ধর্মস্থান নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে ইতিহাস ধ্বংসের ছক

ভারত জ্বালানো পার্টি এখন আগুন খুঁজছে। নিরন্তর চেষ্টা চলছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে নব ইতিহাস নির্মাণের নামে মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার আয়োজন দিকে দিকে স্পষ্ট। চক্রান্তের স্বরূপ উন্মোচনে সাংসদ জহর সরকার

Must read

বাবরি মসজিদের ধ্বংসের পর আর অযোধ্যায় নতুন রাম মন্দিরের রাজনৈতিক মুনাফা লোটার পর বিজেপি ও আরএসএস-এর এখন অন্য দাঙ্গাস্থলের প্রয়োজন। শ্রীরামের অযোধ্যা মন্দির ভাঙিয়ে তো আজীবন ভোট টানা যায় না? তাই তাঁরা এখন শ্রীকৃষ্ণ এবং শিবের শরণাপন্ন। মথুরায় শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি নিয়ে হঠাৎ এত মাতামাতি আর কাশীতে স্বয়ং বিশ্বনাথ বাবার সংলগ্ন জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া শুরু হয়েছে। আমাদের সচেতন থাকতে হবে কারণ ওঁদের অক্লান্ত প্রচেষ্টাই হল সাম্প্রদায়িক তিক্ততা বাড়ানো এবং সুযোগ পেলেই দাঙ্গা লাগানো।
কিন্তু যেখানে ১৯৯১-এর উপাসনার স্থান আইন (Places of Worship Act 1991) বলবৎ আছে, সেখানে এই প্রশ্ন ওঠে কী করে? ওই আইন তো স্পষ্ট বলে দিয়েছে যে “১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে যে কোনও উপাসনালয়ের ধর্মীয় চরিত্র যেমন ছিল সেটি সেভাবে বিদ্যমান থাকবে।’’ অতএব ভারতের স্বাধীনতার দিন যেসব মন্দির, মসজিদ, গির্জা বা চৈত্য যার দখলে ছিল তার হাতেই থাকবে এবং তাকে ছোঁয়া যাবে না। একমাত্র বাবরি মসজিদকে বাদ রাখা হয়েছিল, কেননা ওই স্থানটির আইনগত বিবাদ ১৯৪৭-এরও অনেক আগেকার বলে।

আরও পড়ুন-মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে নিজেকে তৈরী করুন

এই আইনটি যে সবার ঊর্ধ্বে তা সুপ্রিম কোর্টও দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। মাননীয় বিচারপতিগণ কঠোরভাবে রায় দিয়েছেন যে আইনটি “ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার জন্য একটি প্রশ্নবিহীন বাধ্যবাধকতা ন্যস্ত করে।” রাম জন্মভূমিতে মন্দিরের জন্য অযোধ্যার বিতর্কিত জায়গা হস্তান্তরের বিষয়ে আদালতের আলোড়ন বা বিতর্ক সৃষ্টিকারী রায়ের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। এই রায় ১৯৯১ সালের আইনটি পুনর্ব্যক্ত করে বলেছিল যে, “ভারতীয় রাষ্ট্রনীতির ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যগুলিকে রক্ষা করার জন্য এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল যা সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি।” এবং বিষয়টি রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ দ্বারাই সমর্থিত। অতএব এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে মামলা তো গ্রহণ করার কোনও অবকাশই নেই।

আরও পড়ুন-বজ্রপাত দূষণ কমাতে সাহায্য করে!

এর মানে কি আমরা ঐতিহাসিক অন্যায় মেনে নেব? বুঝতে হবে যে সমস্ত বিজয়ীরা যা করে এসেছে, মধ্য যুগের মুসলিম শাসকরা তাই করেছিল। কিন্তু আজকের ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়, যাদের বেশিরভাগই স্থানীয় ধর্মান্তরিতদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে তারা কোনও সম্পর্কহীন আক্রমণকারীদের কুকর্মের মূল্য দেবে? এটা আশা করা স্পষ্টতই অন্যায্য বলে মনে হয়।
চিন-বার্মার বংশোদ্ভূত আহোম আক্রমণকারীরা, যখন অসমের বেশিরভাগ অংশ জয় করেছিল তখন প্রায় একই সময়ে ইসলামি সৈন্যরা সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমিতে অগ্রসর হয়েছিল, তাদের কি একইভাবে মূল্য দিতে হবে কারণ তারা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার হিন্দুদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিল? নাকি তাদের প্রাক-হিন্দু ধর্মের অনেক উপাদান ধারণ করা সত্ত্বেও তারা শেষ পর্যন্ত হিন্দু ধর্মকে গ্রহণ করেছিল বলে তাদের ছাড় দেওয়া হবে?

আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় গণতন্ত্র নেই, অপশাসনের রাজত্ব, বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ কুণালের জনসংযোগে তৃণমূল

এ-ছাড়াও, পৃথিবীতে এমন কোনও ধর্ম নেই যা পূর্ববর্তী ধর্মের ‘মন্দির’ ধ্বংস করেনি বা তাদের স্থানগুলিকে অধিকার করেনি। আমরা পুরী, শবরীমালা, তিরুপতি, গয়া ইত্যাদির ‘বৌদ্ধ অতীত’ নিয়ে চুপচাপ ফিসফিস করে কথা বলি। বৌদ্ধ, নব্য-বৌদ্ধ এবং জৈনদের মধ্যে চরমপন্থীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেই পারে যে হাজার হাজার শিব এবং বিষ্ণু মূর্তি আসলে তাদের দেবতা এবং তীর্থঙ্করের প্রতিরূপ। কুশীনগরে অবস্থিত রামভর ভবানীর মন্দির যেখানে বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণে সেই স্থানে প্রবেশ করেছিলেন। আলেকজান্ডার কানিংহাম, যিনি এএসআই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ১৮৬১ সালে এই স্থানটি আবিষ্কার করেছিলেন এবং অনেক কিছু বলেছিলেন।
তাই আমরা আশা করেছিলাম যে সামান্যতম সাম্প্রদায়িকতার আঁচ পেলে আদালত তাঁর ভারী কুড়াল চালিয়ে সেই সংক্রান্ত প্রশ্ন উড়িয়ে দেবেন। তা তো হলই না বরং আদালতের সামনে মথুরা, কাশী ও আগ্রার তাজমহল নিয়ে বিজেপি আরএসএস সমর্থকদের পেশ করা মামলাগুলি গ্রহণ করা হল। এই বিষয় নিয়ে শুনানিও চলছে বহাল তবিয়তে, যা অনেকের মতে সম্পূর্ণ অনুচিত। অন্যদিকে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থা এএসআই যথেষ্ট সফলভাবে তাদের হেফাজতের পবিত্র স্থানগুলির রূপান্তর রোধ করতে সফল হয়েছে। তাই অবাক লাগে যখন আমরা দেখি এত শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও নিম্ন আদালত কী করে এক সুপরিকল্পিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে গিয়ে এত দ্বিধাগ্রস্ত! আদালতগুলি কি বুঝতে পারছেন না যে নতুন কোনও প্রশ্নের অবকাশ নেই। আর আগুন নিয়ে খেলা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয় তাঁরা কি উপলব্ধি করতে পারছেন না যে কাশী-মথুরার মতন পুরানো ক্ষতগুলিকে যেগুলি নিরাময় করতে কয়েক শতাব্দী লেগেছিল আবার খোঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে? এই স্টিচগুলি কেটে ফেললে আবার কত রক্ত আর পুঁজ বেরোবে?

আরও পড়ুন-অভিষেক আসার আগেই উত্তপ্ত ত্রিপুরা, আক্রান্ত তৃণমূল কংগ্রেস, নীরব দর্শক পুলিশ

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সুপ্রিম কোর্টও সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও ১৯৯১-এর আইন সংক্রান্ত সব প্রশ্ন এক কথায় নাকচ করলেন না। অনেকেই যথেষ্ট হতাশ হয়ে দেখলাম তাঁরা কী করে কাশীর মামলাটি এক সিভিল জজের বেঞ্চ থেকে উচ্চতর জেলা জজের আদালতে স্থানান্তরিত করলেন! বোধহয় তাঁরা প্রথমেই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করতে চাননি কিন্তু পরিস্থিতিকে এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণে না আনলে খুবই বিপজ্জনক। ১৯৯১-এর আইনের সারমর্ম দ্ব্যর্থহীন ভাবে পরিষ্কার। এমন এক সন্ধিক্ষণে যখন ভারতের সংবিধানের বহুত্ববাদী চরিত্র ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, তখন শব্দ ও আইনি শব্দার্থের উপর চুলচেরা বিশ্লেষণ অসহনীয় বিলাসিতা হয়ে উঠেছে। এটি একটি অন্তহীন প্রক্রিয়া যাতে আসলে হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ছাড়া আর কারও কোনও লাভ নেই।

Latest article