আজকের যশোদারা

আমাদের সমাজে দত্তক সন্তান নিয়ে লুকোচুরি সবসময় ছিল। আগেও মানুষ গোপন রাখতেন নিজের পালিত সন্তানের ইতিবৃত্ত। অথচ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের পালিতা মায়ের পরিচয়ে জগৎসংসারে পরিচিত। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। দেবকীর গর্ভজাত হলেও বিশ্বচরাচরের কাছে তিনি কিন্তু যশোদা-নন্দন। যুগ বদলেছে। বদলেছে মানুষের চিন্তা-চেতনা। আজ গর্বের সঙ্গে বহু পিতামাতাই নিজের দত্তক সন্তানকে  পরিচয় করান। হলিউড থেকে টলিউড সেলেব্রিটিরা নিজের সন্তান থাকা সত্ত্বেও দত্তক নিয়েছেন এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। অ্যাঞ্জেলিনা জোলি থেকে সুস্মিতা সেন, মন্দিরা বেদি, রবিনা ট্যান্ডন— কে নেই সেই তালিকায়। সেলেব থেকে সাধারণ বাবা-মা সন্তান দত্তক নিয়ে সফলভাবে বড় করে তুলছেন। আজকের যশোদারা গর্বিত। এমনই  কিছু সেলিব্রিটি এবং নামী ব্যক্তিত্বরা সেই পরম অনুভূতির কথা বললেন তপন বক্সি এবং শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী-কে

Must read

রবিনা ট্যান্ডন

১৯৯৫ সালে যখন আমার বয়স একুশ, সেই সময় আমি অ্যাডপটেশনের কথা ভাবি। নব্বই দশকের ওই সময়ে চাইল্ড অ্যাডপটেশন তখনও একটি সোশ্যাল ট্যাবু বলতে পারেন। এবং সেই জন্যই খুব স্বাভাবিক ভাবে আমি আমার চাইল্ড অ্যাডপটেশনের কথাটা বাইরে প্রকাশ করিনি। প্রকাশ না করার আরও একটি বিশেষ কারণ ছিল। যেহেতু আমার পরিবার বা আমি আমরা সিনেমা জগতের সঙ্গে যুক্ত, তাই আমার এই চাইল্ড অ্যাডপটেশনের খবর আরও ফলাও করে, এবং তাতে আরও রঙ মাখিয়ে বাইরে প্রকাশ পাওয়ার চান্স ছিল।
আজ সাতাশ বছর পর আমি খুব খোলা মনে নির্দ্বিধায় সেদিনের সেই ঘটনাটিকে আনন্দের সঙ্গে শেয়ার করতে পারছি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, বলিউডের আরও অন্যান্য নায়িকার চেয়ে আমি একটু ব্যতিক্রমী ছিলাম। কেননা ওই সময়ে আমি সদ্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছি। আমার কেরিয়ার শুরু করেছি। হিন্দি সিনেমার একজন ইয়াং নায়িকা, যে বিয়েও করেনি, সে কিনা দু-দুটি বাচ্চার মা হয়ে বসে আছে, এই খবরটি একটি ভুল সিগন্যাল হিসেবে প্রযোজক-পরিচালকদের কাছে যেতেই পারত। এবং আমি কাজ হারাতে পারতাম। বিয়ে না করে দু-দুটি বাচ্চার মা হওয়া, সেই সময়কার ইয়োলো ফিল্ম জার্নালিজমকে আরও প্রলুব্ধ করতে পারত। বেশ কয়েক বছর পর আমি আমার দুই মেয়ে পূজা আর ছায়াকে শুটিংয়ের সময় শুটিংয়ের সেটে নিয়ে গিয়েছি। তখন ওরা এইটথ, নাইনথ স্ট্যান্ডার্ডের ছাত্রী। শুটিংয়ের সেটে প্রযোজক, পরিচালক, কলাকুশলী, অভিনেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। ততদিনে ব্যাপারটা অনেকটা ধাতস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমার চারপাশের কাজের পরিবেশের মানুষেরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ ওই সময়টুকু আমি নিতে চেয়েছিলাম।

আরও পড়ুন-দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথি, শুভেচ্ছা বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

পূজা আর ছায়া আসলে আমাদের ডিসট্যান্ট রিলেটিভের দুই মেয়ে। আমি আর আমার মা যখন ওই আত্মীয়র বাড়িতে যেতাম, তখন দেখতাম ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত। আর সেই ঝগড়াঝাটির প্রভাব এসে পড়ত ওই ছোট্ট মেয়ে দুটির ওপর। আমার নিজের বয়স তখন ১৮/১৯ হবে। তখনই আমার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে আমি ডাক পেয়ে গিয়েছিলাম ভেতরে ভেতরে। তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে, এই ছোট্ট দুটি মেয়েকে আমি আমার মেয়ের মতো করে মানুষ করব। করেওছি। ওদের দুজনের স্কুলের পড়াশোনার লেভেল শেষ হওয়ার পর, কলেজে ভর্তি করে দিয়েছি। আমি বিয়ে করেছি ২০০৪-এ। আপনারা জানেন আমার স্বামী অনিল থাদানি হিন্দি সিনেমার প্রোডিউসর, ডিস্ট্রিবিউটর। বিয়ের পর আমাদের দুটি বায়োলজিকাল সন্তান হয়েছে। প্রথমটি মেয়ে রাশা। আর দ্বিতীয়টি ছেলে রণবীর বর্ধন। রাশা এখন ১৭। আর রণবীর ১৫। আর আমার অন্য দুই মেয়ে পূজা আর ছায়ার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওঁরা এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে ঘর সংসার করছে। এখন আমি শাশুড়ি এবং নাতি-নাতনিদের দিদিমা হয়ে গিয়েছি। সব মিলিয়ে আমার জমজমাট, ভরা সংসার। আর এরাই আমার চারপাশ পজিটিভিটি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে।

আরও পড়ুন-গোতাবায়ার আবেদন

মন্দিরা বেদি

আমার স্বামী রাজ কৌশলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল ১৯৯৯-এ। আমার ছেলে বীর-এর বয়স যখন পাঁচ বছর, অ্যাকচুয়ালি তখন থেকেই রাজ আর আমি বীর-এর বোন হিসেবে একটি মেয়ে দত্তক নেওয়ার কথা আলোচনা করেছি। তখন থেকেই ব্যাপারটা ভাবনার মধ্যে ছিল। ২০১৯-এর শেষের দিকে এসে ভাবনাটা আরও জোরালো হল। তখনই আইন মেনে একটি মেয়ে দত্তক নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করলাম। চাইল্ড অ্যাডপটেশন সেন্টার থেকে যে ফর্মটা আমরা তুলেছিলাম, সেখানে চাইল্ড অ্যাডপটেশনের জন্য সারা ভারতের মধ্য থেকে যে কোনও তিনটি রাজ্যকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল।
আমরা তিনটি রাজ্যের মধ্যে থেকে মহারাষ্ট্র, দিল্লি এবং পাঞ্জাব-হিমাচলকে বেছে নিয়েছিলাম। পরে লক্ষ্য করলাম, ওখানে ভারতের যে কোনও জায়গা থেকে নেওয়ার অপশনও রয়েছে। পরে আমরা সেকেন্ড অপশনটিকে বেছে নিয়েছিলাম। অবশেষে মধ্যপ্রদেশের টিকমগড় থেকে আমরা আমাদের মেয়ে তারা-কে পেয়েছি। আমি আর রাজ আমাদের ফ্যামিলিতে এরকম ছোট্ট একটি ফুটফুটে মেয়ের কথা আমরা অনেকদিন ধরে ভেবেছি। আমাদের ছেলে বীর যখন একটু বড় হল, তখন থেকেই আমি রাজকে বলতাম, আমাদের যদি একটা ছোট্ট মেয়ে হত, আমি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ওর চুল আঁচড়াতাম। আর বিনুনি বেঁধে দিতাম। বীর-ও খুব খুশি হবে ওর ছোট বোনকে পেয়ে। আর একটা কথা বলি। আমাদের যে মেয়ে হবে তার নাম হবে ‘তারা’, এটা আমরা দুজনেই আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম।

আরও পড়ুন-বিশ্বকাপের আগে টেনশনে ঋষভ

আমার এখনও মনে আছে তারাকে প্রথম দেখার দিনটির কথা। সেটা ২০২০-র ২৮ জুলাইয়ের কথা। সারা দেশে কোভিডের জন্য তখন লকডাউন চলছে। রাজ আগেই মধ্যপ্রদেশে চলে গিয়েছিল। আইনি কাজগুলি সেরে রাখার জন্য। কিছু পরে আমি, রাজের এক বন্ধু আর আমার ছেলে বীর মিলে প্রাইভেট জেটে চেপে জব্বলপুরে নামলাম। জব্বলপুর এয়ারপোর্টে তারা-কে প্রথম সামনাসামনি দেখলাম আমরা। সেটা যে কী অনুভূতি, বলে বোঝাতে পারব না। তখন থেকেই তারা আমাদের ‘চোখের তারা’ হয়ে আছে। তারার বয়স তখন চার। আর বীরের বয়স আট। সবাই মিলে ওকে খুব আদর করলাম আমরা। আর কোলে তুলে নিলাম। তারপর আবার প্রাইভেট জেটেই ফিরে এলাম মুম্বই। এই প্রথম প্লেনে চড়ল ও।
মুম্বইয়ের বাড়ি এসে তারা একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের ফ্যামিলির সবাই মিলে ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে গিয়েছিলাম। দিন সাতেকের মধ্যে দেখলাম তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। আর মন খুলে হাসছে। ঠিক যেন এক জ্যান্ত পরী এসেছে আমার ফ্যামিলিতে। আর বীর তো ভীষণ খুশি বোনকে পেয়ে। আসলে আমাদের মধ্যে বীর-ই সবচেয়ে আগে ওর বন্ধু হয়ে উঠল। একদিন বীর নিজেই বলল, আরে মা তারাকে তুমি কখন স্কুলে ভর্তি করবে? বীর আর তারার মধ্যেকার খেলাধুলো, খুনসুটি, কথাবার্তা, আবদার দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আমরা এবার সত্যি সত্যিই একটা বৃত্ত পূর্ণ করলাম যেন। রাজও ভীষণ খুশি হয়েছিল।

আরও পড়ুন-রাজ্যপালের সচিব পদে এলেন নন্দিনী

চৈতালী লাহিড়ী

আমি আর রূপঙ্কর খুব ভাল বন্ধু। আমরা সবসময় সবটা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই। দুজনেই বাচ্চা খুব ভালবাসি। আমার কাছে সন্তান দত্তক নেওয়া কোনও বিরাট গৌরবের বা গ্লোরিফাই করার মতো ব্যাপার তা ছিল না। আমরা দুজনেই তখন আমি বাবা-মা হতে চেয়েছিলাম এবং একটা বাচ্চা চেয়েছিলাম। সেটাই আমার কাছে তখন মোস্ট ইমপর্টেন্ট ছিল। অত কিছু ভাবিনি। ভেবেছিলাম সন্তান বায়োলজিকালই হতে হবে এমনটা কেন। আমার একটোপিক প্রেগনেন্সি ছিল তাই দুবার মিসক্যারেজ হয়। তখন আমার যিনি গায়নোকলজিস্ট তিনি আমাকে নানারকম পরামর্শ দেন। আইভিএফ-এর কথাও বলেছিলেন। কিন্তু আমার নিজের শরীরে অনেক কমপ্লিকেশন ছিল, প্রেশার হাই ছিল। খুব কম বয়সে আমার বিয়ে হয়নি। বিয়ের পাঁচবছর তখন অতিক্রান্ত। ফলে আমি আর রূপঙ্কর সিদ্ধান্ত নিলাম দত্তক নেব। আমি আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি। আমরা বাবা মা-ই তো হতে চাই, তাকে বড় করব তাকে নিয়ে জীবনে এগিয়ে চলব— কাজেই দত্তক নিলেই বা আলাদা কী হবে। কেন জন্মই দিতে হবে। বা নিজে জন্ম দিতে না পারলে কেন আমরা বাবা-মা হতে পারব না? কাজেই এরপর যেমন ভাবা তেমন কাজ। মহুল ছ’মাস বয়সে আমাদের কাছে আসে । সেই এক স্বর্গীয় অনুভূতি। ঠিক বলে বোঝাতে পারব না আমি। আমরা বেবি বাছাইও করিনি। ওকেই আমাদের দেখানো হয়েছিল। অদ্ভুতভাবে ওর সঙ্গে আমার মুখের খুব মিল ছিল। এখন তো অনেকটাই মিল। প্রথম যখন মেয়েকে এনে দেখাল ও হাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে আমার কাছে চলে আসে। মনে হয়েছিল যেন কেউ কোথাও একটা ওকে আমার জন্যই নির্বাচন করে রেখেছে। ওকে দেখেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। আমি বললাম আজকেই নিয়ে যাব— কিন্তু তা তো হয় না। অনেক প্রসিডিওর ছিল সেইভাবেই সব নিয়ম মেনে আমরা ওকে নিয়ে এলাম। কোথা থেকে ও এসে আমাদের জীবনকে আলোকময় উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। প্রথমদিন সে এক কাণ্ড হল। ওকে দেখতে এত লোকজন এসে গেল বাড়িতে।

আরও পড়ুন-অবাক হাদি

সবাই খুব এক্সাইটেড। আর মেয়ের অত লোকজন দেখে কান্না আর থামে না। তারপর ধীরে ধীরে সব সামলে উঠলাম। এরপর মহলের যখন সাত-আট মাস বয়স তখন চাকরি ছেড়ে দিই। কারণ রূপঙ্কর ভীষণ ব্যস্ত। আমি পাঁচবছর একটানা ওর দেখভাল করেছি কারও হাতে ছাড়িনি। তারপর স্কুলে ভর্তি করলাম। তখন আবার টুকটাক কাজ শুরু করলাম কিন্তু ফুলটাইম জব আর করিনি। প্রথম থেকেই মেয়েকে আমি একটু একটু জানিয়েছিলাম। বোঝাতাম যে মা মানেই যে নিজের গর্ভ থেকে তাকে জন্ম দিতে হবে এমনটা নয়। যিনি লালন-পালন করছেন তিনিও মা। শ্রীকৃষ্ণের গল্প যশোদা মায়ের গল্প বলতাম। একদিন বুঝতে শুরু করল। তখন ও অনেক প্রশ্ন করত। তারপর যে অর্গানাইজেশন থেকে মেয়েকে আনার সময় তখন ওরাই বলে দিয়েছিল ওকে বলে দেবেন না হলে খুব কঠিন হবে ওই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। তাই ছোট থেকেই প্রস্তুত করেছিলাম মহুলকে। যার সত্যি সুফল পেয়েছি। ফলে এখন ওর কাছে এটা কোনও আলাদা ঘটনাই নয়। ওর অনেক স্বভাব রূপঙ্করের মতো, অনেক স্বভাব আমার মতো। ওর মধ্যে মিউজিকাল সেন্স, সেটাও আমাদের পরিবারের মতো। আঠারো বছর হল মেয়ের। আমরা তিনজন পরস্পরের বন্ধু। আমরা সব কথা আলোচনা করি।
আমি মনে করি সন্তানের কোনও ভাগ হয় না। আমার সমাজের কাছে বার্তা, নিজের বায়োলজিকাল সন্তান থাকলেও সামর্থ্য থাকলে আর একটি সন্তান দত্তক নেওয়া উচিত। আমার মেয়ে খুব চেয়েছিল আমি আর একটা বেবি নিয়ে আসি কিন্তু আমার বয়স অনেকটা বেড়ে গেছে আর একজনকে মানুষ করতে হলে অনেকটা সময় দরকার। দত্তক নেওয়া বাড়লে কত শিশু নতুন করে বাবা-মা পেতে পারে এবং বাবা-মা আর একটা সন্তান পেতে পারে।

আরও পড়ুন-প্রতিষ্ঠা দিবসে আলিপুরদুয়ার থেকে রেকর্ড যোগদান হবে

অনিতা কুণ্ডু

প্রথমেই বলব মা হওয়া খুব কঠিন একটা বিষয়। আর যদি সেই সন্তান বায়োলজিকাল না হয় তাহলে তার পুরো বিষয়টা আরও আলাদা হয়ে যায়। দত্তক সন্তান মানুষ করা আরও বেশি কঠিন। কারণ যে মা নিজের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করছেন সেই মায়ের তিলতিল করে একটা মানসিক প্রস্তুতি গড়ে ওঠে সেই সন্তানকে নিয়ে। অনেক পরিকল্পনা থাকে মনে। কিন্তু যে মা সন্তানকে দত্তক নিচ্ছেন তাঁর আগের দিন পর্যন্ত কোনও মানসিক প্রস্তুতি নেই। সন্তান বাড়িতে আসার পরের দিন থেকেই সে মা। এটা আমার কাছেও খুব সহজ ছিল না। বাচ্চা ভীষণ ভালবাসতাম। যখন আমার গর্ভে সন্তান এল না বুঝলাম কিছু কমপ্লিকেশন আছে তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি দত্তক নেব কিন্তু কী করব, কীভাবে করব ভাবিনি। একটা ফিডিং বটল এবং একটা কাঁথা ছিল ওইভাবেই আমি আমার মেয়েকে নিয়ে এসেছিলাম। মা হতে চেয়েছিলাম তার জন্য কোনও শর্ত ছিল না যে জন্মই দিতে হবে এবং ছেলে বা মেয়ে নিয়েও বাছাই ছিল না। যে আমার ভাগ্যে থাকবে আমি তাকেই যত্ন করে মানুষ করব এটাই ছিল ইচ্ছে। যখন নিয়ে আসি হিয়াকে ওর মাত্র ছ’দিন বয়স। প্রথম দিন বা প্রথম ক’টা মাস ভুলব না। কিছুতেই মেটারনিটি লিভ পাচ্ছিলাম না। তখন আজ থেকে প্রায় সতেরো বছর আগে মেটারনিটি লিভ নিয়ে অত নিয়ম ছিল না। মাতৃত্বের ছুটি পাওয়া খুব চাপের ছিল। প্রথম ক’টা রাত ঘুমোইনি। সারারাত ধরে ওর সবটা নিজে হাতে করেছি। একপ্রকার যুদ্ধ করে মেটারনিটি লিভ পেলাম। প্রথম মাসটা পেরলে আমি খুব ভাল একটি মেয়েকে পাই। যে আমার মেয়ের দেখাশোনা যত্ন সবটাই করত। তখন আবার অফিস যাতায়াত শুরু করি।

আরও পড়ুন-আজ আসছেন লিমা, লাল-হলুদে হিমাংশুও

আমার স্বামী খুব হেল্প করেছে। কিন্তু মেয়ের আয়া তো থাকত বারো ঘণ্টা রাতের বেলায় পুরো আমিই দেখতাম। তারপর স্কুলে ভর্তি হল। কোনওদিন আয়া না এলে নিজেই সবটা করেছি। আমার মা আসতেন মাঝে মাঝে কিন্তু মায়েরও বয়স হয়েছিল। আজ মেয়ের সতেরো বছর হল একটা দিনের জন্য মনে হয়নি যে হিয়া আমার বায়োলজিকাল সন্তান নয়। আমি ছোট থেকেই মেয়েকে জানিয়েছিলাম কোনওদিন গোপন করিনি। একবার ও আমাকে প্রশ্ন করেছিল তখন আমি ওকে বলেছিলাম যে তোমাকে ঈশ্বর আমাকে উপহার দিয়েছেন। তাই তুমি আমার জীবনের সেরা গিফট। ও সবটা জানে। খুব নামী একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ে। ওর মধ্যে কোথাও কোনও সমস্যা নেই এটা নিয়ে। বরং হিয়া আমাদের নিয়ে গর্বিত বোধ করে। আমরা মা-মেয়ের পাশাপাশি বন্ধুও। আমার মাতৃত্বের এই অনুভূতিকে আমি স্বর্গীয় অনুভূতি বলে মনে করি। সিজারিয়ান বা নর্মাল ডেলিভারির অভিজ্ঞতাকে বাদ দিলে আমার অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা অন্য মায়েদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। আমি চাই আমার মেয়ে এমন মানসিকতা নিয়ে বড় হয়ে উঠুক।

Latest article