মাধুকরী

Must read

সুপর্ণা চ্যাটার্জি ঘোষাল: রাসমঞ্চ থেকে এই কদমতলা অবধি আসতে কম বাঁক পেরোতে হয়নি সংকীর্তনের দলটিকে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দু-পাশে গেরস্ত ঘর। প্রতি বাঁকেই ভক্তিমতী মায়েরা দাঁড়িয়ে। মাথায় ঘোমটা, চোখে আকুলতা। দুই হাতে ধরে থাকা জলপূর্ণ ঘটিতে যেন জল নেই, পূর্ণ হয়ে রয়েছে তাদের আত্মিক নিবেদনে। সংকীর্তনের দলটি এগিয়ে আসতেই, তাঁদের চরণ ধুইয়ে দিচ্ছেন সেই জল দিয়ে। দলটি এগিয়ে যাওয়ায়, পিছনে, ক্ষণস্থায়ী কাদার কুণ্ডে পড়ে থাকছে চরণচিহ্ন। কেউ কেউ মাথা ঝুঁকিয়ে সেই কাদায় কপাল ঠেকাচ্ছে। সিঁদুরের উপরে, পাঁক-রঙা আরও একটি ছাপ পড়ছে তাদের কপালে। নিবেদনের ছাপ।

সংকীর্তন দলটি বেশ বড়। আধুনিক কোনও যন্ত্রপাতি নেওয়ার চল নেই এখানে। বহুদিন ধরেই এই রেওয়াজ। অন্যান্য সংকীর্তনের মতো মাইক্রোফোন আর চোঙাও লাগানো হয় না। বাদকদলের গলায় ঝুলছে খোল, করতাল, মৃদঙ্গ। হাঁটু অবধি পৌঁছেছে, এমন বাচ্চাদের হাতে খঞ্জনি।
বাদকদের একেবারে সামনেই গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলল একটি যুবক। গায়ের রঙ দুধে আলতা, কোঁকড়ানো চুল এলিয়ে পড়েছে কাঁধ ছুঁয়ে। নাভির উপরে চন্দন রঙের ধুতিটি বাঁধা। গায়ে সাদা উত্তরীয় আর গলায় পাঁচপাতা টগরফুলের মালা। পা-দুটিই কেবল তার কাদায় মাখামাখি। শুকনো হওয়ার জো নেই। ভক্তির মহিমা বড় বিকট। দেবতাকে অসুস্থ করে তোলে।
তবু যুবকের মধ্যে কোনও হেলদোল নেই। তার উদাত্ত কণ্ঠ থেকে হরিনাম ভেসে আসে, ‘হরি হরায় নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ…।’ কেউ লক্ষ্য করলে বুঝবে, রাসমঞ্চে সে যখন আজ সকালে গাইতে উঠেছিল, তার তুলনায় গলা এখন সামান্য ভেঙে গেছে। পায়ে ক্রমাগত ঠান্ডা জল পড়তে থাকলে স্বয়ং হরিও অসুস্থ হতেন। সে আবার গাইছে একটানা। বিশ্রাম পায়নি তার স্বরতন্ত্রী। গুরুবন্দনার পরেই, কেউ জানে না কেন সে সহসা মাথুরের পদ গাইতে আরম্ভ করে, ‘এ সখী হামারি দুঃখের নাহি ওর।’ চোখের জল গাল বেয়ে নেমে বুকের কাছে গড়িয়ে আসে।
শ্রোতাদের আসনে যেমন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ভক্তজন ছিল, তেমনই মুকুন্দ কবিরাজের মাঠাকরুণও ছিলেন। এই রাসমঞ্চের জায়গাটি কবিরাজরাই দান করেছেন। যেমন দান করেছেন কয়েক বিঘা ধানি-জমি। বছরে দু-বার নরনারায়ণ সেবায় লাগবে। রাস উপলক্ষে যে খরচখরচা হয়, তার অর্ধেকও মা’ঠানই বহন করবেন। অলিখিত নয়, রীতিমতো গ্রামের রাস পরিচালন সমিতির সঙ্গে লিখিত এগ্রিমেন্ট আছে। মানুষকে খেতে দেখলে বড় তৃপ্তি পান ম’ঠান।
‘শূন্য মন্দির মোর।’ গায়ক দু’হাত বাতাস মেলে ধরল। তার চোখ রাসমঞ্চের চাঁদোয়ার দিকে। শ্রীখোল আর হারমোনিয়ামের সঙ্গতে সেই চাঁদোয়া ভেদ করে উঠে যায় তার গান। তার ‘শূন্য’ বলার মধ্যে যে হাহাকার লুকিয়ে ছিল, শুনে মা’ঠান আঁচলে চোখের জল মুছলেন। হাতের সোনার মকরমুখ বালা আর রুলিতে ঠোকাঠুকির শব্দ ওঠে। তসরের আঁচলে ছেপে ওঠে শুকনো জলের দাগ। গায়ের সঙ্গে আঁচলটিকে আরও জাপ্টে জড়িয়ে নিলেন। চোখ গায়ক ঠাকুরের দিকে নিবদ্ধ।
কার্তিক মাস, বাতাসে হিম-হিম ভাব আস্তে আস্তে বাড়ছে। উত্তরের ধানের জমিতে সোনারবরন রঙ লাগতে শুরু করেছে। আজ বাদে কাল ধান উঠবে। ঈশান কোণ থেকে আড়াই মুঠো ধান কেটে, লাল শালুতে মুড়ে প্রথম ধানের গোছা ‘মুঠ’ নিয়ে আসবে বাড়ির সবচেয়ে পুরনো মাইনদার। ধান্যলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণার পুজো হবে কবিরাজ বাড়িতে।
মাঠের আগে কবিরাজদের বিশাল পুকুর। তালগাছে ঘেরা। বাংলা বইয়ে যেমন ছবি থাকে, হুবহু এক! সেদিক থেকে একটা শিরশিরে বাতাস এসে অঙ্গ কাঁপিয়ে দেয়। বাতাসের সঙ্গে ধানের মধুগন্ধ। হরিমতী বাউড়ির পেটের খিদেটা চনচনিয়ে উঠল। রাসমঞ্চের সংকীর্তন শেষ হলেই সেবা দেওয়া হবে। খিচুড়ি, লাবড়া, আমড়ার চাটনি। গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি। খোদ গোবিন্দের নাম, গোবিন্দের ভক্তির সুঘ্রাণ। তারপর সংকীর্তন নামবে পথে। পথের ধুলোও পাপমুক্ত হবে হরিনাম সংকীর্তনে। হরিমতী কপালে মাথা ঠেকায়। গায়ক ঠাকুরটি বড় ভাল গাইছেন, এখন খিদের কথা মনে আনাও পাপ।
ছাতিমের ফুল শেষ হয়ে এল প্রায়। তবু এই পথে যেতেই প্রচুর ছাতিম গাছের সারি। সংকীর্তন দলের মাথায় দেবতার আশীর্বাদ ঝরে পড়ে। গায়ক ঠাকুরের হুঁশ নেই। তার বাবরি চুলে ছাতিম ফুল আটকে।
মা’ঠান হাঁটতে পারেন না বেশি। বয়স হয়েছে। তাঁর জন্য রিকশার ব্যবস্থা হয়েছে। সংকীর্তন দলের এক পাশ দিয়ে পায়ে পায়ে টেনে নিয়ে চলল রিকশাওয়ালা। আধবোজা চোখে মা’ঠান গায়কের হরিনাম শুনছেন। গায়কের মাথায় ছাতিম ফুল। ছেলেটির শ্বাসকষ্ট আছে কিনা একবার চিন্তা করেন মা’ঠান। মাথা থেকে ফুলগুলি ঝেড়ে দিতে পারলে ভাল হত। গেরস্ত বাড়ির অ্যান্টেনায় লালচে সূর্য আটকে। একটু পরেই আজকের পালা মিটিয়ে চলে যাবেন দিনমণি। এই অবেলায় গায়ে চাদর দেওয়া উচিত ছিল। আজ বড় শীত লাগে। শরীরের কাঁপুনি ক্রমাগত বেড়েই চলল।
হরিমতীর চোখও আধবোজা। সংকীর্তন দলে সবার পিছনে সে চলল। হাঁটুতে বাত। খুঁড়িয়ে হাঁটে। তাল রাখতে পারে না সবার সঙ্গে। সকালে বেরনোর সময় নিজের ভিক্ষার ঝুলিটি কাঁধে ঝুলিয়ে নিতে ভোলেনি। এই দিনান্তে এসে তাতে সামান্য চাল-আলু-কাঁচকলা পড়েছে। একটা মানুষের পেট। কতটুকুই বা অন্ন লাগে! আজ তার দেহে-প্রাণে বড় আরাম। গায়ক ঠাকুরের মিঠে গলায় সে যেন স্নান করছে। গঙ্গা স্নান।
সংকীর্তন দলটি একটি বাঁকে এসে সামান্য দাঁড়ায়। কয়েকজন মহিলা তাদের পা ধুইয়ে দেবে। হরিমতী সবার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে এগিয়ে যায়। তার মতো নিচু জাতকে ছুঁলে স্নান করতে হবে। অন্যদের বিড়ম্বনা বাড়িয়ে কী লাভ! কিন্তু গায়ক ঠাকুরকে তার সাক্ষাৎ নবদ্বীপের নিমাইয়ের মতো লাগে। কেন, তা সে নিজেও জানে না। গায়ক ঠাকুরের কাছে গিয়েই, সে তার পা-দুটি জড়িয়ে ধরে মাটিতে বসে পড়ে।
একজন খোলবাদক সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেও, গায়ক ঠাকুর হাত তুলে তাকে নিষেধ করে। বরং নিজেই ঝুঁকে হরিমতীকে দু-হাতে তুলে, ‘আমার শচীমাতা গো!’ বলে, বুকে জড়িয়ে ধরল। চতুর্দিক ভরে ওঠে ‘হরি, হরি’ রবে। মেয়েরা জোকার ধ্বনি তোলে। আজ হরিমতীর জীবন সার্থক হল।
মা’ঠান রিকশা থেকে নেমে গায়কের সামনে এসে দাঁড়ালেন। হরিমতীকে দেওয়ার মতো কিছু থাকলে, সে মা’ঠানকেও খালি হাতে ফেরত পাঠাবে না। তিনি দু’হাতের তালু বাড়িয়ে দিলেন গায়কের দিকে।
গায়ক ক্ষণকালের জন্য বিস্মিত হল-বা! তার চোখের পাতায় স্পন্দন দেখা গেল। পা ধোয়ানো হয়ে গিয়েছে গেরস্ত মায়েদের। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়ে, পরক্ষণেই গায়ক সমস্ত শব্দ ছাপিয়ে গেয়ে ওঠে, ‘একবার হরি বলে ডাক রে তোরা!’ হেমন্তের বিষণ্ণ আকাশে গিয়ে পৌঁছায় তার সুর। আর সে নিজের গলার মালাটি খুলে সমর্পণ করে মা’ঠানের পায়ে।
**
অদূরে গেরস্ত বাড়ির ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বালিয়েছে। পূর্বপুরুষেরা পথ চিনে ফিরবেন উত্তরপুরুষদের কাছে। বাতাসে অশরীরী হাত উত্তোলিত করে দেবেন আশীর্বাদ, আসুক সুখ, আসুক সমৃদ্ধি, আসুক জগতের সমস্ত তৃপ্তি।
সংকীর্তনের দল ফিরে গিয়েছে যে যার ঘরে। রাতের নিস্তব্ধতা আর জ্যোৎস্না ছাড়া কোথাও কেউ জেগে নেই। কিংবা আছে! অন্ধকার রাতের গভীরে কে জেগে থাকে, তা কে বলতে পারে? দূরে একটা খুড়ুলে পেঁচা ডেকে উঠল সশব্দে। বাঁশঝাড় থেকে সন্ত্রস্ত চড়ুইপাখির ঝাঁক জানান দেয়, এখানে শিকার করতে এসে লাভ নেই। অতন্দ্র প্রহরী হয়ে তারা বাসার ভিতরের শাবকদের রক্ষা করছে।
হরিমতী তার ভাঙা ঝুপড়ির মেঝেতে শুয়ে। ঝুপড়ির ভিতর আলো-চালের সুগন্ধ। হরিমতীর গায়ের ছেঁড়া কম্বলের উপর দিয়ে একটা নেংটি ইঁদুর ছুটে যায়। তবু তার ঘুম ভাঙে না। তার ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকে অপার্থিব এক হাসি।
গায়ক ঠাকুরের নিজের বাড়ি কাটোয়া। পাঁচ ঘণ্টার পথ। আজকের রাতটুকু সে তাই শ্রীখোল বাদকের ঘরেই কাটাবে। চালতার টকডাল আর আলুপোস্ত মাখিয়ে ভাত দিয়েছেন বৌঠান, শ্রীখোল বাদকের স্ত্রী। তৃপ্তি-সহ খেয়ে, কুয়োতলায় হাত-মুখ ধুতে এসেছে সে।
শ্রীখোল বাদক পিছন থেকে হাঁক দেয় তাকে, ‘দাদা, আজ বারোশো টাকা ভিক্ষা পেয়েছি। কাটোয়া ফেরার সময়, এখানকার মনোহরা কিনে দেব আপনাকে। সকলের জন্য নিয়ে ফিরবেন।’
পূর্ণচন্দ্রের দিকে আচমকা মুখ তুলেই গায়কের বুকটা হু-হু করে উঠল। কাটোয়ায় ফিরে যাবেই বা কার কাছে! অগ্রহায়ণের তেইশে যে তার রাইকিশোরীর বিয়ে। মেয়েটার মুখ ঠিক এই জ্যোৎস্না গলানো রাতের মতো স্নিগ্ধ।
মা’ঠানের ঘুম আসে না সারারাত। পালঙ্কের উপর শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেন। জানলা বেয়ে এক ফালি জ্যোৎস্না এসে তাঁর মেঝেতে লুটোপুটি খায়। গায়ের উপর থেকে এক ঝটকায় চাদর সরিয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়ান। টেবিলের উপরে গায়কের মালাখনি রাখা। মলিন, ছিন্নবিচ্ছিন্ন। সেটিকেই মুখের কাছে তুলে ধরে বুকফাটা কান্নায় তিনি ভেঙে পড়েন। বুকফাটা কান্না যদি নিঃশব্দ হয়, তা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক। মা’ঠান জানেন, তাঁর কোনও ভিক্ষার ঝুলি নেই। তাই তাঁর সঞ্চয়ের মাধুকরীও এই দিবসান্তে শূন্য রয়ে গেছে।
অঙ্কন : শংকর বসাক

আরও পড়ুন: তেইশ থেকে চব্বিশ

Latest article