নামবিভ্রাট
ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোক, সুধীন্দ্রনাথ সরকার। পা রেখেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুলনামূলক সাহিত্যের এমএ ক্লাসে ভর্তি হবেন। তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পঞ্চাশের দশকের স্নাতক। শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কৃতী ছাত্র। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের পর কোনও কাজ করেছেন কিনা, আবেদনপত্রে উল্লেখ করেননি। ফলে অ্যাডমিশন দফতর আবেদনপত্রটি প্রায় বাতিল করে দিচ্ছিল। তাঁদেরই পরামর্শে সুধীন্দ্রনাথ উপাচার্যের কাছে যান। উপাচার্য পূর্ব-পরিচিত। তাঁকে দেখে রীতিমতো অবাক। বলেন, ‘আরে! তুমিই যে সুধীন্দ্রনাথ, জানাবে তো!’
তখন সমাজে সুধীন্দ্রনাথের পরিচিতি অন্য একটি নামে। উপাচার্য আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘শুধু শুধু হেনস্থা হতে হল! এতদিন যে তুমি চাকরি করেছ লিখে দিলেই তো ঝামেলা চুকে যেত।’
সেই ঘটনার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে এমএ পড়ার অনুমতি পেয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ। বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ১৯৯২ সালে তিনি সসম্মানে এমএ পাশ করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ আর কেউ নন, কিংবদন্তি নাট্য-ব্যক্তিত্ব বাদল সরকার (Badal Sircar)। বাংলায় থার্ড থিয়েটারের জনক। তাঁর জানার এবং শেখার আগ্রহ ছিল প্রবল।
টাউন প্ল্যানার
জন্ম ১৯২৫ সালের ১৫ জুলাই। ভরা বর্ষায়। উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে। তিনি ছিলেন টাউন প্ল্যানার৷ ১৯৪৭ সালে নাগপুরে কর্মজীবন শুরু৷ পরবর্তী সময়ে কর্মসূত্রে ফ্রান্স, নাইজেরিয়া, ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন। বিদেশে থাকাকালীন বহু বিদেশি নাটক দেখেছেন। লন্ডনে ‘থিয়েটার ইন দ্য রাউন্ড’ দেখেই তাঁর মধ্যে বিকল্প ধারার থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। বিদেশের মাটিতে বসেই লিখেছেন কয়েকটি নাটক, উল্লেখযোগ্য বই। একটা সময় কাজকর্ম ছেড়েছুড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।
শৌখিন থেকে থার্ড থিয়েটার
নাট্যজীবন শুরু পাঁচের দশকের গোড়ায়। প্রথম জীবনে শৌখিন থিয়েটারে ‘চিরকুমার সভা’, ‘বন্ধু’, ‘ডিটেকটিভ’, ‘লালপাঞ্জা’ প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেছেন। তাঁকে সর্বভারতীয় খ্যাতি দেয় ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে লেখা নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’। নাইজেরিয়ায় থাকাকালীন লেখেন নাটকটি। ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় ছাপা হয়৷ এরপর তাঁর রচিত ‘বাকি ইতিহাস’, ‘প্রলাপ’ ইত্যাদি নাটক তাঁকে আরও পরিচিতি এনে দেয়। সাতের দশকে প্রতিষ্ঠা করেন নিজস্ব নাট্যদল ‘শতাব্দী’। প্রসেনিয়াম থিয়েটার ছেড়ে পাকাপাকিভাবে ‘থার্ড থিয়েটার’-এর চর্চা শুরু করেন। হয়ে যান থিয়েটারের সর্বক্ষণের কর্মী।
মঞ্চ থেকে মাটিতে
থিয়েটারকে তিনি মঞ্চ থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিলেন। একেবারে মানুষের মাঝে। দূর করেছিলেন অভিনেতা এবং দর্শকের প্রভেদ। কলকাতার কার্জন পার্ক, নন্দন চত্বরের খোলা আকাশের নিচে মঞ্চস্থ হত তাঁর নাটক। অন্যদের সঙ্গে অভিনয় করতেন নিজেও। একটা সময় দেশে দুই ধরনের থিয়েটারের প্রচলন ছিল— এক, ভারতের গ্রামীণ সমাজে পালাগান, যাত্রাপালা, ভাওয়াইয়া, নৌটঙ্কি প্রভৃতি লোকনাট্য। এটাই দেশীয় থিয়েটার। তিনি বলতেন ‘ফার্স্ট থিয়েটার’। দুই, বিদেশি সংস্কৃতির অনুকরণে মঞ্চ-নাটক। তিনি বলতেন ‘সেকেন্ড থিয়েটার’। এই দুটো থিয়েটারের সিন্থেসিস ঘটিয়ে তিনি একটি বিকল্প থিয়েটারের জন্ম দিয়েছিলেন, যাকে বলেছেন ‘থার্ড থিয়েটার’। ফার্স্ট থিয়েটার থেকে নিয়েছেন আঙ্গিক। সেকেন্ড থিয়েটার থেকে নিয়েছেন বিষয়। একটি তথ্যচিত্রে বলেছেন, ‘থার্ড থিয়েটার হবে খোলা জায়গায়, মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে অঙ্গন মঞ্চে এবং মুক্ত মঞ্চে। অঙ্গন মঞ্চ অর্থাৎ অল্প সংখ্যক দর্শক নিয়ে চার দেওয়ালের মধ্যে। মুক্ত মঞ্চ অর্থাৎ খোলা জায়গায় বিপুলসংখ্যক দর্শকের মাঝে। নিছক বিনোদন থার্ড থিয়েটারের উদ্দেশ্য হবে না। এর মধ্যে একটা সচেতনতার বার্তা থাকবে। সেইসঙ্গে হবে সুসংবদ্ধ। নমনীয়, বহনীয় এবং সুলভ।’
পরবর্তীকালে জুড়ে দেন আরও দুটি বিষয়— গ্রাম পরিক্রমা এবং ওয়ার্কশপ। তাঁর মন ছিল বাউলের মতো। উদার এবং আধুনিক। ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘সমাবিত্ত’, ‘সারারাত্তির’, ‘বল্লভপুরের রূপকথা’, ‘সাদাকালো’, ‘চূর্ণপৃথিবী’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘ভুল রাস্তা’, ‘ক-চ-ট-ত-প’, ‘ওরে বিহঙ্গ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক। তিনি ছিলেন বাউলের মতো। উদার, আধুনিক, আন্তর্জাতিক।
আরও পড়ুন- কেরলেই গেলেন প্রীতম, মোহনবাগানে সামাদ
তাঁর স্মরণে মুক্ত মঞ্চ
অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন বাদল সরকার (Badal Sircar)। ১৯৬৮ সালে পারফর্মিং আর্টসে সর্বোচ্চ সম্মান সংগীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ ‘রত্ন সদস্য’ পেয়েছেন৷ ১৯৭১ সালে পান জওহরলাল নেহরু ফেলোশিপ৷ ১৯৭২ সালে ‘পদ্মশ্রী’৷ ২০০৫ সালের অক্টোবরে পুনেতে জাতীয় চলচ্চিত্র সংরক্ষণাগার অনুষ্ঠিত ‘তেন্ডুলকার মহোৎসব’-এ তাঁর জীবন নিয়ে ডিভিডি এবং বই প্রকাশিত হয়। তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক তথ্যচিত্র।
২০১১ সালের ১৩ মে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বাদল সরকারের মৃত্যু হয়। তাঁকে নিয়ে কলকাতার সাহিত্য অকাদেমির সভাঘরে আয়োজিত হয় এক মনোজ্ঞ আলোচনাসভা। শিবপুর ভারতীয় প্রকৌশল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যা প্রতিষ্ঠানে তাঁর স্মরণে তৈরি হয়েছে একটি মুক্ত মঞ্চ।
নাট্যব্যক্তিত্বদের চোখে
কথা হল এই সময়ের দুই বিশিষ্ট নাট্য-ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। উৎপল ফৌজদার জানালেন, ‘‘খুব কম বয়স থেকেই আমি বাদল সরকারের থিয়েটার দেখেছি। থিয়েটারকে প্রচলিত দেখার বাইরে গিয়ে তিনি অন্যরকম ভাবে দেখতেন। বিষয় থেকে এসেছে তাঁর আঙ্গিক। এই আঙ্গিকের যে ইশারা, সেই ইশারাগুলো চালু সংকেত বা ইশারার থেকে আলাদা। বাদলবাবুর থিয়েটার এককথায় ইউনিক। পশ্চিমবঙ্গে তিনিই প্রথম কোম্পানি থিয়েটার চালু করেছিলেন। তাঁর থিয়েটারে বিদেশি প্রভাব দেখা যেত। যদিও তিনি বলতেন, এটা আন্তর্জাতিক প্রভাব। ওঁর আন্তর্জাতিকতা উপর-উপর আঁতলামির আন্তর্জাতিকতা ছিল না। ভিতরে ভিতরে যে স্পন্দনটা টের পেতেন, সেটা ধরবার চেষ্টা করতেন।আমাদের দেশকেও তিনি দেখতেন আন্তর্জাতিক আউটলুক দিয়ে। বলতেন, নাটক একইসঙ্গে সাহিত্য। তাঁর থিয়েটার একেবারেই পার্টি ওরিয়েন্টেড ছিল না। একটা অন্য দিক-নির্দেশ করত। তিনি পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর একজন।”
পল্টু ভট্টাচার্য জানালেন, ‘‘বাদল সরকার (Badal Sircar) আমার অন্যতম পছন্দের শিল্পী, পরিচালক। নিয়মিত তাঁর থার্ড থিয়েটার দেখতে যেতাম। মুক্ত মঞ্চে থিয়েটারে তিনি কোনও প্রবেশমূল্য রাখতেন না। নাটকের শেষে দর্শকদের সামনে চাদর বা গামছা পাততেন। দর্শকরা যা দিতেন, সেটাই নিতেন। এই দানকে তিনি দর্শকদের অংশগ্রহণ বলতেন। নতুন প্রজন্ম ওঁর কাজ দেখে দারুণ প্রভাবিত হয়েছিল। সেই দলে ছিলাম আমরাও।”