অসাধারণ হয়েও সাধারণ
তখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে। জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ঘটে গিয়েছে আপামর বাঙালির। মুখে-মুখে ঘোরে তাঁর নাম। কিন্তু তিনি, অসাধারণ হয়েও বড় বেশি সাধারণ। যাপন করেন ছাপোষা মধ্যবিত্ত জীবন। দীর্ঘ দেহ। হাই পাওয়ারের চশমা। লম্বা লাইনে অবলীলায় দাঁড়ান পোস্ট অফিস, ইলেকট্রিক অফিস, ব্যাঙ্কে। আর পাঁচজনের সঙ্গে। কেউ এগিয়ে যেতে বললে হাসি মুখে বলেন, ‘‘আপনারাও তো দাঁড়িয়ে আছেন। আমিও থাকি।’’ কোথাও নিতে চাইতেন না বাড়তি সুবিধা। অথচ তার অনেক আগেই পেরিয়ে গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। ততদিনে পেয়ে গিয়েছেন পদ্মশ্রী। এই নিরহংকারী মানুষটি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। কিংবদন্তি বেতার-ব্যক্তিত্ব।
আরও পড়ুন-নতুন মুখ অনেক, তাই ভোটকৌশল শেখাতে বৈঠক
সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন বাবা
নদিয়া জেলার সন্তান। জন্ম ১৯৩৪-এর ২৫ জুন। শান্তিপুরে। বেলপুকুরে ছিলেন কিছুদিন। ৭ বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসেন। ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। শান্তিপুর মিউনিসিপ্যাল স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। তারপর কলকাতায় ভর্তি হন সরস্বতী ইনস্টিটিউশনে। ১৯৪৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। কিন্তু সংসারে তখন চরম অর্থকষ্ট। বাধ্য হয়ে চুকিয়ে দেন পড়াশুনার পাঠ। কারণ অর্থ উপার্জন করতে হবে। খবর যায় বাবা নন্দদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানে। ভীষণ চটে যান। তখনই পুত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
আরও পড়ুন-জাতীয়তাবাদী বঙ্কিম বঙ্কিমী জাতীয়তাবাদ
মেসজীবন
ঘরছাড়া হন দেবদুলাল। ওঠেন হ্যারিসন রোডের একটি মেসে। থাকতে শুরু করেন কয়েকজনের সঙ্গে। সেখানে ছিলেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। রোজগারের জন্য দেবদুলাল করেছেন গৃহশিক্ষকতা, টাইপিস্ট, স্টোরকিপারের কাজ। এছাড়াও পেট চালাতে চায়ের দোকানেও কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। কোনও কাজকেই ছোট মনে করেননি।
আরও পড়ুন-আজ নামছে ডায়মন্ড হারবার, লিগের উদ্বোধনী ম্যাচে কিবুর দলের সামনে সাদার্ন
পাকেচক্রে বেতারে
কণ্ঠস্বর ছিল অসাধারণ। উচ্চারণ ছিল শুদ্ধ। নিয়মিত শুনতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান। নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করতেন। সময়-সুযোগ পেলে লিখতেন কবিতা। আবৃত্তিচর্চার শুরু অন্তরঙ্গ বন্ধু কাজী সব্যসাচীর উৎসাহে। সেই সময় আলাপ হয় সংগীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গে। তিনিই দেবদুলালকে বলেন আকাশবাণীর ‘অনুষ্ঠান ঘোষক’-এর পদে চাকরির পরীক্ষা দিতে। সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন দেবদুলাল। ১৯৬০ সালে যোগ দেন রেডিওয়। অল্প দিনেই ওঠেন আকাশবাণীর সংবাদ ও ভাষ্যপাঠক। তারপর একটানা তিন দশকের বেশি সময় বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে রেডিওয় কাজ করবেন, এমন ইচ্ছে তাঁর আগে কিন্তু ছিল না। একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘‘বেতারে কাজ করব, প্রথম থেকে এই ইচ্ছে ছিল না। পাকেচক্রে হয়ে গেছিলাম।’’
আরও পড়ুন-ফের ট্রেন দূর্ঘটনা, এবার ঘটনাস্থল বাঁকুড়া
বঙ্গ জীবনের অঙ্গ
রেডিওয় বাংলা সংবাদের সময় ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়’ শোনামাত্রই নড়েচড়ে বসতেন শ্রোতারা। এই নাম এবং কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। ১৯৬৪ সাল। দিল্লিতে বাংলা বিভাগে সংবাদ পাঠক হিসেবে নির্বাচিত হন। তবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের শেষদিকে কলকাতা বেতার কেন্দ্রে ফিরে আসেন। সংবাদের পাশাপাশি পাঠ করতেন সংবাদ পরিক্রমা।
আরও পড়ুন-মোদি জমানায় রেলের অমানবিকতা বেআব্রু হল বালাসোরে
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রণবেশ সেন লিখতেন ‘সংবাদ-পরিক্রমা’। ভাবগম্ভীর কণ্ঠে সেইসব লেখা পাঠ করতেন দেবদুলাল। শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতেন দুই বাংলার মানুষ। এই পাঠ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ছিল প্রেরণার মতো। প্রাণে জাগাত উন্মাদনা। কলকাতায় আসতেন মুক্তিযোদ্ধারা। মন দিয়ে দেবদুলাল শুনতেন তাঁদের সংগ্রামের কথা। আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে আবেগ সংবরণ করতে পারতেন না তিনি। নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা মনে করতেন। বুকের ভেতরের সমস্ত লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিতেন আকাশবাণীর ‘সংবাদ’, ‘সংবাদ-পরিক্রমা’ বা ‘সংবাদ-সমীক্ষা’ পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তেন, তখন নিজেকে মনে করতেন সেই রণাঙ্গনের একজন সৈনিক। যখন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা পড়তেন, তখন মনের সমস্ত উল্লাস, উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ত কণ্ঠ জুড়ে। যখন করুণ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পড়তেন, তখন কণ্ঠ কান্নায় জড়িয়ে আসত। এইভাবেই দেবদুলাল তাঁর কণ্ঠস্বরে পৌঁছে যেতেন যুদ্ধরত মুক্তিসেনাদের কাছে। সেইসময় দুই বাংলায় তাঁর জনপ্রিয়তা পৌঁছেছিল তুঙ্গে। তবে তাঁর এই ধরনের পাঠ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে বিস্তার। কিন্তু তিনি কর্ণপাত করেননি। নতুন প্রজন্মের কাছে দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল তাঁর জনপ্রিয়তা। অনেকেই তাঁকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতেন। বলতেন, ‘‘বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় স্বদেশ’’। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসামান্য ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের এই কণ্ঠসৈনিককে আলিঙ্গন করেন এবং সংবর্ধনা জানান। একই বছরে পান ভারত সরকারের পদ্মশ্রী।
আরও পড়ুন-মোদি জমানায় রেলের অমানবিকতা বেআব্রু হল বালাসোরে
বাচিকশিল্পী ও শিক্ষক
নয়ের দশকে আকাশবাণী কলকাতার বেতার কেন্দ্র থেকে অবসর নিয়েছিলেন। অবসরের পর যৌথ এবং একক ভাবে সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন বিষয়ের বই। জড়িয়ে ছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার প্রতিষ্ঠিত শিল্পী সংসদের সঙ্গে। বাচিকশিল্পী এবং শিক্ষক হিসেবে ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ছিল ‘রসকলি’। ছাত্রছাত্রীরা বাচিক শিল্পের তালিম নিতে আসতেন তাঁর কাছে। ব্যস্ততার মাঝেও পালন করতেন সংসারের দায়িত্ব। স্ত্রী ছিলেন কত্থক নৃত্যশিল্পী রুবি বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের হাতখরচটুকু নিয়ে দেবদুলাল বাকি টাকা তুলে দিতেন স্ত্রীর হাতে। এটা ছিল তাঁর চিরকালের অভ্যেস। যখন বাড়িতে থাকতেন, কলিং বেল বাজলে নিজে দরজা খুলতেন। ফোন বাজলে নিজে ধরতেন। সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। আপাত-গম্ভীর। তবে ভিতরে ভিতরে ছিলেন অসম্ভব রসিক। সহকর্মী এবং সহশিল্পীদের সঙ্গে মেতে উঠতেন রঙ্গ-রসিকতায়। শোনা যায়, একবার নাকি স্টুডিওয় ভূত সেজে ভয় দেখিয়েছিলেন অনুজ সহকর্মীকে। ২০১১-র ২ জুন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় চলে যান না-ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুর পর কয়েকজন ছাত্রছাত্রী তৈরি করেন ‘দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি সংসদ’। নিয়মিত স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। তাঁর নামে দেওয়া হয় স্মারক পুরস্কার।
আরও পড়ুন-ধরিত্রী গর্ভবতী হলে…
কন্যার চোখে
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা দেবারতি বন্দ্যোপাধ্যায়। কথা হল তাঁর সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘‘বাবা ছিলেন খুব সাধারণ। আর পাঁচজন বাবার মতোই। উনি যে বিখ্যাত বা কিংবদন্তি, সেটা আমরা ছোটবেলায় একেবারেই বুঝিনি। পায়ে হেঁটে আমাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসতেন। বলতেন, ‘আমার নাম আছে। তবে টাকা নেই।’ বন্ধুর মতো ছিলেন। কোনওদিন আমাকে বা আমার দাদা দেবরাজকে বকাবকি করেননি। রাতে বাড়ি ফিরে নানা রকমের কথা বলতেন। অসাধারণ ছিল রসবোধ। মজা করতেন খুব। মিমিক্রি করতেন দারুণ। গল্প পাঠ করে শোনাতেন মাঝেমধ্যেই। গলার মাধ্যমে পাল্টে দিতেন চরিত্রগুলোক। সব সময় পরামর্শ দিতেন জোরে জোরে পড়ার। উচ্চারণ পরিষ্কার রাখার জন্য। কথা হত কণ্ঠস্বরের ব্যবহার নিয়েও। নানাভাবে করতেন গাইড। সবমিলিয়ে তিনি ছিলেন আমাদের শিক্ষকও। আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারেও নজর রাখতেন। বিশেষত দেখতেন বাংলা, ইংরেজি। লিখতে বলতেন।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে ফের বিজেপিতে ভাঙন, উন্নয়নের প্রচার গ্রাম থেকে গ্রামে, বাংলা জুড়ে তৃণমূল ঝড়
পরে সংশোধন করে দিতেন। কখনও ইঁদুর দৌড়ে নামতে বলেননি, প্রথম হওয়ার জন্য দেননি চাপ। শুধুমাত্র পড়াশোনাটা মন দিয়ে করতে বলতেন। তাঁর জন্য অনেক বড় মাপের মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছি। দেখেছি, তাঁদের একে অপরের প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা। কখনও কারও নামে নিন্দা করতেন না। বাবা বলতেন, ‘সবার মধ্যেই ভাল-মন্দ দুটো গুণই আছে। ভালটা নিতে হবে।’ বিভিন্ন ধরনের বই, পত্রিকা পড়তে বলতেন। কবিতার বই, গদ্যের বই। আমরা পড়তাম। বাবার সংবাদপাঠ শুনতাম। নিয়মিত। খুব ভাল লাগত। তিনি চলে যাওয়ার পর রেডিও মানসিকভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। প্রাত্যহিকী অনুষ্ঠানে পড়া হয়েছিল বাবাকে নিয়ে লেখা মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো বেশকিছু চিঠি। বাবা ছিলেন আমাদের ছাতার মতো। আজ মনে হয়, আরেকটু আগে জন্মালে খুব ভাল হত। তাহলে বাবাকে আরও বেশি সময় কাছে পেতাম।”