এই ভোটের একটাই ধ্রুবপদ— মানি, মাসল পাওয়ার অ্যান্ড এজেন্সি…।
আর এই অস্ত্রগুলো প্রয়োগ করে ৪০০ আসন জেতার হিসেব মেলাতে হিমশিম গেরুয়া শিবির। কিন্তু বাংলার প্রার্থী-তালিকা প্রকাশ নিয়ে হাবুডুবু ভাব দেখেই মালুম হচ্ছে, ৪০০ যোগ্য প্রার্থীই ওদের হাতে নেই, অথচ ৪০০ আসন জেতার খোয়াব দেখছেন ওঁরা!
আরও পড়ুন-লোকসভা ভোটের আগে গ্রামপঞ্চায়েত পেল তৃণমূল
নির্বাচন কমিশনে নিজেদের জোর কায়েম করে এ-রাজ্যে ভোটের দফা বাড়িয়েছেন। বৈশাখে শুরু হয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলবে কাঁঠাল-পাকা হাঁসফাঁস গরমের মধ্য জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত। বাংলায় সাত দফা, গুজরাতে এক দফা। তামিলনাড়ুও চিরাচরিত একদফারই পথিক। অগ্নিগর্ভ কাশ্মীরে পর্যন্ত তিন দফা, বাহিনীও বঙ্গের তুলনায় প্রায় ৩০০ কোম্পানি কম। সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় বাহিনীই নয়, দোসর সর্বোচ্চ সাত দফার ভোট। একুশ সাল থেকেই বাংলাকে ভাতে মারার চক্রান্ত চলছে। সেই ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তের জেরেই জলপাইরঙা ফৌজি পোশাক আর আধুনিক বন্দুক কাঁধে আধাসেনার সদর্পে দাপাদাপি শুরু হয়ে গিয়েছে। মুখে গণতন্ত্রের রঙিন উৎসব বলা হলেও বাস্তবে ভোটপর্ব ক্ষমতারই ষোলো আনা কদর্য প্রদর্শন।
আরও পড়ুন-ভোটের আগে বিজেপির তাণ্ডব শুরু তৃণমূল অঞ্চল সভাপতির বাড়িতে বোমাবাজি, গুলি
সব লম্ফঝম্প জুন মাস পর্যন্ত। সকাল বিকেল বিমানে, কপ্টারে, ঠান্ডি গাড়ির দীর্ঘ কনভয়ে, মিছিলে মিটিংয়ে পেশিশক্তির প্রতিস্পর্ধী আস্ফালন। পেল্লায় তোরণ, বর্ণাঢ্য ব্যানার, ফেস্টুন, দেওয়াল লিখন, রোড শো, সর্বত্রই যেন বর্ণচ্ছটা। গেরুয়া সবুজ ধ্বজা। একদিনের নয়, পাক্কা আড়াই মাসের রঙিন ভোট উৎসব। আর তাতেই পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। দেদার টাকার শ্রাদ্ধ। নোট বাতিলের পরও কালো এবং সাদা দুই কিসিমের টাকার নগ্ন দৌরাত্ম্য। সঙ্গে কুলীন কর্পোরেট তোলাবাজি। বিগত ভোটের আগে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার চাঁদা মাত্র দু’মাসে পকেটে পুরেছে বিজেপি। সামান্য সুদের টাকায় চলা মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়া প্রবীণ মানুষ অন্ধকারে গুমরে মরেন। তাঁর জীবনে ফাগের রং নিকষ কালো! তাক লাগানো ভোট প্রচারের বিপুল আয়োজনে ঢাকা পড়ে যায় জনগণের রক্তশূন্য মুখ, বেকার যুবকের উদাস চাহনি, ঝিমিয়ে পড়া তরুণের নষ্ট হয়ে যাওয়া কেরিয়ার, পরিযায়ী শ্রমিকের নুইয়ে পড়া কাঁধ, লকডাউনে বাবা চাকরি হারানোয় বিয়ে থমকে যাওয়া যুবতীর জমাট হতাশা। এদের পাশে ভোট পাখিরা থাকে না, থাকে কেবল কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যশ্রীর মতো প্রকল্পের বাড়িয়ে দেওয়া হাত।
আরও পড়ুন-ভোটের আগে বিজেপির তাণ্ডব শুরু তৃণমূল অঞ্চল সভাপতির বাড়িতে বোমাবাজি, গুলি
তাই, তাই-ই, ভোট কড়া নাড়লেই বিজেপির থিঙ্কট্যাঙ্করা তৃণমূল কংগ্রেসের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার ঝুটা আওয়াজ তোলে। অথচ ফল বেরলেই সেই স্বপ্ন নিমেষে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। এবারও জোড়াফুলের গন্ধ গায়ে নেই এমন ৪২ জন প্রার্থী খুঁজে পেতে পদ্ম পক্ষ হিমশিম। একবার নয়, বারবার একই নাটকের পুনরাবৃত্তি।
অথচ কতগুলো প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই।
বেকার যুবতীরা কি চাকরি পাবে? জিনিসের দাম কি কমবে? কেন্দ্রীয় সরকারের ৯ লক্ষ শূন্য পদে কি নিয়োগ হবে, কিংবা যাঁরা এখন চাকরিরত তাঁরা কর্মজীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজ করতে পারবেন তো? আর প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শুনছি, চাকরি চাওয়ার চেয়ে চাকরি দেওয়ার লোক নাকি বেড়ে যাচ্ছে তাঁর হাতে তৈরি নতুন ভারতে। মিথ্যাচার আর কাকে বলে?
আরও পড়ুন-কেজরি ইস্যুতে সরব আমেরিকা, স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করার দাবি
স্বাধীনতার পরে ভারত যে-পথে হেঁটেছিল— বাক্স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও ধর্মনিরপেক্ষতা— সে-পথে চলতে সাহস লাগে। ভারতের সে অর্জন অসাধারণ, বিশ্বের উন্নততম দেশগুলির সঙ্গে তুলনীয়। সেই বৈশিষ্ট্যের কারণেই ভারত বিশ্বমঞ্চে যে সম্মান পেত, আর কোনও উন্নয়নশীল দেশ তা পায়নি। সাম্প্রতিক কালে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভারতের এই বৈশিষ্ট্যগুলি বিপন্ন। এবারের ভোট এই বৈশিষ্টগুলো রক্ষা করার শপথ নেওয়ার ভোট। ভারতবাসী এই দেশকে বেলারুশ বা পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ দেশের মতো হয়ে যেতে দেবেন না, এই আস্থা বাঁচিয়ে রাখার ভোট।
আরও পড়ুন-ভোটের আগে বিজেপির তাণ্ডব শুরু তৃণমূল অঞ্চল সভাপতির বাড়িতে বোমাবাজি, গুলি
আজ যেমন আমরা ভাবি যে, অতীতের সমাজ কীভাবে দাসপ্রথা বা অস্পৃশ্যতার মতো ভয়ঙ্কর ব্যবস্থাকে সহ্য করত, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আমাদের কথা সেভাবেই ভাববে— কী করে আমরা এই বিপুল আর্থিক অসাম্যকে সহ্য করি। অতিরিক্ত অসাম্য গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষতি করে। বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া মানে শুধু আরও অনেক বাড়ি-গাড়ি কেনার ক্ষমতা নয়, সেই সম্পদ তাঁদের সেই ক্ষমতা দেয়, যা দিয়ে রাজনীতিকদের জয় করে নেওয়া সম্ভব, রাষ্ট্রীয় স্তরে নীতিপ্রণয়নকে নিজেদের পক্ষে অনুকূল করে নেওয়া সম্ভব। উল্টো দিকে, গরিব ও মধ্যবিত্তর হাতে ভোটাধিকার থাকে, কিন্তু তাদের মতামতের আর কোনও গুরুত্ব থাকে না। সব ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয় অতিধনীদের হাতে। এবারের ভোট সেটা আটকানোর ভোট, গণতন্ত্রকে রক্ষা করার অনুকূল অর্থনীতি ধরে রাখার ভোট। গোটা দুনিয়ায় সম্ভবত আর দ্বিতীয় উদাহরণ নেই, যেখানে গত এক শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটার পর ভারতের মতো গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে বজায় রাখা গিয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই রাজনৈতিক বিনিয়োগ থেকে অর্থনৈতিক লাভ মিলতে আরম্ভ করেছিল, ভারতের বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের ঊর্ধ্বে ছিল বেশ কয়েক বছর। আমরা যদি আমাদের গণতান্ত্রিক শক্তিকে স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিই, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপার হবে। এই ভোটে সে-কথা যে আমাদের স্মরণে আছে, সেটা অন্যদের মনে করিয়ে দেওয়ার ভোট।
যারা উন্নয়ন নয়, ধর্মীয় বিভাজন,গণতন্ত্র নয়, একদলীয়তন্ত্র, প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবারের ভোটে নেমেছে, তাঁদের ছুঁড়ে ফেলুন।