কুমারী কন্যার তটে

আজ ১২ জানুয়ারি, স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। কন্যাকুমারীর সঙ্গে আশ্চর্যভাবে জড়িয়ে গেছে স্বামী বিবেকানন্দের নাম। ভারতবর্ষের এই শেষ বিন্দুতে এসে ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন বীর সন্ন্যাসী। তাঁর স্মৃতিতে এখানে নির্মিত হয়েছে স্মারকস্থল। সারা বছর আসেন বহু পর্যটক। ঘুরে দেখেন। কন্যাকুমারীতে আছে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান। শীতের মরশুমে কয়েক দিনের জন্য ঘুরে আসতে পারেন। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতি বিজড়িত কন্যাকুমারী (kanyakumari)। অবস্থান ভারতবর্ষের একেবারে শেষ বিন্দুতে। ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরের মিলনক্ষেত্রে, ত্রিবেণী সঙ্গমে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, এখানে তিনটি সমুদ্রের পৃথক পৃথক রং স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ঋতু এবং আবহাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে রং পরিবর্তিত হয়। সমুদ্র সৈকতে কাটিয়ে দেওয়া যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
কন্যাকুমারী নামটি এসেছে হিন্দু দেবী কন্যাকুমারীর (kanyakumari) নামানুসারে। তামিলনাড়ুর সবচেয়ে নির্মল এবং সুন্দর শহরগুলির মধ্যে একটি। এখানে ঘটেছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব মিশ্রণ। পাশাপাশি লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আধ্যাত্মিক মনোভাবাপন্ন মানুষের যেমন ভাল লাগে, তেমন ভাল লাগে নির্ভেজাল প্রকৃতিপ্রেমীর। স্বামী বিবেকানন্দের পদস্পর্শে ধন্য সমুদ্রতীরবর্তী শহরটি ছুটি কাটানোর জন্য একটি আদর্শ স্থান। কন্যাকুমারীর আশেপাশে আছে বেশ কয়েকটি বেড়ানোর জায়গা। সেগুলো হল :

বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল
একটি ছোট্ট দ্বীপ। কন্যাকুমারীর (kanyakumari) বাবাতুরাই-এর কাছে মূল ভূখণ্ড থেকে ৫০০ মিটার দূরে সমুদ্রের উপর অবস্থিত। এই দ্বীপেই আছে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল। কারণ এখানেই ১৮৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বামী বিবেকানন্দ তিনদিনের ধ্যানের পরে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এখানে বসেই তিনি ভারতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দীর্ঘক্ষণ চিন্তা করেছিলেন। তারই স্মৃতিতে ১৯৭০ সালে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল কমিটি এখানে একটি স্মারকস্থল নির্মাণ করেন। তামিলনাড়ুর দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। কন্যাকুমারী থেকে লঞ্চ ছাড়ে বিবেকানন্দ রকের উদ্দেশ্যে। উথালপাথাল ঢেউ পেরিয়ে লঞ্চের জার্নি এককথায় রোমাঞ্চকর। সমুদ্রের মাঝখানে পাথরে টিলার উপর তৈরি বিবেকানন্দ রকের নির্মাণে লেগেছে অজন্তা এবং ইলোরার গুহা মন্দিরের আদল। সেখানে রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের বিশালাকার ব্রঞ্জের মূর্তি। অনেক জায়গার মধ্যে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল কন্যাকুমারীর প্রধান আকর্ষণ। শান্ত পরিবেশে মনের মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাবের উদয় হয়। এখান থেকে আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থল দেখা যায়। প্রতি বছর ১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে আসেন বহু মানুষ।

ভগবতী আম্মান মন্দির
প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো মন্দির। প্রাচীন স্থাপত্যের আশ্চর্য নিদর্শন। এটা দেবী কন্যাকুমারী (kanyakumari) মন্দির নামেও পরিচিত। ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি। কন্যাকুমারীর সবচেয়ে ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিকভাবে উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। মন্দিরে কন্যাকুমারী আম্মানের একটি মূর্তি রয়েছে। দেবীর হাতে একটি জপমালা এবং নাকে সোনার নথ। প্রতিদিন অগণিত ভক্ত সমাগম হয়। বহু মানুষ পুজো দেন।

সাঙ্গুথুরাই সৈকত
কন্যাকুমারীর সাঙ্গুথুরাই সমুদ্র সৈকত শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা। এই সৈকতে আছড়ে পড়ে ভারত মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ। বহু পর্যটক অপলক তাকিয়ে থাকেন সমুদ্রের দিকে। উপভোগ করেন ভয়ংকর সৌন্দর্য।

আওয়ার লেডি অফ র‍্যানসম চার্চ
কন্যাকুমারীতে অবস্থিত একটি বিখ্যাত ক্যাথলিক চার্চ। মাতা মেরির উদ্দেশ্যে নিবেদিত। জানা যায়, চার্চটি পঞ্চদশ শতকে তৈরি। এটা গথিক স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। নীল চার্চের পিছনে উত্তাল সমুদ্র। এই চার্চটি না দেখলে কন্যাকুমারী ভ্রমণ অসম্পূর্ণ।

সেন্ট জেভিয়ার চার্চ
প্রায় ৪০০ বছর আগে তৈরি। অবস্থান নাগেরকোয়েলে। এই চার্চ কন্যাকুমারীর বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলির মধ্যে একটি। স্থানীয়রা বলেন, এই গির্জায় অলৌকিক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। সেন্ট জেভিয়ার চার্চটি দেখার জন্য বহু পর্যটক আসেন।

তিরুভাল্লুভার মূর্তি
তিরুভাল্লুভার ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক এবং কবি। তামিল সাহিত্যে তাঁর বিরাট অবদান। দক্ষিণ ভারতে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। কন্যাকুমারীতে আছে তিরুভাল্লুভার বিশাল মূর্তি। বহুদূর থেকে দেখা যায়। পর্যটকরা কন্যাকুমারী বেড়াতে এলে এই মূর্তিটি ঘুরে দেখেন।

আরও পড়ুন-বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতে খরচ কমের সিদ্ধান্ত হল বৈঠকে

থিরপারপ্পু জলপ্রপাত
কন্যাকুমারীর জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলির মধ্যে একটি। মানুষ-সৃষ্ট এই জলপ্রপাতের নিচে একটি পুকুরে প্রায় ৫০ ফুট উপর থেকে জল ঝরে পড়ে। জলপ্রপাতের আশপাশে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটানো যায়। অনেকেই পুলে স্নান করেন। এখানে আছে পিকনিক স্পট। বহু মানুষ পরিবার বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন। জলপ্রপাতের প্রবেশদ্বারের কাছে আছে একটি ছোট শিব মন্দির। চাইলে পুজো দেওয়া যায়।

থানুমালয়ন মন্দির
সুচিন্দ্রামের পবিত্র মন্দিরটি ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং দেবাদিদেব মহাদেবকে স্মরণ করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ। এই মন্দির ত্রিমূর্তি নামেও পরিচিত।

ভাট্টকোট্টাই দুর্গ
ভাট্টকোট্টাই ফোর্ট মানে ‘বৃত্তাকার দুর্গ’। সমুদ্রতীরবর্তী এই দুর্গটি কন্যাকুমারীর কাছে অবস্থিত। অসাধারণ নির্মাণ। দুর্গটি বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সুরক্ষার অধীনে রয়েছে। বহু মানুষ ঘুরে দেখেন।

পদ্মনাভপুরম প্রাসাদ
তিরুবনন্তপুরম থেকে ৬৪ কিমি দূরে অবস্থিত পদ্মনাভপুরম প্রাসাদ। এই প্রাসাদ ত্রাভাঙ্কোরের শাসকদের তৈরি। এখানে আছে থুকালয় মন্দির। মন্দিরটি আদিবাসী কেরালা স্থাপত্যের একটি সুন্দর উদাহরণ। প্রাসাদটি সুপ্রাচীন। তবু এর ম্যুরাল, দুর্দান্ত খোদাই আজও অক্ষত থেকে গেছে। কন্যাকুমারীর অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

মায়াপুরী মোম মিউজিয়াম
এই মোম মিউজিয়ামটি লন্ডনের মাদাম তুসো মোম মিউজিয়ামের আদলে তৈরি। এখানে মহাত্মা গান্ধী, চার্লি চ্যাপলিন, মাদার তেরেসা, মাইকেল জ্যাকসনের মতো বিখ্যাত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের মোমের মূর্তি রয়েছে। কন্যাকুমারী (kanyakumari) শহরের অন্যতম আকর্ষণ।

চিথারাল জৈন স্মৃতিস্তম্ভ
স্থাপত্যের অনুরাগী এবং জৈন তীর্থযাত্রীদের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্য চিথারাল জৈন স্মৃতিস্তম্ভ। জায়গাটা ঐতিহাসিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চিথারাল একসময় দিগম্বর জৈন সন্ন্যাসীদের আবাসস্থল ছিল। এখানে নবম শতকের বিভিন্ন দেবদেবীর খোদাই করা একটি গুহা মন্দির রয়েছে। জৈনদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষরাও এই স্মৃতিস্তম্ভ ঘুরে দেখেন।

সানসেট পয়েন্ট
সানসেট পয়েন্ট কন্যাকুমারীর অন্যতম জনপ্রিয় স্থান। উত্তাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে বহু মানুষ সূর্যাস্ত দেখেন। সেই সময় আশ্চর্য রকমের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে পর্যটকদের মনে। মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দি করেন ফটোগ্রাফাররা।

গান্ধী মণ্ডপম
জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর ভস্ম সম্বলিত ১২টি কলসের মধ্যে একটি রাখা হয়েছে। এখানে আছে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী। আছে লাইব্রেরিও। সেখানে সুরক্ষিত আছে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী অসংখ্য পত্রিকা, বই এবং অন্যান্য প্রকাশনা।

সুনামি মনুমেন্ট
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগর জুড়ে ভূমিকম্প এবং সুনামিতে মারা যান হাজার হাজার মানুষ। শুধু ভারতেই নয়, সোমালিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়াতেও অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাঁদের স্মরণে তৈরি হয়েছে সুনামি মনুমেন্ট। এই স্মৃতিসৌধ কন্যাকুমারীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। সর্বস্তরের দর্শনার্থীরা এই স্মৃতিসৌধে যান। শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মৃতদের প্রতি।

কীভাবে যাবেন?
ট্রেনে অথবা বিমানে চেন্নাই। চেন্নাই থেকে যেতে হবে মাদুরাই। মাদুরাই থেকে বাস যায় কন্যাকুমারীর দিকে। সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টার মতো।

কোথায় থাকবেন?
কন্যাকুমারীতে আছে অসংখ্য হোটেল এবং সরকারি গেস্ট হাউস। যাওয়ার আগে ওয়েবসাইট দেখে নেবেন। সম্ভব হলে করে নেবেন বুকিং। খরচ নাগালের মধ্যে। থাকা এবং খাওয়ার কোনও সমস্যা হবে না।

Latest article