সারদাসুন্দরী দেবী
বিবিধ বিষয়ে কবিতা রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে নিজের মাকে নিয়ে সম্ভবত কোনও কবিতা লেখেননি। কেন এই উদাসীনতা? প্রশ্নটি অনেকের মনেই উঁকি দেয়। তাঁর মা ছিলেন সারদাসুন্দরী দেবী। যশোরের দক্ষিণডিহি গ্রামের রামনারায়ণ চৌধুরীর কন্যা। ১৮৩৪ সালের মার্চ মাসে সতেরো বছর বয়সি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সেই সময় সারদাসুন্দরীর বয়স ছিল ছয়।
গৃহকর্মনিপুণা ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ বাড়িতে থাকলে রান্নাঘরে যেতেন। উপাসনার সময় স্বামীর কাছে গিয়ে বসতেন। ছেলেরা শুয়ে পড়লে একটু রাতে দেবেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে ডেকে পাঠাতেন। সারদাসুন্দরী ধোয়া সুতির শাড়ি পরে আতর মেখে যেতেন স্বামীর কাছে।
আরও পড়ুন-রাবীন্দ্রিক পোশাক
পনেরো সন্তানের জননী হয়েছিলেন। যদিও নানা কারণে সন্তানদের দিকে সবসময় মনোযোগ দিতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর চোদ্দোতম সন্তান। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় সারদাসুন্দরীর বয়স ছিল চৌত্রিশ। কনিষ্ঠ সন্তান বুধেন্দ্রনাথের অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ বাড়িতে কনিষ্ঠ সন্তানের আদরেই বড় হন। তবে মায়ের আদর ছিল তাঁর অধরা। একটি গদ্যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তাঁর ঘরে তক্তাপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে বসে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন, যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর। তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না।’
রবীন্দ্রনাথের আরেকটি লেখায় আছে, ‘আমার বড় দিদিই আমাকে মানুষ করেছেন৷ তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন৷ মার ঝোঁক ছিল জ্যোতিদা আর বড়দার উপরেই৷ আমি তো তাঁর কালো ছেলে৷’
স্পষ্টত বোঝাই যাচ্ছে, মায়ের সঙ্গে একটা গভীর রঙের-দূরত্ব রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, অন্য সন্তানদেরও। প্রশ্ন উঠতে পারে, সন্তানদের ব্যাপারে সারদাসুন্দরীর এই ঔদাসীন্য কি মন থেকে ছিল? সরলা দেবী চৌধুরানী লিখছেন, ‘সেকালের ধনীগৃহের আর একটি বাঁধা দস্তুর জোড়াসাঁকোয় চলিত ছিল। শিশুরা মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রীস্তন্যে পালিত ও পুষ্ট হত।’ এই নিয়ম মেনে শিশু রবীন্দ্রনাথকেও মায়ের কোল থেকে যেতে হয়েছিল ধাত্রী-মায়ের কোলে।
আরও পড়ুন-আমার রবি কবি
প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিতা ছিলেন না সারদাসুন্দরী দেবী। যদিও নিরক্ষর ছিলেন না। কাজকর্ম্মের অবসরে সারাদিনই তাঁর হাতে থাকত একখানা বই। চাণক্যশ্লোক ছিল বিশেষ প্রিয়। প্রায়ই বইখানি নিয়ে শ্লোকগুলি আওড়াতেন। সারদাসুন্দরীকে সংস্কৃত রামায়ণ-মহাভারত পড়ে শোনাবার জন্য প্রায়ই কোনও না কোনও পুত্রের ডাক পড়ত। ডাক পড়ত রবীন্দ্রনাথেরও।
অল্প বয়সেই অসুস্থতা থাবা বসিয়েছিল সারদাসুন্দরীর শরীরে। শেষজীবনে তাঁকে কিছুদিন বোটে করে গঙ্গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হত। বাড়ি ফিরে আসার পর থাকতেন অন্তঃপুরে। তেতলার ঘরে। তখন বিশেষ কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। এমনকী সন্তানদেরও না।
দীর্ঘ রোগভোগের পর ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে চলে যান সারদাসুন্দরী। দিনটি ছিল ১৮৭৫-এর ১১ মার্চ। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তেরো বছর দশ মাস। সেই দিনটির কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, ‘মার যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অল্প। অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই।’
আরও পড়ুন-দেবের কপ্টারে ধোঁয়া, জরুরি অবতরণে রক্ষা
গভীর রাতে মৃত্যু হয় সারদাসুন্দরী দেবীর। রবীন্দ্রনাথ এবং আরও কয়েকজন তখন অন্য একটি ঘরে। একজন দাসী কাঁদতে কাঁদতে খবর দিতে এসেছিলেন। কাদম্বরী দেবী ওই দাসীকে রাতের মতো ছোটদের কাছে কথাটি গোপন রাখতে বলেন। পরের দিন সকালে রবীন্দ্রনাথ মায়ের মৃত্যুসংবাদ পান। একটি লেখায় তিনি জানিয়েছেন, ‘প্রভাতে উঠিয়া যখন মা-র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না।’ সবার সঙ্গে শ্মশানে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। যেতে যেতে তাঁর মনে হয়েছিল, ‘এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।’
বাল্যকালে মাতৃহারা। তাই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে মায়ের উপস্থিতি কম৷ সেই কারণেই হয়তো নিজের মাকে নিয়ে কবিতা রচনা করেননি। যদিও তাঁর অসংখ্য কবিতায় রয়েছে মায়ের উল্লেখ। সেই মা মূলত দেশজননী, জগজ্জননী অথবা নিজের সৃষ্ট চরিত্রের মা। কবির ‘শিশু’ অথবা ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থে যে মায়ের ছবি দেখা যায়, তার মধ্যেও তাঁর নিজের মায়ের ছায়া অথবা মাতৃস্নেহ কোনওটাই প্রতিফলিত হয় না। এই মা যেন ‘অন্য-মা’। হয়তো নিজের মাকে নিবিড়ভাবে কাছে না-পাওয়ায় বেদনা কবির মনে আজীবন বেজেছিল। তাই হয়তো চিরকাঙ্ক্ষিত মাতৃরূপ সৃষ্টি করে মনে মনে নিজে তাঁর ছোট্ট খোকাটি হয়ে সেই মায়ের স্নেহধারায় ভিজে মনের অপ্রাপ্তি কিছুটা হলেও দূর করতে চাইতেন।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
কাদম্বরী দেবী
রবীন্দ্রনাথের থেকে ২ বছরের বড় ছিলেন নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী। ১৮৬৮ সালের ৫ জুলাই তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বধূ হয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আসেন। তখন তাঁর বয়স ছিল নয় বছর। নাম ছিল মাতঙ্গিনী। রবীন্দ্রনাথের তখন সাত। ঠাকুরবাড়িতে এসে মাতঙ্গিনীর নাম হয় কাদম্বরী। প্রথমদিন নববধূটিকে ছোট্ট রবি দূর থেকে দেখেছিলেন। কাছে যাওয়ার সাহস পাননি। এরপর কাদম্বরী অন্দরমহলের অন্যান্য নারীর মাঝে হারিয়ে যান। বহুদিন তাঁর দেখা পাননি রবীন্দ্রনাথ।
প্রায় বছর চারেক পর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সোমেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন হয়। তেরো বছরের কাদম্বরীর উপর দায়িত্ব পড়ে দুই দেবরকে হবিষ্যান্ন রেঁধে খাওয়ানোর। সেই সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক গভীর স্নেহ-মায়া-মমতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মনে পড়ে বৌঠাকরুণ আমাদের দুই ভাইয়ের হবিষ্যান্ন রেঁধে দিতেন, তাতে পড়ত গাওয়া ঘি। ওই তিন দিন তার স্বাদে, গন্ধে মুগ্ধ করে রেখেছিল লোভীদের।’
ওই সময় থেকেই দু’জনের মধ্যে গভীর বন্ধুতা সূচিত হয়। রবি হয়ে ওঠেন বৌঠানের ছোটখাটো কাজের সঙ্গী। নিম্নবিত্ত পরিবারের কন্যা। বিয়ের আগে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাননি কাদম্বরী দেবী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উৎসাহেই শিক্ষালাভ করেন। একটা সময় হয়ে ওঠেন ঠাকুরবাড়ির শিল্প-সাহিত্যের মধ্যমণি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের প্রেরণা। একদিকে যেমন ছিলেন কল্পনাপ্রবণ, অন্যদিকে উদ্যমী, সাহসী। স্বামীর কাছ থেকে ঘোড়সওয়ারির শিক্ষা পেয়েছিলেন।
চোদ্দো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছিলেন ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের অনুবাদ। সেখানেই ‘হেকেটি’র সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। খেলাচ্ছলে রাগানোর জন্য নতুন বৌঠানকে দিয়েছিলেন ‘হেকেটি’ নাম। ১৮৮১ সালে ‘ভগ্নহৃদয়’ গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করলেন ‘শ্রীমতী হে-কে’! এই ‘হে’ আর কেউ নন, নতুন বৌঠান।
তিনতলায় ছাদের উপর বাগান সাজিয়েছিলেন কাদম্বরী দেবী। সযত্নে সাজাতেন ঘর। সবই করেছিলেন ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য মেনেই। তাঁর মন ছিল রোম্যান্টিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। শাশুড়ি সারদাসুন্দরী দেবীর মৃত্যুর পর কাদম্বরী মাতৃহীন রবির দেখভালের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের হাতে। এতদিন দু’জন ছিলেন পিঠোপিঠি বন্ধু। এই সময় থেকে কাদম্বরী হয়ে ওঠেন রবির মায়ের মতো।
আরও পড়ুন-আমার রবি কবি
রাঁধুনি চাকরদের হাতের একই ধরনের খাবার খেয়ে বিরক্ত রবীন্দ্রনাথের রসনার তৃপ্তিও হয়েছিল কাদম্বরী দেবীর হাত ধরেই। ফ্যাশন করে পোশাক পরার অভ্যাস ছিল কাদম্বরীর। সেটা নিয়ে দু’জনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হত। রবীন্দ্রনাথ কোনও কোনও সময় কাদম্বরী দেবীর জিনিসপত্র মজা করে লুকিয়ে রাখতেন। তাই নিয়ে লেগে যেত দু’জনের। এই ছোটখাটো ঝগড়ার মধ্যে দিয়েই গভীর হয়েছিল তাঁদের বন্ধুতা।
সাহিত্যের প্রতি কাদম্বরী দেবীর গভীর অনুরাগ ছিল। বিশেষত সেই সময়ের বাংলা সাহিত্যের প্রতি। পড়তেন। আলোচনা করতেন। সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি নতুন বৌঠানকে পড়ে শোনাতেন বাংলা সাহিত্যের অনেক উপন্যাস। তখন বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’। সেটাও পড়ে শোনাতেন। কাদম্বরী চোখে দেখে পড়ার থেকে শুনে শুনেই সাহিত্যরস আস্বাদন করতে বেশি পছন্দ করতেন। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ শোনাতেন নিজের লেখা কবিতাও। শুনতে শুনতে দুপুরবেলায় হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী। নিঃসন্তান এই নারী স্বামীর উৎসাহে জড়িয়ে পড়েন ‘ভারতী’ পত্রিকার সঙ্গে। নিজগুণে ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক সাহিত্যসভার কেন্দ্রেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনতলার ছাদে নিয়ম করে বসত সাহিত্যসভা। বাড়ির কেউ কেউ থাকতেন। পাশাপাশি আসতেন বাড়ির বাইরের অনেকেই।
কাদম্বরীর প্রিয় কবি ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। মাঝেমধ্যেই তাঁকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। সেই আসরে ডাক পড়ত রবীন্দ্রনাথের। কাদম্বরী নিজের হাতে আসন বুনে উপহার দিয়েছিলেন বিহারীলালকে। সেটা স্মরণ করে পরবর্তী সময়ে বিরাহীলাল লিখেছিলেন ‘সাধের আসন’। কাদম্বরী রবীন্দ্রনাথকে বলতেন, ‘তুমি বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো লিখতে পারবে না।’ যাতে দেবরটি আরও ভাল লেখে তার জন্য এমন কথা বলতেন। নতুন বৌঠানের মুখে এমন কথা শুনে জেদ চেপে যেত রবীন্দ্রনাথের। তিনি আরও ভাল লেখার চেষ্টা করতেন। এইভাবেই কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভাকে বিকশিত করার চেষ্টা করতেন। তিনি শুধু রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুপ্রেরণা এবং ভক্তই ছিলেন না, তাঁর লেখার সবথেকে বড় সমালোচকও ছিলেন। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে তিনি ছিলেন অপরিহার্য। শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গিনী।
সন্ধেবেলায় কাদম্বরী বাড়িতে বসাতেন গানের আসর। মাদুরের উপর সাজাতেন তাকিয়া। রুপোর রেকাবে ভিজে রুমালের উপর রাখতেন বেলফুলের গোড়ের মালা। এক গ্লাস বরফজল। সাজানো থাকত বাটা ভর্তি ছাঁচি পান। গা ধুয়ে চুল বেঁধে বসতেন কাদম্বরী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাজাতেন বেহালা। রবীন্দ্রনাথ গলা ছেড়ে গান ধরতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী মাঝে মাঝেই গঙ্গার ধারে কোনও বাগান বাড়িতে হাওয়া বদল করতে চলে যেতেন। সঙ্গী হতেন রবীন্দ্রনাথ। গান বাঁধতেন, গান গাইতেন তাঁদের উৎসাহে। কাদম্বরী নিজেও ছিলেন একজন সু-অভিনেত্রী এবং সুগায়িকা। এরপর ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বরে বিয়ে হয় রবীন্দ্রনাথের।
বিয়ের ২ মাস পরেই অর্থাৎ ১৮৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ছবি ও গান’ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন নতুন বৌঠানকেই। দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে কৌতূহলের শেষ ছিল না। বাতাসে ভেসে বেড়াত মুখরোচক গল্প। যদিও তাঁরা কর্ণপাত করতেন না। একদিন চিরবিদায় নিলেন কাদম্বরী দেবী। জীবনে ছিল বহু অপ্রাপ্তি। সহ্য করেছেন অপমান। শিকার হয়েছেন স্বামীর উদাসীনতার। তাই হয়তো নিয়েছিলেন স্বেচ্ছানির্বাসন। চিরদিনের জন্য। ‘চিরসখা’ রবীন্দ্রনাথকে শূন্য করে দিয়ে। নতুন বৌঠানকে কোনও দিন ভুলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তাঁর স্মৃতি। পরে স্বীকার করেছেন— ‘খুব ভালবাসতুম তাঁকে। তিনিও আমায় খুব ভালবাসতেন। এই ভালবাসায় নতুন বৌঠান বাঙালি মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রাণের তার বেঁধে দিয়ে গেছেন।’
আরও পড়ুন-প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত কেনিয়া! মৃত কমপক্ষে ১৮৮ জন
মৃণালিনী দেবী
ছাঁদনাতলায় বসার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। পাত্রী ভবতারিণী। ঠাকুর এস্টেটের এক কর্মচারীর মেয়ে। বিয়ের আমন্ত্রণপত্র লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সেই বয়ান ছিল বড় অদ্ভুত। রবীন্দ্রনাথ মাতিয়ে রেখেছিলেন বিয়ের আসর। গেয়েছিলেন গান। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স বাইশ। ভবতারিণীর বয়স মাত্র নয় বছর। বিয়ের পর ভবতারিণীর নাম হয় মৃণালিনী। যদিও রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে আদর করে ডাকতেন ‘ভাই ছুটি’ বলে।
মৃণালিনী ছিলেন গভীর ব্যক্তিত্বময়ী, সুদর্শনা। গৃহকর্মনিপুণা। খুব কম বয়সেই মৃণালিনী সংসারের গুরুদায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ স্নেহ করতেন ছোট পুত্রবধূটিকে। মৃণালিনীকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে মহর্ষি তাঁকে ভর্তি করেন কলকাতার লরেটো হাউসে। মৃণালিনী এক বছর সেখানে পড়াশোনা করেন। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতে এরপর বাড়িতেই স্ত্রীর সংস্কৃত শেখার ব্যবস্থা করা হয়। বীরেন্দ্রনাথের পুত্র বলেন্দ্রনাথের মাধ্যমেও ইংরেজি, বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন মৃণালিনী। সেইসঙ্গে ছিলেন মার্ক টোয়েনের অনুরাগী।
অল্প বয়সে হয়েছিলেন মা। ১৮৮৬ সালের ২৫ অক্টোবর জন্ম হয় বেলা অর্থাৎ মাধুরীলতার। মৃণালিনী এবং রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান। গুরুজনদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। তাঁর রান্নার হাত ছিল চমৎকার। স্বামী, সন্তান, আত্মীয়স্বজনকে রেঁধে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভোজনরসিক। তিনি নিত্যনতুন রান্নার ফরমায়েশ করতেন স্ত্রীর কাছে। প্রতিটি আবদার হাসিমুখে মেটাতেন মৃণালিনী। একদিন রবীন্দ্রনাথকে একটা মিষ্টি তৈরি করে খাওয়ালেন। ওই মিষ্টির নাম বাঙাল ভাষায় ‘এলোঝেলো’। শুনে নাক সিঁটকোলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর মিষ্টির নাম রাখলেন ‘পরিবন্ধ’।
সাংসারিক জীবনে ছিলেন দারুণ ব্যস্ত। তার মাঝেই নীরবে করতেন সাহিত্যচর্চা, অনুবাদ। মৃণালিনীর চিঠি লেখার হাত ছিল চমৎকার। রবীন্দ্রনাথ যখন দূরে থাকতেন, চিঠির মাধ্যমে দু’জনের ভাবের আদান-প্রদান হত। তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি পাওয়া গেছে ছত্রিশটি। তবে রবীন্দ্রনাথকে লেখা মৃণালিনীর দুটোর বেশি চিঠির খোঁজ পাওয়া যায় না। ঠাকুরবাড়ির নাটকের দলের সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন মৃণালিনী। ‘রাজা ও রানী’ নাটকে নারায়ণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দূর আকাশের তারা। মনে মনে বুঝতেন মৃণালিনী। তাই বিখ্যাত স্বামীকে কখনও বেঁধে রাখার চেষ্টা করেননি। তবে পরস্পরের প্রতি গভীর ভালবাসা ছিল। মান-অভিমান ছিল। ছিল নির্ভরতা। বারবার বাসা বদল করেছেন। বোলপুর শান্তিনিকেতনে আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেইসময় স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মৃণালিনী দেবী। বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের গহনা। সেই টাকা তুলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের হাতে। নানাভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী। তবে দীর্ঘ আয়ু লাভ করেননি এই মহীয়সী নারী। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর চলে যান না ফেরার দেশে। রবীন্দ্রনাথকে একা করে দিয়ে। স্ত্রীর প্রতি ছিল তাঁর ভালবাসা। সেটা যে কতটা গভীর, মৃণালিনীর মৃত্যুর পর উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।