দেখিয়া শুনিয়া তিনি ক্ষেপিয়া গিয়াছেন। তিন আর কেউ নন। বিজেপির (BJP) বরিষ্ঠ নেতা ও দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একটার পর একটা দফা ভোট শেষ হচ্ছে আর তাঁর কপালের ভাঁজ চওড়া হচ্ছে। ৪০০ পারের গল্প এখন পগার পার হয়ে গিয়েছে। সেই কারণে প্রধানমন্ত্রী এখন সরাসরি ধর্মের কথা বলে ভোট চাইছেন। এতদিনে ‘বিকাশ’ বেনোজলে ভেসে গিয়েছে। এখন শেষ এবং বরাবরের বিজেপি অস্ত্র ধর্ম, বিভাজন ও মেরুকরণ। সেটা সুস্পষ্টভাবে হিন্দু-মুসলমানের ভাগাভাগি করে হিন্দু ভোট আদায় করার কৌশল। এই কৌশল কার্যকরী করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজে খোলামঞ্চে অসত্য কথা বলছেন। যেকোনও ভারতবাসীর কাছে সেটা অকল্পনীয়। তিনি কংগ্রেসকে লক্ষ্য করে বলছেন, যদি তারা জেতে তবে হিন্দু মা/বোনেদের মঙ্গলসূত্র হারাতে হবে। আর তৃণমূল কংগ্রেসকে লক্ষ্য করে বলছেন, যদি তাঁরা জেতেন তাহলে হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে। অসত্যের আশ্রয় নিয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াতে বিজেপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। একজন প্রধানমন্ত্রী এবং শাসকদলের প্রধান এমন কথা বলতে পারেন সেটা অবিশ্বাস্য! কিন্তু এটাই বিজেপির সংস্কৃতি। যে দলটার স্বাধীনতা সংগ্রামে কানাকড়ি অবদান নেই তারা ক্ষমতায় থাকার জন্য কত নীচে নামতে পারে এটা তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
আর মুসলমানদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অতীতের মতোই কুৎসিত এবং অভিযোগ করে চলেছেন। রাজস্থানের বাঁশওয়াড়ায় এক জনসভায় তিনি বলেছেন, ‘‘আগে যখন কংগ্রেসের সরকার ছিল, তখন বলেছিল, দেশের সম্পত্তিতে প্রথম অধিকার মুসলমানদের। এর অর্থ ওরা সম্পত্তি এককাট্টা করে যারা বেশি সন্তান উৎপাদন করে, যারা অনুপ্রবেশকারী তাদের বিলি করবে।’’ নরেন্দ্র মোদি কিন্তু এখানেই থেমে যাননি। এরপর মা/বোনেদের মঙ্গলসূত্র হারাতে হবে বলেছেন। সমস্ত হিন্দু ভোট জোটবদ্ধ হয়ে বিজেপিকে দেওয়ার কথা বলেছেন। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছে। রাজস্থানের বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার নেতা একটা টিভি চ্যানেলে বলেছেন যে, নরেন্দ্র মোদির মুসলমানদের সম্পর্কে এসব কথা বলা ঠিক হয়নি। আর যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে এই নেতাকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব অনুমান করেই বোধ হয় বিজেপির দুই মুখ মুক্তার আব্বাস নকভি ও শাহনওয়াজ হোসেন অতল জলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেছেন।
বিগত দুই দশকে মোদিকে নির্বাচন জেতার জন্য এত মরিয়া হতে দেখা যায়নি। বোঝা যাচ্ছে এবার একটা বিশেষ লোকসভা হতে যাচ্ছে। ৩ দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর অসত্য বলার মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছে। যা ভেবেছিলেন, বিশেষ করে জানুয়ারি মাসে রামমন্দির উদ্বোধনের পর, বুঝতে পারছেন সেটা হচ্ছে না। বিকাশ, উন্নয়ন, গ্যারান্টি কোনও কিছুতেই চিঁড়ে যখন ভিজছে না তখন পুরনো মেরুকরণ অস্ত্রে শাণ দেওয়া হচ্ছে। কুৎসিত কথাগুলো নরেন্দ্র মোদি এবং সাঙ্গপাঙ্গরা করতে পারছেন অবলীলাক্রমে তার কারণ সুকৌশলে তিনি নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন করে দিতে পেরেছেন।
এবার বালাকোটের মতো যুদ্ধের আবহাওয়া তৈরি করা যাচ্ছে না এখনও। কট্টর এবং অলীক দেশপ্রেমের জোয়ারে মানুষকে এখনও ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। তার উপর উত্তর-পশ্চিম ভারতে যথেষ্ট পরিমাণ মুসলমানদের ভোটের লাইনে দেখা যাচ্ছে। যে চিত্র অতীতের চাইতে অনেকটাই আলাদা। সে কারণেই মেরুকরণ আর অসত্য ভাষণের আশ্রয় নিতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে।
বিজেপি (BJP) নেতারা বলে মুসলমান মানেই ‘ঘুষপেটিয়া’। তাদেরকে তারা সব সময় পায়ের নীচে সন্ত্রস্ত রাখতে চায়। যোগী আদিত্যনাথ একটি সভাতে কংগ্রেসকে গালি দিয়েছেন এটা বলে যে তারা গোহত্যা করে সংখ্যালঘুদের মাংস খাওয়ার অধিকার দিতে চায়। মুর্শিদাবাদ এসে তিনিই রামনবমীর মিছিলের উল্লেখ করে দাঙ্গা বাধাবার শিক্ষা দিতে থাকেন। মুসলমানদের সম্পর্কে বিজেপির মনোভাব কী তা জানতে কারও বাকি নেই। দেশে মুসলমান সংখ্যা ১৮ শতাংশ। গত ১৬ ও ১৭তম লোকসভায় বিজেপি সাত ও ছয়জন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। এরা কেউ জিতবে না তা বিজেপি জানত। জেতেনি। রাজ্যসভায় তাদের দলের মুসলমান সাংসদ ছিলেন ৩ জন। মুক্তার আব্বাস নকভি, এম জে আকবর, সৈয়দ জাফর ইসলাম। এঁদের সময় শেষ হওয়ার পর আর ফিরিয়ে আনা হয়নি। বিজেপি’র মনোভাব হল এরা তো সব দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ক্ষমতার ভাগ তাদের দেওয়া হবে না।
কথায় কথায় বিজেপি ‘ক্রোনোলজি’র কথা বলে। দেশবাসী তাদের ‘ক্রোনোলজি’ ভাল জানে। ২০০২ সালে গুজরাত গণহত্যার পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা সবার জানা। সৈয়দ জাফরি, বিলকিস বানো কেউ তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পরেনি। তিনি শরণার্থী শিবিরে থাকা নিরীহ মা/বোনেদের সম্পর্কে বলেছিলেন ‘শিবিরগুলো অতিরিক্ত সন্তান উৎপাদনের কেন্দ্র’। আমরা বুঝতে পারি না আজও আমরা কোন দেশে বাস করছি! আমাদের বুদ্ধি, বিবেক, সৌজন্য কতখানি নিম্নগামী হলে এমন কথা বলা যায়?
১০ বছরে দেশের জন্য কিছুই করতে পারেননি। সারা বিশ্বে প্রতিদিন বেশি শিশু খাবার পায় না ভারতে। ৬৭ লক্ষ। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এখনও ভারতে। ১৮ কোটির বেশি মানুষ দিনে ১৮০ টাকাও উপার্জন করতে পারে না। সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি, উপজাতিদের জন্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি একের পর এক বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মানুষের জীবনে সামান্য স্বস্তি আনার মতো কোনও কাজ না করে দেশ বিক্রির নোটিশ জারি করেছেন। তিনি বুঝে গিয়েছেন মানুষ আর তার বিকাশ আর প্রয়াস বিশ্বাস করছে না। তাই বিভাজন। মেরুকরণ। এই হীন কৌশলকে পরাজিত করার শপথ নিন।
আরও পড়ুন- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩ তম জন্মবার্ষিকী, শ্রদ্ধা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী ও অভিষেক