এভাবেও ফিরে আসা যায়…

‘পাঠান’! এ শুধু আর এক বলিউড ছবির নাম নয়। ‘পাঠান’ এখন এক প্রতীক! হৃতসম্মান, হারানো রাজপাট ফেরানোর প্রতীক। হাল না ছাড়া না-ছোড় মনোভাবের প্রতীক। বয়স যে সত্যিই সংখ্যা মাত্র তা প্রমাণের প্রতীক। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ে থাকার প্রতীক। ঘৃণা ও দ্বেষের বিরুদ্ধে ভালবাসা’র জয়ের প্রতীক। এবং এক শিল্পীর বিশ্বাস না-হারানোর প্রতীক। ‘পাঠান’ নিয়ে তাই দু-চার কথায় প্রীতিকণা পালরায়

Must read

দূরদর্শনের এক শো থেকে শো-বিজ দুনিয়ার বিশ্ব-মঞ্চ। ১৯৮৮ থেকে ২০২২। ‘ফৌজি’ থেকে ‘পাঠান’ (Pathaan)। শাহরুখ ‘বাদশা’ খানের কেরিয়ার গ্রাফের ওয়ান লাইনার এটাই। নিশ্চিতভাবে ‘ফৌজি’র ক্যাপ্টেন অভিমন্যু ভাবতেও পারেননি এই কাণ্ডটা তিনি কোনওদিন ঘটিয়ে ফেলবেন। হয়ে উঠবেন ‘পাঠান’। হয়ে উঠবেন ‘আইকন’। শুধুমাত্র ভক্তকুলের ভালবাসার নয়, ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা স্বতন্ত্র সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সহযোদ্ধাদের কাছেও। হ্যাঁ, সাতান্ন’র শাহরুখকে কুর্নিশ জানিয়েছেন তাঁর সমবয়সি তারকারাও। সব যে শেষ হয়েও হয় না, অন্ধকারের শেষে যে আলোর অব্যর্থ উপস্থিতি থাকেই, শুধু অন্ধকার অতিক্রম করে সেই উৎসমুখ অবধি পৌঁছে যাওয়ার ধৈর্যটুকু রাখতে হয় তা তিনি, শাহরুখ খান, প্রমাণ করে দিয়েছেন বলেই। ছবি রিলিজের চারদিনের মাথায় সাংবাদিক সম্মেলন করে বাদশা নিজেও জানিয়েছেন, চার বছরের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে চারদিনের ভালবাসা!

যন্ত্রণা বলে যন্ত্রণা! পরপর ছবি ফ্লপ। আসন টলমল। ব্যক্তিজীবনে টালমাটাল। যা-ই বলেন, যা-ই করেন তার হাজার মানে হয়ে যায়। বাইরে বেরোলে ব্যঙ্গ, ভেতরে থাকলে বিদ্রুপ! এমনকী পাকিস্তানের চর ও দেশদ্রোহীও বলতে ছাড়েনি ঘৃণার রূপকাররা। সেই সঙ্গে এক-দুই নয়, চার-চারটে বছরে যে নায়কের একখানা ছবিও রিলিজ থাকে না, তিনি ফুরিয়ে গেছেন এমনটা দেগে দেওয়ার মধ্যে ভুল দেখছিলেন না এমনকী তাঁর ফ্যানেরাও! আর বাকি দুনিয়া যখন ব্যস্ত এসব নিয়ে তিনি খুঁজে ফিরেছেন গল্প! শুনেছেন চিত্রনাট্য। ঘাম ঝরিয়েছেন জিমে। আর তৈরি হওয়া মাত্র নেমে পড়েছেন রণে। যুদ্ধটা বাকিদের সঙ্গে ছিল না তো! অনেক বেশি ছিল নিজের সঙ্গে! আইকনদের তেমনটাই হয় যে! সবচেয়ে আগে তিনিই জানতেন তিনি জিতবেনই! ‘পাঠান’ (Pathaan) তাই শুধু পর্দায় জেতেনি, জিতেছে পর্দার বাইরেও। আর যাঁরা বলছেন এটা বাদশার কামব্যাক, তাঁদেরও নস্যাৎ করে নিজের বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিয়েছেন আরও ব্যাপ্ত ভাবে। ট্যুইট করেছেন গত শুক্রবারই, “এগিয়ে তো যেতেই হবে। যে কারণে চলা শুরু, তা শেষ করার জন্য এগোনোই একমাত্র রাস্তা! সাতান্ন বছরের এক ব্যক্তির থেকে এটাই একমাত্র পরামর্শ রইল!”

আরও পড়ুন-বিশ্বজয়ী মেয়েদের বরণ ক্রীড়ামন্ত্রী, সিএবি’র, জাতীয় দলে চোখ তিতাসের

এমন নয়, ‘পাঠান’ (Pathaan) শাহরুখের সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি। তা সে গুণগত মানেই হোক কিংবা বিষয়গতভাবে। বক্স অফিসের কালেকশন কিংবা দেশজোড়া যে সুনামি তা ছবি হিসেবে ‘পাঠান’ কতটা দুর্দান্ত হয়েছে সে কারণে যে নয় বরং এক ও একমাত্র শাহরুখ-ক্রেজের জন্যই তা বলতে গভীর গবেষণা লাগে না। সিদ্ধার্থ আনন্দ পরিচালিত ছবিতে আরও আছেন দীপিকা পাডুকোন, জন অ্যাব্রাহাম, আশুতোষ রানা, ডিম্পল কাপাডিয়া। কিন্তু শুধুমাত্র ভারতেই প্রথম চারদিনে দুশো কোটির অঙ্ক পেরিয়ে যাওয়া বা বিশ্ববাজারে চারশো কোটির, তা যে শুধু মাত্র পর্দায় কিং-খানকে দেখার জন্যই, এ অ্যানালিস্ট বা ক্রিটিকরা বলবেন, তবে আমরা বুঝব, তাও নয়! আর এখানেই আসছে সেই ম্যাজিক, সেই ক্রেজের প্রসঙ্গ। দক্ষিণী-ক্রেজ-এ বলিউডের সিংহাসন টালমাটাল হচ্ছিল বিগত বছরগুলিতে। বাদশার বিরতির এই চার বছরে সিনেমা-ভাবনারও বদল ঘটেছে বিস্তর। ওটিটি-বিপ্লব আমূল বদলে দিয়েছে দর্শক-টেস্ট। এটা সেই সময় যখন নায়করা নন, কল্কে পাচ্ছেন অভিনেতারা। ছবি তৈরি হচ্ছে বিষয়-ভিত্তিক। থাকছে সমকালের ছোঁয়া। প্রেম থাকছে কিন্তু নব্বই দশকের ফর্মুলা-প্রেম নয়, সম্পর্কের টানাপোড়েন, মানবিক জটিলতা থাকছে প্রেমের প্রধান বিষয় হয়ে।

এসব যে কিং-খান জানতেন না তা নয়। কিন্তু তার চেয়েও তিনি জানতেন নিজেকে এবং তাঁর ভক্তকুলকে। আরও একটা ‘ডি ডি এল জে’ বানানোর রাস্তায় যেমন যাননি, তেমনই ‘জিরো’-র এক্সপেরিমেন্টের জুতোতেও পা গলাননি। শুধু ক্রেজ দিয়েও যে বাজার মাত হয় না, সেই তিক্ততাও বিলকুল প্রত্যক্ষ করেছিলেন। দিলওয়ালে (২০১৫), জব হ্যারি মেট সেজল (২০১৭), জিরো (২০১৮) প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাঁর ভক্তরাও। তাই ট্রেন্ডের মধ্যে থেকেই যেমন দেশরক্ষা আর দেশভক্তির কাহিনি বুনেছিলেন তেমনই সময়ের দাবিতে এই সাতান্নতে নিজেকে ভেঙে-চুরে গড়ে তুলেছিলেন ‘সিক্স-প্যাক অ্যাবস’। এই সমর্পণে ঈশ্বরও প্রভাবিত হতে বাধ্য যে! ছবি নিয়ে তাই যাই মতামত থাক একশোয় একশো জন স্বীকার করেছেন, শাহরুখের ‘পাঠান-লুক’ পুরনো সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। হ্যাঁ, দীপিকাও ফিকে পড়েছেন তাঁর পাশে।

বিতর্ক তো শুধু গেরুয়া-বিকিনির জন্য হয়নি! পরের দিকে এসেছে দাদাগিরির প্রসঙ্গও। বয়কটের ডাক অবধি না পৌঁছলেও আঞ্চলিক ছবিগুলির পাঠান-ঝড়ে কোণঠাসা হওয়া নিয়েও বিতর্কের প্যানেল বসেছে! সিংগল স্ক্রিনগুলোর জন্য যশ রাজ ফিল্মস-এর শর্তই ছিল ‘পাঠান’ চললে অন্য কোনও ছবি চালানো যাবে না! এ জন্য রমরমিয়ে চলা কিছু বাংলাছবির ব্যবসা এ রাজ্যেও থমকে গেছে। নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা। কিন্তু বাদশা সে বিতর্কে না ঢুকেও শুধু পোস্ট করেছেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বন্ধ হয়ে যাওয়া ২৫টি সিংগল স্ক্রিন ফের খুলেছে ‘পাঠান’ (Pathaan) দেখাবে বলে! এটাও কম পাওনা নয়!’ মুদ্রার দুটি পিঠ তো থাকবেই! আর এভাবেই ফিরে ফিরে এসে থাকবেন শাহরুখ ‘পাঠান’ খান।

Latest article