মোচন করা হয়।
জয়াদেবীর (Jaya Mitra) অক্লান্ত পরিশ্রমে এই কাজ সম্ভব হয়েছিল। কখনও অধ্যাপক নিশীথরঞ্জন রায়ের সঙ্গে, কখনও একাই কাজ চালিয়ে যান। স্মৃতিফলক বসানোর জন্য এইসব বাড়ির গৃহকর্তাদের আশ্বাস দিতে হয় এইসব বাড়ি হেরিটেজ হবে না এবং তারপর তাঁরা দেওয়ালে ফলক স্থাপনের অনুমতি দেন।
১২ ওয়েলিংটন স্কোয়্যারের বাড়িটির সন্ধান পাওয়ার পর দারোয়ানের কাছে গিয়ে জয়াদেবী (Jaya Mitra) বাধার সম্মুখীন হন। কারণ তাঁকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তিনি তখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে গিয়ে ও অনুমতি নিয়ে সেই বাড়ির গেট খোলার ব্যবস্থা করেন। পাহাড়প্রমাণ জঞ্জাল ও আবর্জনা সাফ করতে একজন টানারিকশাওয়ালা ও সেই রিকশাওয়ালা পাড়ার লোকজনকে ডাকেন। জয়াদেবীর এইরকম সাহস ও মনোবল দেখে তাঁরা মুগ্ধ হন। সকল শ্রেণির লোকের সহযোগিতায় এই জায়গায় ফলক-উন্মোচন সম্ভব হয়। ছকু খানসামা লেনের বাড়িটির খোঁজ প্রথমে কেউই দিতে পারেননি। বেশ কয়েকদিন যাতায়াত ও অনেক সাধ্যসাধনার পর ওই বাড়িতে প্রবেশ করা সম্ভব হয়। আবিষ্কৃত হয় একটি বইয়ের তাক ও তার পিছনে একটি সুড়ঙ্গপথ। একজন মানুষই ওই পথ দিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন। রহস্যভেদের নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন জয়াদেবী। কিছু খোঁজখবর পাওয়া যায় আলিপুর কোর্টের কাগজপত্র ঘেঁটে। কলকাতা পৌরসভার তৎকালীন মেয়র পরিষদের অধ্যক্ষ পূর্ণেন্দু সেনগুপ্তর সহযোগিতায় অনেক বাধাই দূর হয় ও বাড়িটির সামনে ফুটপাতের দেওয়াল ঘেঁষে ফলক লাগানো হয়।
মুরারিপুকুরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে চারদিন প্রচেষ্টার পর জয়াদেবী সেখানে পৌঁছান। তীব্র কটুগন্ধের অ্যাসিডজল, গোবরজল, দুর্গন্ধ, নোংরা এড়িয়ে ডিঙিয়ে তিনি মূল বাড়িটির কাছে পৌঁছান। জেদি জয়াদেবী শেষপর্যন্ত পৌঁছে দেখেন মূল বাড়িটির অর্ধেক মাটির তলায় চলে গেছে। অন্য কোনও জায়গা না থাকায় অগ্যতা স্থানীয় কাউন্সিলারের সাহায্যে সংলগ্ন একটি পার্ক রেলিং দিয়ে ঘিরে তার গায়ে ফলক বসানো হয়। গ্রে স্টিটের বাড়িটি আগেই ভাঙা হয়েছিল। ফলে সেখানে ফলক লাগানোর কোনও প্রশ্নই ছিল না। তবুও বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের তীর্থস্থানস্বরূপ স্থানটি যাতে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের মানুষ চিহ্নিত করে অগ্নিযুগের কথা স্মরণ রাখতে পারেন তার জন্য পাশের একটি জায়গা নির্বাচন করে ফলক লাগানো হয়। জয়াদেবী অনেক সহযোগিতা ও সাহায্য পেয়েছিলেন কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের হেরিটেজ আন্দোলনের পথিকৃৎ নিশীথরঞ্জন রায়ের কাছে। এক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহ। পৌরসভায় জয়াদেবী একটি চিঠিতে শ্রীঅরবিন্দ ইন্সটিটিউট অফ কালচারের পক্ষ থেকে লেখেন— ‘আপনার সঙ্গে কলকাতায় শ্রীঅরবিন্দ স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলিতে ফলক লাগানো সম্বন্ধে আমরা ইতিমধ্যে কথাবার্তা বলেছি। আমরা এইজন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহ করতে প্রস্তুত আছি। প্রস্তরের (মার্বেল) স্মৃতিফলকগুলি প্রস্তুত করার সব দায়িত্ব আমাদের। আপনি অনুগ্রহ করে এই ফলকগুলি স্থাপনের দায়িত্ব দিলে বাধিত হব।’
১৯৯৫ সালে শ্রীমায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তৈরি করেন গ্যালারি লা মেয়র। শ্রীমা ছিলেন ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী। সেই জন্য তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই গ্যালারি তৈরি করেন। এই বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্য শিল্পীরা। ১৯৯৫ সালের ৭ জানুয়ারি এ্যানুয়েল নাম নিয়ে প্রদর্শনীটি শুরু হয়। উদ্বোধন করেন পরিতোষ সেন। বছরে চারটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন।দ্বিতীয়টি±±
প্রথমে ৭ জানুয়ারি অ্যানুয়েল, ‘পরমা’। শ্রীমায়ের জন্মদিনে এই প্রদর্শনীতে কেবলমাত্র মহিলা শিল্পীদের আঁকা ছবি স্থান পায়। ১৫ অগাস্ট শ্রীঅরবিন্দের জন্মদিনে ফ্রিডম ও মহালয়ার দিনে ‘দুর্গা’। কলকাতার সব শিল্পীই অপেক্ষা করে থাকেন এই প্রদর্শনীতে ছবি দেওয়ার জন্য।
ছাত্রছাত্রী ছাড়াও আর যাঁরা আশ্রমে আসতেন তাঁদের জন্য গড়ে তোলেন গ্রন্থাগার। অধ্যাপক বিশ্বনাথ রায় প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে শ্রীঅরবিন্দের লেখা থেকে পাঠ ও আলোচনা করতেন। ড. শিখা মুখোপাধ্যায় গীতার ক্লাস নেন। তার সঙ্গে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় সমবেত ধ্যান। অরুন্ধতী রায়চৌধুরি নিয়মিত ক্লাস নিতেন।
জয়াদেবীর জীবনের আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আলিপুর বোমা মামলার হারিয়ে যাওয়া নথিপত্র উদ্ধার হওয়ার পর কলকাতার জজ কোর্টে যে ঘরটিতে শ্রীঅরবিন্দের বিচার হয় সেই স্মরণীয় বিচারালয়টি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। বোমা মামলার ১৯২৬ সালের বইয়ের ফটোকপি বাঁধিয়ে আনেন কাজের সুবিধার জন্য। পণ্ডিচেরি থেকে পিটার হিস আসেন। জয়াদেবী প্রাথমিকভাবে অর্ধেক স্টিল আলমারি ও ডিসপ্লে বক্সের ব্যবস্থা করেন। তাঁর যোগাযোগে দিল্লির নেহরু মিউজিয়ামের ডিরেক্টর হরিদেব শর্মার কর্মচারী মাইক্রোফিল্মের যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে টালিগঞ্জ ইন্সটিটিউট থেকে প্রায় ৮-৯ হাজার মাইক্রোফিল্ম করেন। জয়াদেবী সবার বাসস্থান ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে বিচারকক্ষ দখল করে কাজ শুরু করেন। শ্রম ও অর্থের হিসাবনিকাশের মূল্যায়নে সমগ্র সিংহভাগ কাজের ভার বহন করেন জয়াদেবী (Jaya Mitra) ১৫ অগাস্ট ১৯৯৮ সালে আলিপুর আদালতের স্মরণীয় বিচারালয় সংগ্রহ ও শ্রীঅরবিন্দ স্মৃতি বিচারকক্ষের উদ্বোধনের দিন পর্যন্ত।
যুগান্তরে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনগুলি নিয়েও জয়াদেবী একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। যদিও যুগান্তর থেকে সংকলিত ‘অগ্নিযুগের অগ্নিকথা’ বইখানির প্রকাশ তিনি দেখে যেতে পারেননি।
বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে আলিপুর কোর্টের মামলার নথিপত্র ও সেই সময়ের ঘটনার দলিল, ছবি, প্রমাণ্য খুঁটিনাটি— সব জিনিসপত্র জোগাড় করে লক্ষ্মী হাউসে শব্দ ও আলোর সংযোজনে জনগণকে দেখবার ব্যবস্থা করেন। এই কাজে ±হায়তা করেছিলেন অন্যদের সঙ্গে শিল্পী অমিত সরকার।
জয়া মিত্র। জয়াদেবী। আপনজনদের জয়াদি। ১৯৯৯ সালের ২৪ জুলাই, শ্রীমা ও শ্রীঅরবিন্দের চরণে আশ্রয় লাভ করেন। রেখে যান অগণ্য গুণমুগ্ধ ও শ্রীঅরবিন্দ ইনস্টিটিউট অফ কালচারের কর্মিবৃন্দকে। আজও সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর অতি-প্রিয় মন্ত্র তাঁরই কণ্ঠে বেজে ওঠে।
Open my mind, my heart, my life to your light. Your love, your power in all things may I see the Divine.
তথ্য সহায়তা : শ্রীলেখা মজুমদার