ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র নাকি সোনার পাথরবাটি

ভারতীয় সংবিধানের প্রথম ধারাটিতেই বলা হয়েছে— ‘ইন্ডিয়া অর্থাৎ ভারত হবে যুক্তরাষ্ট্র’। ইংরেজিতে বলা হয়েছে ‘ইউনিয়ন অফ স্টেটস’।

Must read

সুখেন্দুশেখর রায়: ভারতীয় সংবিধানের প্রথম ধারাটিতেই বলা হয়েছে— ‘ইন্ডিয়া অর্থাৎ ভারত হবে যুক্তরাষ্ট্র’। ইংরেজিতে বলা হয়েছে ‘ইউনিয়ন অফ স্টেটস’। ইউনিটারি বা এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র নয়। সুতরাং, ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু সংবিধানের কোথাও নির্দষ্টভাবে ‘ফেডারেশন’ বা ‘ফেডারেল’ শব্দ ব্যবহার বা উল্লেখ করা হয়নি। সংবিধান প্রণেতারা সচেতনভাবেই ওই দুটো শব্দ এড়িয়ে গেছেন বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কারণ আর যাই হোক, ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কোনওমতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় নয়।

আরও পড়ুন-সংবিধান ও নারী ক্ষমতায়ন, কতটা পথ পেরোলে তবে…

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাই ভারতীয় গণরাজ্যকে ‘কেন্দ্রীভূত যুক্তরাষ্ট্র’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। কারণ, সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্যগুলির তুলনায় প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে ‘কো-অপারেটিভ ফেডারিলিজম্’-এর যে তত্ত্ব প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু শুনিয়েছিলেন (যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলে থাকেন), তা এখন এক হাস্যকর স্লোগানে পরিণত হয়েছে। যদি সংবিধানে গোড়াতেই বহু গলদ রয়ে গেছে ধরে নেওয়া যায় তাহলে তা কী ধরনের? যা আমাদের বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁডিয়েছে? আমার মতে, কমপক্ষে ন’টি বিষয় আছে যা কেন্দ্রীয় সরকারকে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী করেছে। ফলে রাজ্যগুলি প্রায় ঔপনিবেশিক ধাঁচেই শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছে যেমন—
১) কেন্দ্রীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিল পাশ করিয়ে যে কোনও রাজ্যের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে রাজ্য বিধানসভার কোনও মতামত গ্রাহ্য করা জরুরি নয়।
২) কেন্দ্র তালিকায় রাজ্য তালিকার তুলনায় অনেক বেশি বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
৩) যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত কোনও বিষয়ে যদি কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইনই প্রাধান্য পাবে, রাজ্যের আইন নয়।
৪) অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে দিলে রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়েও সংসদ কেন্দ্রীয় আইন তৈরি করতে পারে।
৫) রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির মালিকানা, বিতরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজ্যের চেয়ে লাগামছাড়া আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে কেন্দ্র।
৬) রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপাল নিয়োগের অবাধ ক্ষমতা এবং প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি শাসনের মাধ্যমে রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতা অধিগ্রহণ কেন্দ্রের হাতেই ন্যস্ত রয়েছে, যদিও কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতি শাসনের কোনও নিদান নেই।
৭) কেন্দ্র ও রাজ্যের পৃথক কোনও সংবিধান নেই।
৮) নাগরিক আইনের যাবতীয় ব্যবস্থা কেন্দ্রের হাতেই রয়েছে। নাগরিকত্ব প্রদান বা প্রত্যাহার করার কোনও ক্ষমতা রাজ্যের হাতে নেই।
৯) নির্বাচন কমিশন, সিএজি, ইউপিএসসি, মানবাধিকার কমিশন, উচ্চ ও উচ্চতম আদালত, মহিলা, সংখ্যালঘু-তফসিলি ও আদিবাসী কমিশন, লোকপাল প্রভৃতি সাংবিধানিক সংস্থার নিয়োগকর্তা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সুপারিশে রাষ্ট্রপতি।

আরও পড়ুন-শতবার্ষিকী স্মরণে শোভা সেন

এ ছাড়া প্রতিরক্ষা, অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বিদেশ নীতি, পরিকল্পনা— এক ডজনেরও বেশি কেন্দ্রীয় এজেন্সি ইত্যাদি সবই কেন্দ্রের অধীনে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল কেন্দ্র একতরফাভাবে সেস ও সারচার্জের পুরো অর্থ ব্যবহার করে রাজ্যগুলি তার কোনও ভাগ পায় না।
এই সাংবিধানিক ব্যবস্থায় বলিয়ান হয়ে বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল ও গোষ্ঠী রাজ্যগুলিকে এতদিন নিয়ন্ত্রিত করেছে। কিন্তু ২০১৪ সালের পরে বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলিকে হাতের মুঠোয় আনতে সমস্ত সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের পাশাপাশি বিধায়ক কেনাবেচা, বিরোধী নেতাদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পাঠানো, কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির যথেচ্ছ দুরূপযোগ, রাজ্যগুলিকে আইনত পাওনা টাকা না দেওয়া ইত্যাদি কুৎসিত রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে দখলদারি চলছে। গোয়া, মণিপুর, হরিয়ানা, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। তামিলনাড়ু ও ঝাড়খণ্ড ও তেলেঙ্গানাতেও বিধায়ক কেনাবেচার মাধ্যমে সরকার ফেলে দেওয়ার খেলা শুরু হয়েছে। বাংলার ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার জিগির তুলে ২০১৪, ২০১৬ ও ২০২১-এর হ্যাটট্রিক পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার উল্লাসে মেতে উঠেছে শাহেনশাহ ও শাহজাদারা।

আরও পড়ুন-সরকারি হাসপাতালে আরও নজরদারি, ভাঙা হবে দালালচক্র

যদি ভারতবর্ষ প্রকৃতঅর্থে ‘যুক্তরাষ্ট্র’ হত কিংবা নিদেনপক্ষে সারকারিয়া কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে এই অসাংবিধানিক গুন্ডামির রাস্তা প্রশস্ত হত না। ২০০৭ সালের ২৭ এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণের জন্য জাস্টিস মদনমোহন পুঞ্চির নেতৃত্বে সারকারিয়া কমিশনের অনুরূপ আরেকটি কমিশন গঠন করে। ২০১০ সালের ৩০ মার্চ, পুঞ্চি কমিশন সাতটি ভল্যুমে ২৭৩টি সুপারিশ সংবলিত রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করে। ১২ বছর অতিক্রান্ত। আজও সেই রিপোর্ট দিল্লির নর্থ ব্লকের কোন গোপন কুঠুরিতে পড়ে রয়েছে তা কেউ জানে না। বিজেপি সরকার হয়তো তার পাতা উল্টেও দেখেনি। কারণ, রিপোর্ট জনসমক্ষে এলে দেশ জুড়ে বিতর্ক হবে। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলি এই রিপোর্ট রূপায়ণের জোরালো দাবি তুলবে। তাই ওসব এখন থাক। বিরোধীমুক্ত ভারত ও কর্তৃত্ববাদী এককেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হোক। আর তো মাত্র কয়েকটা হাতেগোনা বিরোধী শাসিত রাজ্য আছে। এই মুষ্টিমেয় রাজ্যগুলিতে ভাঙা-গড়ার খেলা সম্পূর্ণ করতে পারলেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো যাব। তারপর আর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, কেন্দ্রীয় বঞ্চনার কথা তোলার মতো কোনও বিদ্রোহী রাজ্য থাকবে না।

আরও পড়ুন-বাম আমলের চেয়ে বেশি ডিএ দিয়েছে রাজ্য, ধীরে ধীরে সবটাই মিটিয়ে দেবে রাজ্য

দেশের পরিস্থিতি এখন এমন ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছেছে। কিন্তু আমাদের দেশে কেউ কি পুতিন বা শি জিংপিং-এর মতো সারাজীবনের জন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থাকতে পারবেন? মুখোশ তো ক্রমশ খুলে পড়ছে। আধা-ফ্যাসিস্টের কদর্য চেহারা বেরিয়ে পড়ছে। জনতা-জনার্দন সবই দেখছেন। সংবিধানের অপব্যবহার করে যারা জনতার সম্পত্তি ক্রনি-পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়ে লক্ষকোটি টাকা ফি বছর পার্টি ফান্ডে তুলে জনতার আশীর্বাদে তৈরি রাজ্য সরকারগুলিকে ভেঙে দিচ্ছে টাকার জোরে, এজেন্সির জোরে, সংবিধান রক্ষকদের নিস্পৃহতায় তাদেরকেও একসময় গদিচ্যুত হতে হবে। শেষের সেই দিনটি হবে আরও ভয়ঙ্কর।

Latest article