সৌরমণ্ডলে প্রোবা-৩

আদিত্য এল-১-এর পর এবার ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সির যুগান্তকারী প্রোবা-৩, ইসরোর হাত ধরে অন্তরিক্ষে পাড়ি দিতে চলেছে সম্ভাব্য এ-বছর সেপ্টেম্বরেই; তাই নিয়েই লিখছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

প্রসঙ্গ
পৃথিবীতে সকল প্রাণ ও শক্তির মূল উৎস সূর্য; তাই মনে করা হয় সূর্যের কিরণ হচ্ছে এই পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে দামি সোনা। রবিঠাকুরের ভাষায়, মহিয়সী মহিমার আগ্নেয় কুসুম সূর্য! সেই অপার মহিমার রহস্য উন্মোচনে নতুন তথ্যের সন্ধানে সূর্যের বর্ণমণ্ডল ও করোনামণ্ডলকে ভালভাবে পড়তে গতবছর মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল আদিত্য এল-১। গত ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দিনটিতে ভারতবর্ষের ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের সৌজন্যে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে সূর্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল আদিত্য এল-১। সেই মহৎ উদ্দেশ্যকে আরও সফল করে তুলতে এ-বছর সম্ভাব্য সেপ্টেম্বরেই মহাশূন্যে পাড়ি দিতে চলেছে আলোড়নসৃষ্টিকারী প্রোবা-৩ (PROBA 3)!

প্রোবা-৩-এর (PROBA 3) সূচনা
পৃথিবী থেকে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সূর্যের ‘ক্রোমোস্ফেরিক অ্যান্ড করোনাল ডিনামিক্স অব দ্য সান’-এর তত্ত্বটিকে পর্যবেক্ষণ করতে ভারতবর্ষের পাঠানো আদিত্য এল১ সৌরযানটি গত ৬ জানুয়ারি, ২০২৪ ‘এল১’ ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে পৌঁছেছে। এল১ হল সূর্য এবং পৃথিবীর মধ্যে নিরুপিত মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের পাঁচটি বিশেষ অবস্থানের একটি, যেখানে কোনও মহাকাশযান ন্যূনতম জ্বালানি খরচ করে নিজের কাজ চালাতে সক্ষম হয়; জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এদের ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট বলা হয়। সূর্যের গঠনে ফোটোস্ফিয়ার বা আলোকমণ্ডলের পর ক্রোমোস্ফিয়ার বা বর্ণমণ্ডল এবং তারপর একেবারে বহির্ভাগে করোনা বা ছটামণ্ডল অবস্থিত। আদিত্য এল১ সূর্যের বর্ণমণ্ডল এবং ছটামণ্ডল স্থিত তাপ, তাপের তারতম্য, আয়নিত প্লাজমার পদার্থবিদ্যা, করোনার বৈচিত্র্য এবং সৌরবায়ুমণ্ডলের স্বরূপ উন্মোচনের উদ্দেশ্যে প্রেরিত। এই অভিযানের সময়কাল প্রায় পাঁচ বছর। ঠিক একই ভাবে আরও গভীর এবং নির্দিষ্ট ভাবে সূর্যের করোনা বা ছটামণ্ডলের রহস্য খুঁজে বের করতে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি পাঠাতে চলেছে প্রোবা-৩।

প্রোবা-৩-এর (PROBA 3) বিবরণ
সম্ভাব্য এ-বছর সেপ্টেম্বরেই মহাকাশে পাড়ি দিতে চলেছে যুগান্তকারী প্রোবা-৩; ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির একটি অগ্রগামী প্রাযুক্তিক প্রতিপাদন সৌর অভিযান। বিশ্বের মধ্যে এটিই সর্বপ্রথম ওই মহাশূন্যে একটি নির্দিষ্ট টেকনোলজিক্যাল গঠনের মাধ্যমে সূর্যের করোনা বা ছটামণ্ডলকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার প্রচেষ্টা। এই অভিযানের বিশেষ লক্ষ্য হল মহাকাশে অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠভাবে একটি উপগ্রহীয় গঠন ভাসমান অবস্থায় থাকার প্রযুক্তি এবং কৌশল প্রতিপাদন করা। এই অভিযানের নকশাচিত্র তৈরি এবং তার রূপায়ণের দায়িত্ব ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির; তবে নির্দিষ্ট সৌরযানটিকে মহাকাশে নিয়ে যাবে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল-এক্স এল (পিএসএলভি-এক্সএল রকেট)। পুরোদস্তর কাজ চলছে নিউ স্পেস ইন্ডিয়া লিমিটেডের ওয়ার্কশপে।
এই নির্দিষ্ট অভিযানে সৌরযানটি বয়ে নিয়ে যাবে দুটি উপগ্রহ এবং সৌরমণ্ডলের ৬০০×৬০৫৩০ কিলোমিটারের উচ্চ উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ‘একটির পশ্চাদে অন্যটি’ এইভাবে উপগ্রহ দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে অবস্থান করবে। উপগ্রহ দুটির একটি ‘দ্য করোনাগ্রাফ স্পেসক্রাফ্ট’ এবং অন্যটি ‘দ্য অক্যুল্টার স্পেসক্রাফ্ট’; এই উপগ্রহ দুটি মিলে ‘মিলিমিটার প্রিসিশন ফরমেশন’ দক্ষতার সঙ্গে একটি যন্ত্র তৈরি হবে যেখানে প্রদক্ষিণরত অবস্থায় দ্য অক্যুল্টার স্পেসক্রাফ্ট করোনাটিকে পর্যবেক্ষণ করবে এবং দ্য করোনাগ্রাফ স্পেসক্রাফ্ট সূর্যপৃষ্ঠকে আড়াল করবে এবং এইভাবেই উপগ্রহ দুটি মিলে আনুমানিক ১৪৪ মিটার দীর্ঘ একটি সৌর করোনাগ্রাফ তৈরি করবে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ‘সোলার অরবিটার’ এবং নাসার ‘সোলার ডিনামিক্স অবজারভেটরি’ ওই করোনাগ্রাফের সঙ্গে যুক্ত; এভাবেই বিজ্ঞানীরা ছটামণ্ডল নিয়ে নিবিড় গবেষণা করবেন বলে অনুমান।

আরও পড়ুন: ২৭ পয়েন্টে লিগ শেষ করতে চাই বলছেন কুয়াদ্রাত

প্রোবা-৩-এর বিশেষত্ব
ভারতবর্ষের আদিত্য এল১ অভিযানের সময় বিজ্ঞানীরা একটি ‘ভিজিবল লাইন এমিশন করোনাগ্রাফ’ ব্যবহার করেছিলেন, যেটা বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে তৈরি হয়েছিল। এখন প্রোবা-৩ বা প্রোজেক্ট ফর অন বোর্ড অটোনমি-৩ মিশনটিতে জ্যোতির্বিদরা ‘অ্যাসোশিয়েশন অব স্পেশক্রাফ্ট ফর পোলারিমেট্রিক অ্যান্ড ইমেজিং ইনভেস্টিগেশন অব দ্য করোনা অব দ্য সান’ নামে বেশকিছু ফিল্টার হুইলস এবং একটি ‘প্যারালাল লিক্যুইড ক্রিস্টাল ইমেজিং টেকনোলজি’র প্রয়োগ করেছেন উত্তর আমেরিকায় সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য। এ-ছাড়াও প্রোবা-৩-এর সঙ্গে ‘দ্য ডিজিটাল অ্যাবসোলিউট রেডিওমিটার’ বা ‘ডারা’ বলে একটি যন্ত্র সংযুক্ত করা হয়েছে, যা কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক কতটা পরিমাণ শক্তি সূর্য নির্গমন করে তা দেখার জন্য।

সৌর করোনার বিস্ময়
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত কেলাসাকার তুষার এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা দ্বারা সূর্যালোকের বিচ্ছুরণের ফলে সৃষ্ট হয় করোনা। এর আকার সৌরমণ্ডলে উপস্থিত চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। করোনা বা বর্ণমণ্ডল হল সূর্যের সবচেয়ে বাইরের অংশ, অত্যন্ত পাতলা এবং ঝাপসা। সূর্যের এই অংশের ঘনত্ব আশ্চর্যরকমভাবে কম, সূর্যপৃষ্ঠের চেয়ে প্রায় দশ মিলিয়ন গুণ কম। এই অংশে দেখা যায় উষ্ণ আয়নিত গ্যাস বা প্লাজমা; তাপমাত্রা প্রায় ২ মিলিয়ন কেলভিন, যা সূর্যের ফোটোস্ফিয়ার বা আলোকমণ্ডলের চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি। মজার বিষয় এই ছটামণ্ডলেই তাপমাত্রার মূল ধর্ম বিরুদ্ধাচরণ করে; স্বাভাবিকভাবে তাপের উৎসস্থল থেকে যত দূরে যাওয়া হয়, তাপমাত্রা ততই কম হয় কিন্তু এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উল্টো। সৌর বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘দ্য করোনাল হিটিং প্রবলেম’। এই অঞ্চলেই দেখা যায় ‘সোলার উইন্ড’ নামে ঝোড়ো বাতাস, যার বেগ প্রতি ঘণ্টায় দশ লক্ষ কিলোমিটার। এইসব বিভিন্ন কারণে দশকের পর দশক বিজ্ঞানীদের কাছে ‘করোনা’ হয়ে উঠেছে রহস্যময়!

আশার আলো
সৌরমণ্ডলের ক্রিয়াকলাপ, মহাজাগতিক বায়ুমণ্ডল এবং জলবায়ু প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য, পৃথিবীর সঙ্গে সূর্যের সম্পর্ক, এবং সূর্যের অভ্যন্তরীণ ঘটনার বিস্তৃত বৈজ্ঞানিক রসদ খুঁজে পেতে এই মিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তাই জরুরি হয়ে উঠেছে সূর্যের ‘করোনা’র বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রোবা-৩ অন্তরিক্ষে ভাসমান ল্যাবরেটরির মতো, যা আগামী দিনে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজি, গাইডেন্স, নেভিগেশন, অ্যালগোরিদম কন্ট্রোল এবং বহুসংখ্যক অভিনব প্রযুক্তির প্রয়োগে অনবদ্য ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই অভিযান আগামী দিনের অনেক দীর্ঘমাপের মহাকাশ যাত্রার পথ সহজ করে তুলবে, যেমন ‘মারস স্যাম্পল রিটার্ন’ এবং ‘স্যাটেলাইট ডি-অর্বিটিং’ মিশন প্রভৃতি। এ-বছর ভারতবর্ষের ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ইসরোর মোট ষোলোটি মহাকাশ অভিযানের একটি প্রোবা-৩। গোটা বিশ্বে জুড়ে বৈজ্ঞানিক মহলে এই সৌর অভিযান নিয়ে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে ইতিমধ্যেই। আসলে একটি উজ্জ্বল সূর্য শুধু আলো বিকিরণই করে না; সঙ্গে জীবন, আশা এবং একটি সুন্দর সভ্যতার সূচনাও করে মানবতার জন্য।

Latest article