ইউক্রেন প্রত্যাগত ডাক্তারি পড়ুয়াদের সমস্যা মেটাতে উদাসীন কেন্দ্র। উল্টোদিকে তৎপর রাজ্য। শুধু তাই নয়। সমস্যা নিরসনে একগুচ্ছ বাস্তবমুখী প্রস্তাব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। জন দরদের পার্থক্য স্পষ্টতর। লিখছেন কলকাতা পুরসভার পুর প্রতিনিধি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম দৃশ্য: স্থান- লালবাহাদুর শাস্ত্রী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বারাণসী। প্রধানমন্ত্রী ২০ জন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। তাঁরা ইউক্রেন থেকে দেশে ফিরেছেন। তাঁদের ডাক্তারি পড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কাতে ভুগছেন। প্রধানমন্ত্রীজির কাছে তাঁদের প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া গেল না। তিনি কোনও আশ্বাস দিলেন না। একজন ছাত্র তো বললেন, তাঁরা যা যা জানতে চেয়েছিলেন, তাঁদেরকে সেসব প্রশ্ন করতেই দেওয়া হয়নি। ইউক্রেনের টার্নোপিলে চতুর্থ বর্ষে পাঠরত বিশাল কুমার আঙুল তুললেন অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (ফাইনান্স), (প্রয়াগরাজ জেলার) দিকে। তিনি তো প্রশ্ন করতে বারণ করেইছিলেন, উল্টে সরকারের সদর্থক দিকেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যা জিজ্ঞাসা করবেন, সেটুকুরই উত্তর দেওয়া যাবে, তাও আবার সরকারের সমালোচনা না করেই। একই অভিযোগ শোনা গিয়েছে ইভানো-ফ্রাঙ্কভিস্ক ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ঋত্বিক দিবাকরের মুখেও। ১৮০০০-র বেশি ছাত্র যাঁরা তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশাহারা তাঁদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সময় দিয়েছেন মাত্র ১০ মিনিট।
আরও পড়ুন-রাশিয়ার তেল: মার্কিন খবরদারিতে ‘না’ দিল্লির
দ্বিতীয় দৃশ্য : ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র, কলকাতা। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে ফিরে আসা রাজ্যের ৩৯৩ জন পড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে সবাইকে ডেকে এনে তাঁদের মুখে তাঁদের কথা শুনলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একগুচ্ছ বিকল্প পথের দিকনির্দেশ করলেন। পড়ুয়াদের সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজ্য সরকার যে সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত, জানালেন তাও। আর্থিক সাহায্য করারও প্রতিশ্রুতি দিলেন। রাজি করালেন বেসরকারি কলেজের প্রতিনিধিদেরও ফি মকুবের।
আরও পড়ুন-ছাড়ার আশ্বাস
মঞ্চে উপস্থিত মুখ্যসচিব, স্বাস্থ্যসচিব-সহ বিভিন্ন আধিকারিককে নির্দেশ দিলেন ছাত্রদের প্রতিটি সমস্যা শুনে তার যথাযথ ব্যবস্থা করতে। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকদের এই মিটিংয়ের পর অনেকটা আশ্বস্ত দেখিয়েছে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ মিটিং শেষে দ্রুত ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনকে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রস্তাবগুলো জানিয়ে আশু সমাধানের জন্য চিঠি লিখেছেন।
দুটি দৃশ্যেই সরকারের প্রধান— একজন কেন্দ্রে আর একজন রাজ্যে ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রথমটিতে সরকারের কোনও সদিচ্ছার কথা ছাত্ররা শুনতে পাননি। দ্বিতীয়টিতে সরকারের সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস ছাত্ররা পেয়েছেন। বাংলার বিজেপি নেতা তথা অর্থমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ সুভাষ সরকার বলেছেন, ডাক্তারির ডিগ্রি যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার দেয়, তাই মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর এ বিষয়ে কিছু করার নেই। বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর মানবিক আচরণে রাজনীতির কুনাট্যর ছায়া আবিষ্কার করেছে। এটা ঠিকই যে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল যারা এমবিবিএস ডিগ্রি দেয় তারা একটি স্বশাসিত সংস্থা। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্যের কোনও সরকারের সরাসরি কোনও ভূমিকা নেই। কিন্তু এরকম আপৎকালীন অবস্থায় তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে তা অবশ্যই সরকারের রেকমেন্ডেশন বা আরও পরিষ্কার করে বললে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছানুসারেই গৃহীত হবে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠার অবসানে চিঠি লিখেছেন। দিল্লি হাইকোর্ট তথা সুপ্রিম কোর্টেও এ নিয়ে জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। দেশের প্রত্যেকেই যখন বিচলিত, তখন সুভাষ সকারের অভিযোগটিই যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন-পঞ্চাশ টাকায় স্ট্রবেরি, কেনা যাবে মাছ-সবজি, হোলিতে ধোনির উপহার, তিনদিন খোলা ফার্মহাউস
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, যাঁরা প্রথম বর্ষে ইউক্রেনে পড়া শেষ করেছেন তাঁরা আবার এ দেশে প্রথম বর্ষে ভর্তির সুযোগ পাক। যেহেতু ইউক্রেনে আমেরিকান এডুকেশন সিস্টেমে পড়ানো হয়, সেখানে ডাক্তারির পাঠ্যক্রমের মেয়াদ ৫.৮ বছর। আমরা ব্রিটিশ সিস্টেম অনুসরণ করি, তাই এখানে মেয়াদ ৪.৫ বছর। এজন্য এক বছর বেশি পড়াশোনা করতে হয় ইউক্রেনে। সুতরাং প্রথম বর্ষের ছাত্রদের ইয়ার লস হবে না, যদি তাঁরা পুনরায় প্রথম থেকেই শুরু করেন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়ারাও চাইলে তাঁদের ইচ্ছেমতো আবার এদেশে ফ্রেশ ভাবে শুরু করতে পারেন। এডুকেশন সিস্টেমের পার্থক্যর জন্য ল্যাটারাল এন্ট্রিতে টেকনিক্যাল সমস্যা হলে তা ব্রিজ কোর্স বা এরকম কিছু করে সামলানো যায়। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব হল বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে সুপারনিউম্যারারি সিটে তাঁদের ভর্তি করা হোক। এক্ষেত্রে রেগুলার অ্যাডমিশনের অতিরিক্ত সিট অনুমোদন করে তাঁদের পড়াশোনার ব্যবস্থা হতে পারে।
আরও পড়ুন-ভাঙন ঠেকাতে মরিয়া কংগ্রেস, সোনিয়া-আজাদ বৈঠক, রাহুলে অনাস্থা বিক্ষুব্ধদের
২০১১ সালে মা মাটি মানুষের সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছিল, তখন রাজ্যে মেডিক্যাল কলেজে আসন সংখ্যা ছিল ১৩৫৫টি। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৫০০০ এরও বেশি। ২৩টি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে বর্তমানে ৭টি বেসরকারি কলেজে যদি এককালীন ব্যবস্থায় ২০০ জন ছাত্র ভর্তিরও ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে কলেজপিছু গড়ে ২৫-৩০টি আসন বৃদ্ধি করতে হবে। একটি শিক্ষাবর্ষে ছাত্রস্বার্থে এরকম পদক্ষেপ করা যেতেই পারে। দেশের ৫৪২টি মেডিক্যাল কলেজ ধরলে সংখ্যার নিরিখে গড়ে ২৫-৩০টি আসনের বেশি হবে না। অর্থাৎ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও একই মডেল গ্রহণ করা যেতে পারে।
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যে মডেলের কথা বলেছেন তা এনএমসি ভেবে দেখলেই সমস্যার একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে।
আরও পড়ুন-সৌজন্যের দোল দেখাল তৃণমূল
এমনিতেই আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার নেই। সেক্ষেত্রে চার-পাঁচ বছরের প্রশিক্ষিত যেমন চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্রদের জন্য হাতে-কলমে কাজের সুযোগ দিলে, ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করলে, রোগীকল্যাণে যে সুবিধে হবে তাই নয়, এই ছাত্রদের ভবিষ্যৎও সুরক্ষিত হবে। মুখ্যমন্ত্রী ছাত্রদের অনুরোধ করেছেন গ্রামে, মফস্বলে গিয়ে পরিষেবা দেওয়ার জন্য। সরকার এ ধরনের শর্ত আরোপ করে ছাত্রদের ডিগ্রি শেষ করার সুযোগ করে দিতে পারে। যেহেতু আমাদের দেশে চার বছর পরই ইন্টার্নশিপের যোগ্যতা অর্জন করা যায়, তাই এই মডেলটিকে স্বাগত জানানোই উচিত। NMC বর্তমানে বিদেশে পাঠরত পড়ুয়াদের এদেশে ইন্টার্নশিপ করার ও রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে রেজিস্ট্রেশন (প্রভিশনাল) করার অনুমতি দিয়েছে কোভিড আক্রান্ত চিন বা ফিলিপন্স থেকে যাঁরা ফিরেছেন তাঁদের জন্য অথবা ইউক্রেন ফেরত পড়ুয়াদের জন্য। কিন্তু তাঁদের যোগ্যতা নির্ণায়ক FMGE বা ফরেন মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট এগজামিনেশন পরীক্ষাতে কৃতকার্য হওয়ার পরই তাঁরা তা করতে পারবেন।
আরও পড়ুন-শত্রুঘ্নের অপেক্ষায় আসানসোল
মুশকিল হল, NMC-র গাইডলাইন অনুযায়ী নিট (ইউজি) পরীক্ষায় কৃতকার্য না হলে ডাক্তারি পড়া যায় না। ইউক্রেন ফেরত পড়ুয়ারা এই সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন, এটা মাথায় রেখেই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী NMC-কে এই বিষয়ে রিল্যাক্সসেশন দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। এ ব্যাপারে ভারত সরকার নিশ্চুপ। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবগুলো দেশের যে কোনও রাজ্যের পড়ুয়াদেরই পাশে থাকার বার্তা দিচ্ছে।