একদা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেছিলেন, ‘Democracy is not a way of governing, whether by majority or otherwise, but primarily a way of determining, who shall govern and broadly to what ends.’ এক্ষেত্রে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসনের মূল লক্ষ্য সাংবিধানিকতা প্রতিষ্ঠা; আর তা সম্ভব মানুষের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অধিকার প্রদানের মাধ্যমে। কিন্তু আজকের ভারতে আইন অনুযায়ী সাংবিধানিক শাসনের বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘মহামানব’ চর্চা ও কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। যার অন্যতম উদাহরণ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর শাসকের নিয়ন্ত্রণ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচের ব্যবস্থার বদলে কেন্দ্রীকৃত শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এক্ষেত্রে রাজ্যপাল প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকরণ প্রণিধানযোগ্য।
আরও পড়ুন-শীতে বাড়ে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি
সুপ্রিম কোর্ট ২০২৩ সালের মার্চ মাসে উদ্ধব ঠাকরে সরকারের (মহারাষ্ট্র) আস্থা ভোট সংক্রান্ত মামলার রায় প্রসঙ্গে বলে, সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য রাজ্যপালগণ রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠছেন। এ কথা পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, ঝাড়খণ্ড, কংগ্রেস আমলের ছত্তিশগড়, এমনকী দিল্লি বা পণ্ডিচেরির মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা হল অবিজেপি তথা বিজেপি-বিরোধী সরকার।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাজে প্রতিনিয়ত বাধা দান, প্রয়োজনের বাইরে সাংবিধানিক নিয়ম রীতি-নীতি বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন বিষয়ে অযৌক্তিক মন্তব্য, দিনের পর দিন আবশ্যিক বিল সই না করে আটকে রাখা (যা সংবিধানের ২০০ নম্বর ধারার বিরোধী), শিক্ষা ব্যবস্থায় অনৈতিক হস্তক্ষেপ (যেমন রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ) প্রভৃতি উপায়ে রাজ্যপাল বিজেপি-বিরোধী রাজ্যসরকারগুলিকে জনকল্যাণমূলক শাসন চালাতে বাধা দিচ্ছেন। যার প্রমাণ নানান সময়ে উচ্চ আদালতের রায় বা পর্যবেক্ষণে পরিলক্ষিত হয়। রাজ্যপাল মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের কাঠপুতুল হিসেবে বিজেপি দলের রাজনৈতিক সুবিধা করার জন্যই কাজ করে চলেছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অতি-সক্রিয় আবার কোথাও নিষ্ক্রিয় থেকে রাজ্যপাল এ-কাজ করে চলেছেন।
আরও পড়ুন-আজ সবং কেন্দ্রের ভার্চুয়াল উদ্বোধন মুখ্যমন্ত্রীর, হবে ডেবরাতেও
উল্লেখ্য, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচের শাসনব্যবস্থায় যে ক্যাবিনেটভিত্তিক সরকার কাজ করে সেখানে রাজ্যপাল তাঁর ব্যক্তিচিন্তার বদলে সাংবিধানিক ভূমিকা ও নিয়ম পালন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিজেপি-বিরোধী রাজ্যগুলিতে প্রতিনিয়ত রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদের ঊর্ধ্বে উঠে ব্রিটিশ কালের গভর্নর জেনারেলের মতো আচরণ করছেন। ঠিক যেমনটি ১৯৮৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে এন টি রামারাও সরকারের সরকারকে ফেলে দেওয়া বা ২০১১ সালে কর্নাটকে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির মাধ্যমে ঘটেছিল।
সাংবিধানিকতা রক্ষার অন্যতম প্রতিষ্ঠান স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপের প্রয়াস মোদি জামানার অবদমনের আর এক ধরন। জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর উপর এহেন অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু কলেজিয়াম ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবির মাধ্যমে বিচার বিভাগকে সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল হচ্ছে। যখন কোনও প্রধান বিচারপতি তাঁর কাজের সময়সীমার ঠিক পরেই কেরলের রাজ্যপাল হন বা রাজ্যসভার সদস্য হন, তখন শাসন বিভাগ বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণের পথকে আরও প্রশস্ত করে; যা গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তথা এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির বিরোধী এবং অবশ্যই কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার ভিত্তি প্রস্তুত করে। আবার যখন প্রধান বিচারপতি লোধা বিচারপতি হিসেবে গোপাল সুব্রামনিয়ামের নাম প্রস্তাব করেন তখন মোদি সরকার তার বিরোধিতা করে ও সুব্রামনিয়াম বিচারক পদপ্রার্থী হিসেবে নিজের নাম প্রত্যাহারে বাধ্য হন।
আরও পড়ুন-নিহতদের পরিবারের পাশে তৃণমূল নেতৃত্ব
আমরা দেখেছি কীভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছেন। যা ভারতের ইতিহাসে বিরল। তাতেও মোদির নিয়ন্ত্রণমূলক মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। কখনও প্রয়াত অরুণ জেটলি কখনও কিরেন রিটজু আইনের অছিলায় বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের পথ প্রশস্ত করেছেন। মোদি-শাসনের শুরুতেই তার উদাহরণ রয়েছে। ৯৯তম সংবিধান সংশোধন করে ‘ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে মোদি সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে বিচারবিভাগকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে ৪ : ১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ উক্ত আইনকে বাতিল করে কলেজিয়াম ব্যবস্থা বজায় রাখে। কিন্তু তারপরেও কিরেন রিটজু ২০২২-’২৩ সালে টানা কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করে বিচারকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। বস্তুত মোদি জমানায় বিচার বিভাগীয় স্বতন্ত্রতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
আরও পড়ুন-বঞ্চনা নিয়ে বিধানসভায় সরব হলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু
ঠিক একইভাবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনাকে যা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, হস্তক্ষেপ করতে ‘নির্বাচন কমিশনার আইন’ বদল করতে প্রয়াসী মোদি। ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত বিল রাজ্যসভায় পাশ হয়। যেখানে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে প্রধান বিচারপতির বদলে রাজনৈতিক প্রতিনিধি রাখা হয়। কিন্তু পূর্বেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে যে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা ও প্রধান বিচারপতির টিম কাজ করবে। কিন্তু মোদি সরকারের উক্ত বিল পাশের উদ্যোগ নির্বাচন কমিশনের উপর হস্তক্ষেপ ও তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার উদ্যোগ।
একইভাবে মানবাধিকার কমিশন, শিশু কমিশন, মহিলা কমিশন কিংবা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী (তথাকথিত স্বতন্ত্র) সংস্থাগুলির উপর মোদি সরকার ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছে। যার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বিরোধী রাজ্যগুলিতে ও বিরোধী নেতাদের আক্রমণ ও বদনাম করা। এ-সবই গণতন্ত্রের বিরোধী। যেখানে খণ্ডিত জনসম্মতিকে ব্যবহার করে এক অতিমানবের মিথ্যাচেতনা জনসমাজে ছড়িয়ে, কেন্দ্রীয় সংস্থার অপব্যবহার করে অবদমন চালানো হয়। যা শুধুই মোদির সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। কিন্তু মোদি নিশ্চয়ই ভোলেননি, স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলা যেমন পথ দেখিয়েছিল, তেমনই তার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বাংলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পথ দেখাবে।