মানিক বনাম ম্যাক্সিম, পার্টিকর্মী বনাম সাহিত্যসেবী

আজ কালজয়ী কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১১৫তম জন্মবার্ষিকী। বঙ্গসাহিত্যের এই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব প্রায়ই উপমিত হন রুশ সাহিত্যিক গোর্কির সঙ্গে। দু’জনের তুলনামূলক বিশ্লেষণে অধ্যাপক স্বর্ণালী দত্ত

Must read

প্রেসিডেন্সির ল্যাবরেটরি থেকে সাহিত্যের কারখানা-ঘরে কলম-মজুর হিসেবে যিনি নিজের ভবিষ্যৎ লিখিয়েছিলেন তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (Manik Banerjee)। বংশগতভাবে তিনি ছিলেন উচ্চবংশের। অভাবের দিন দেখতে হয়নি কখনও। এহেন সুখকর জীবন থাকা সত্ত্বেও মানিকের মন টেনেছিল সমাজের না-খেতে পাওয়া অভাবী নিপীড়িত মানুষগুলো। তাদের কথা ভাবতে গিয়ে তিনি জীবনের এমন স্তরের অংশ হলেন যেখানে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের বাহার রইল না, কিন্তু সুখ হল প্রচুর— আত্মসুখ। বাড়ির লোকের আশা অনুযায়ী তিনি পারেননি বড় বৈজ্ঞানিক হতে বা উচ্চপদে চাকরি করতে। তিনি যে শুধু নিজের উন্নতির কথা ভাবতে চাননি— তাঁর উন্নত জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা একা তাঁর জন্য নয়, সবার জন্য। ফলে মাটির কাছে পৌঁছে গেছিলেন তিনি। সর্বহারাদের জন্য মনের ব্যথাই তাঁকে লড়াইয়ের পথে নিয়ে গেছিল। সেই লড়াই তিনি লড়েছিলেন কলমের জোরে।

সমাজের জন্য এই লড়াইয়ের পথে মানিক আস্থা রেখেছিলেন মার্কসবাদের ওপর। সর্বহারাদের জন্য আন্দোলনে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। আজীবন কাজ করেছিলেন মানুষের অধিকারের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা একজন সাহিত্যিককে পূর্ণতা এনে দেয়। সাহিত্যে মহৎ সৃষ্টির সঙ্গে মহৎ কর্মের প্রয়োজন। সেই কর্মকেই জীবনদর্শন করেছিলেন মানিক। এই একই জীবনদর্শন নিয়েছিলেন সার্ত্রে, নেরুদা এমনকী ম্যাক্সিম গোর্কিও। ফলে ১৯৪৬ সাল থেকে তিনি নেমে পড়লেন এক মহাযজ্ঞে।

সর্বহারাদের জন্য মানিকের লড়াই ম্যাক্সিম গোর্কির আদর্শের লড়াই। তাঁর ‘মা’ উপন্যাসের প্যাভেলের মতোই মানিক জীবনের প্রতি গম্ভীর হয়ে পড়ে, শুনতে পায় বিপ্লবের ডাক। প্যাভেল বুঝেছিল, শুধু একপেট খেতে পাওয়াটাই আমাদের সব নয়। আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছে যারা, যারা আমাদের চোখে ঠুলি এঁটে রেখেছে, তাদের দেখাতে হবে আমরা সব দেখতে পাচ্ছি। তাই প্যাভেলের জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে পার্টি আর বিপ্লব। এই বিপ্লবের হাত ধরেই এগিয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (Manik Banerjee)। সে-কারণেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন ফ্যাসি-বিরোধী লেখক শিল্পী সংঘে। তিনি ছিলেন মার্কস-এঙ্গেলসের বস্তুবাদী প্রগতিশীল দর্শনের ধারক। তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল— ‘আমি মানুষ হিসেবে সর্বদাই সর্বহারা শ্রেণির পাশে। আরও একজন খেটে খাওয়া মানুষের মতন আমি লেখার মজুর।’ মানিক মনে করতেন, ‘দেশের অধিক মানুষের যখন নিজের ঘর নেই, আহার নেই, অর্থ নেই, তখন আমি লিখে বাড়ি-গাড়ির স্বপ্ন দেখি কী করে!’ নিজের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকাকে উনি সমাজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করতেন। তবে মানিক বস্তুবাদী, বাস্তববাদী, জীবনবাদী লেখক। তিনি চূড়ান্ত অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে দারিদ্র্য, শোষণ, নিগ্রহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেননি। প্রাচ্যের ভাববাদের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন রোমান্টিক লেখক।

আরও পড়ুন- ওগো বধূ সুন্দরী

গোর্কির সঙ্গে মতাদর্শের একদিকে মিল থাকলেও জীবন ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। গোর্কি প্রথম জীবনে ছিলেন একা, বঞ্চিত। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের পুনঃবিবাহে তিনি হয়ে গেছিলেন সর্বহারা। নানা জায়গা ঘুরে, নানারকম পেশায় কাজ করে তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রচুর। ছোট থেকেই স্বশিক্ষিত হয়ে মধ্য বয়সে এসে তিনি যখন সাহিত্য জগতে পা রাখলেন তখন এল একের পর এক খ্যাতি, যশ। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি গড়ে তুললেন এক নতুন বিপ্লবের যুগ। নিযুক্ত হলেন বিশেষ বিশেষ ক্ষমতায়। সৃষ্টি করলেন পার্টির মতাদর্শ অনুযায়ী সাহিত্য। মানিকের (Manik Banerjee) ক্ষেত্রে ঘটেছিল উল্টোটা। তিনি পার্টিতে এসে হয়েছিলেন সর্বহারা। বিজ্ঞানের পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়ায় দাদা বন্ধ করে দিয়েছিলেন মাসের হাতখরচ। ধীরে ধীরে অভাবের জীবনে প্রবেশ করেন মানিক। বৃদ্ধ পিতার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। শত দারিদ্রের মধ্যেও তিনি কলম ত্যাগ করেননি। তবে তিনি পার্টির মতাদর্শ অনুযায়ী লিখতে বসেননি। তিনি মানুষের দুঃখ-দারিদ্রের কথা যেমন বলেছেন তেমনই বলেছেন মানুষের মনের বিকলনের কথা, যে বিকলন সমাজকে আরও অবক্ষয়ের সম্মুখীন করে তোলে। পার্টিতে আসার অনেক আগে থেকেই মানিক ঘর বেঁধেছিলেন সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষদের সঙ্গে, যাঁরা তাঁর ছোটগল্প উপন্যাসে চরিত্র হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। কুবেরের কথা লিখতে গিয়ে তিনি দিনের পর দিন থেকে গেছিলেন মাঝিদের সঙ্গে। মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখে, জেনে তারপর তাঁদের কথা লিখতে বসেছিলেন তিনি। সর্বোপরি তিনি আগে মানুষের কথা ভেবেছেন, লিখেছেন তারপর যুক্ত হয়েছেন পার্টিতে। কিন্তু দলের কারণে তাঁর ব্যক্তি চিন্তা ও মননের পরিবর্তন হয়নি তাঁর সাহিত্যে। গোর্কির চেয়ে মানিক লেখকের শিল্পীসত্তার বিষয়ে অধিক মনোযোগী ছিলেন। দিনের শেষে গোর্কির বেশ কিছু লেখাকে পার্টি-সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করা হলেও মানিকের ক্ষেত্রে সেটা বলার সুযোগ মেলা সম্ভব না। এই কারণে, তিনি সহজেই বলতে পেরেছিলেন, ‘পার্টির কাছে সস্তা হাততালি পাবার উৎসাহে লেখায় যদি আন্তরিক সৃজনশীলতাকে বিসর্জন দিয়ে পার্টির তাৎক্ষণিক লাইন অনুযায়ী, ফরমায়েশি গল্প লিখতে বসেন, তাহলে পার্টির দোষ নয়, দোষ লেখকের।’ ফলে শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বহারাদের লেখক হয়ে উঠলেও তাঁর মধ্যে ছিল স্বপ্নের আকাশ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মধ্যে দ্রোহ নয়, কোথাও যেন স্বপ্ন জাগাতে চেয়েছিলেন, সুন্দর ও সাম্যময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

Latest article