আজ দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে ঈদ-উল-আধা (আজহা)। যাকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এটি কোরবানির ঈদ অথবা বকরি ঈদ নামেও পরিচিত। তবে আমাদের দেশ ভারতের অধিকাংশ মানুষ ঈদ-উল-আধাকে বলে বকরি ঈদ। একই নামে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তানেও। মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, মিশর ও লিবিয়ায় কোরবানির ঈদকে বলা হয় ঈদুল কিবির।
ঈদ শব্দের অর্থ উৎসব৷ আর আধা (আজহা) শব্দের অর্থ ত্যাগ বা উৎসর্গ৷ যদিও আত্মত্যাগকে ঠিক উৎসব বলা যায় না। কিন্তু যেহেতু তা পালিত হয় একটি বিশেষ দিনে এবং বহু মুসলিম ওই বিশেষ দিনটিকে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালন করেন, তাই তাতে ঈদ শব্দটি সংযুক্ত হয়েছে। ইসলামি চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী হিজরি বছরের শেষ মাস হল জিলহজ৷ এই মাসের ১০ তারিখে বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় ঈদ-উল-আধা (আজহা)৷ এই ঈদে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তোষ ও নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা চালায়।
মুসলিম জীবনে এই ঈদের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতার এক অনুপম মেলবন্ধন দেখা যায় এতে। ইসলামে জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাঁথা। যে জীবন নৈতিকতার, যে জীবন কল্যাণকর, যে জীবন পরম করুণাময়ের কৃপাকে অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করে তা ইসলামি জীবন। এই ঈদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ। সমাজের সর্বস্তরের মুসলিমের প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এলাকার মানুষ ঈদের নামাজের জন্য ঈদগাহে উপস্থিত হন। এতে সবার মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি ফুটে ওঠে। বিভেদ ভুলে কোলাকুলি। এই ঈদও অপরকে কাছে টেনে নেওয়ার দিন।
আরও পড়ুন-মুঘলদের রান্নাঘর
ইসলামি জীবনে ত্যাগের গুরুত্ব অপরিসিম। এই ত্যাগ জোর দেয় নিজের নিজের কু-প্রবৃত্তি থেকে মুক্তির। চরম লালসার দুনিয়া থেকে মুক্তির। সেই সম্পদ ও বৈভব থেকে মুক্তি যেখানে পরম করুণাময়ের অনুগ্রহ নেই, যা অর্জিত হয়েছে বাঁকা পথে। তাই নিছক পশু উৎসর্গের ওপর তা সীমাবদ্ধ নয়। সেই পরম সত্তার কোনও কিছুর অভাব নেই। তিনি অভাবমুক্ত। তাই তো তিনি মানুষকে বলেছেন, মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হতে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এদিন সে উদ্যোগ অনেকটাই নজরে আসে।
ঈদ-উল-আজহার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কোরবানি। কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের একটি অন্যতম ঐতিহ্য। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত পশু জবেহ করা হল কোরবানি। যদি কোনও মুসলিম সাড়ে ৭ ভরি ওজনের সোনা বা সাড়ে ৫২ ভরি ওজনের রুপো অথবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ অর্থ বা ব্যবসার পণ্যের মালিক থাকেন বা হন, তাঁর জন্য ইসলামে কোরবানি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা নিজের সামর্থ অনুযায়ী ভেড়া, মহিষ, গরু, ছাগল, উট, দুম্বা প্রভৃতি পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন৷ কোরবানি হচ্ছে একটি প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহর জন্য তাঁর বান্দার আত্মত্যাগের একটি উপমা মাত্র। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে বছরভর আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় নিজ সম্পদ অন্যের কল্যাণে ব্যয় করার মানসিকতা গড়ে ওঠে তাহলে বুঝতে হবে কোরবানি সার্থক হয়েছে।
আরও পড়ুন-আইপিএলে উপরে ব্যাট করার সুবিধা পাচ্ছি: হার্দিক
ইসলামি ইতিহাস থেকে জানা যায়, হজরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল ও কাবিল প্রথম কোরবানি দিয়েছিলেন। তাঁরা দুজনেই কোরবানি দিলেও তখন হাবিলের কোরবানি গৃহীত হয়, কাবিলের প্রত্যাখান হয়। অবশ্য আল্লাহ তাআলা মুত্তাকিন বা ধর্মভীরুদের কোরবানিই কবুল করেন। তবে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানিই আমাদের কাছে আত্মত্যাগের সবথেকে বড় নিদর্শন। স্বপ্নে আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর নিজ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর সম্মতিতে কোরবানি করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। এই উদ্দেশ্যে তিনি পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে মিনার একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যান এবং তার চোখ বেঁধে মাটিতে শুইয়ে দেন। অতঃপর কোরবানি করার জন্য পুত্রের গলায় ছুরি চালান। কিন্তু আল্লাহ তাঁর নির্দেশ পালনের প্রতি পিতা এবং পুত্রের অপরিসীম ত্যাগের বিষয়ে খুশি হন এবং হজরত ইসমাইল (আ.)-কে রক্ষা করেন। আর আল্লাহর তরফ থেকে পাঠানো একটি পশু হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে কোরবানি করা হয়। পরম করুণাময় আসলে আমাদের কাছে এটুকুই চান। তিনি আমাদের উদ্দেশ্য দেখেন। আমরা হৃদয়ের গভীর থেকে তাঁকে যেটুকু অর্পণ করি, তিনি আমাদের তার থেকে বেশিই ফেরত দেন। কিন্তু আমরা বুঝি না। যাঁরা বোঝেন তাঁরা করুণাময়ের প্রিয়পাত্র। তাই তো হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই শিহরন-জাগানো ত্যাগ হাজার হাজার বছর পরও এমন জীবন্ত। সেই ত্যাগকে তাই এতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
আরও পড়ুন-আইপিএলে উপরে ব্যাট করার সুবিধা পাচ্ছি: হার্দিক
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের সেই ঐতিহাসিক শিক্ষাকে উঁচু করার জন্য প্রতি বছর ঘুরে আসে পবিত্র ঈদ-উল-আজহা। এক কথায়, মানুষের ঔদ্ধত্য ও অহমিকার মূলোৎপাটন করতেই মূলত ঈদ-উল-আজহার আগমন। ঈদ-উল-আজহায় যে কোরবানি দেওয়া হয় তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কোরবানির রক্ত-মাংস কখনওই স্রষ্টার কাছে পৌঁছোয় না। কোরবানির মাধ্যমে দেখা হয় মানুষের হৃদয়কে।
বর্তমান সমাজে কোরবানি নিয়েও চলে নানা প্রতিযোগিতা। নিজেদের প্রতিপত্তি জাহির করতে প্রভূত অর্থে পশু কিনে প্রদর্শনের হিড়িক বাড়ছে। এমন উদ্দেশ্যে কিছু লাভ হয় না। কোরবানির মধ্যে যদি লোভ থাকে তাহলে সেই কোরবানিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন না। অর্থাৎ সামাজিক প্রদর্শনের কথা ভেবে কোরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় না। তিনি অখুশিই হন।
আরও পড়ুন-লিগে মোহনবাগান অনিশ্চিতই
ইসলামের বিধান অনুযায়ী কোরবানি দেওয়া পশুর মাংস তিনভাগে ভাগ করা হয়৷ একভাগ নিজেদের রেখে বাকি দুভাগের একটি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও অন্য ভাগটি প্রকৃত গবিরদের মধ্যে বিতরণ করা হয়৷ এর মাধ্যমে আত্মীয়তা বজায় রাখা এবং গবির, দুঃখীদের কাছে টানার সুযোগ সামনে চলে আসে। ধনী-গরিবের ব্যবধান তখন আর থাকে না। ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়স্বজন সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে। কোরবানির মাংস গরিব আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করার যে বিধান আছে তার মধ্যে নিহিত রয়েছে সামাজিক সমতার মহান আদর্শ।
আরও পড়ুন-নাইরোবি ফ্লাই: অসুস্থ শিশু
কোরবানির এই সুন্দর প্রথার কারণে সামাজিক ঐক্য ও সংহতি আরও মজবুত হয়। কোরবানির মাংস গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার যে রীতিনিয়ম রয়েছে তার মাধ্যমেও ধনী-গরিবের মধ্যকার বিভেদ কমে আসে। হতদরিদ্ররা কোরবানির মাংসের মাধ্যমে তাদের আমিষের চাহিদা কিছুটা পূরণ করতে সক্ষম হয়। সামর্থ্যবান ধনীদের কোরবানির কাজে নিজেকে হাত লাগাতে হয়। দিনভর পরিশ্রম করতে হয়। গোটা কাজটি সম্পন্ন করার জন্য লোকের দরকার পড়ে। তাঁদের পারিশ্রমিক দিতে হয়। ফলে তাঁদেরও একটা উপার্জনের সুযোগ আসে। নগদ অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি উৎসবের আনন্দে তাঁদেরকে অতিরিক্ত কিছু মাংসও দেওয়া হয়। পশুর চামড়া বিক্রির টাকা গরিব মানুষের কাছে বণ্টন করে দিতে হয়। সেই টাকাতে কেবল তাঁদের হক। যিনি কোরবানি দিচ্ছেন তাঁর ওই টাকাতে কোনও দাবি থাকে না।
আরও পড়ুন-জিটিএ সদস্যদের শপথ ১২ জুলাই, মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি
এর ফলে ঈদের দিনে একদিকে আয়ের সুযোগ তৈরি হয়, অপরদিকে তা হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে বেশ কিছু দিন প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে। কোরবানি গরিব-অসহায়, দুস্থদের মুখে হাসি ফোটায়। এত মাংস একসঙ্গে আর কখনও তারা আরাম করে খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না। দারিদ্র্য বিমোচনেও এর গুরুত্ব রয়েছে। পশু কেনাবেচা ও কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সামাজিকতার এবং অর্থনীতির একটি সম্পূর্ণ প্যাকেজ এই কোরবানি। যে কারণে তা এমন করে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে।