লীলা-যোগিনী যোগমায়া

যোগমায়া এমনই এক তত্ত্ব এবং তাত্ত্বিকভাবেই তিনি এমনই এক বিশেষ ক্ষমতাময়ী শক্তি যা স্বয়ং ভগবানকেও আপন নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাঁর দ্বারা সমাচ্ছন্ন থাকলে শ্রীকৃষ্ণকেও ভগবান বলে চিনতে পারা যায় না। গতকাল ছিল জন্মাষ্টমী। শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন। পবিত্র দিনটিকে মনে রেখে লিখলেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

Must read

স্বয়ং ভগবান, যাঁর কোনও আদি নেই অন্ত নেই, তিনি যখন মানুষের দুঃখ দেখে ঠিক করলেন যে, এই ধরাধামে তিনি কৃষ্ণ-রূপে লীলায়িত হবেন, তখন এতবড় একটা কাজ তিনি নিজে করতে পারবেন না বলেই কাজটা তিনি ‘ডেলিগেট’ করে দিলেন তাঁর অন্তরঙ্গা চৈতন্যময়ী মায়া-শক্তির কাছে। এই শক্তির নাম যোগমায়া। এখন যাঁরা ভাবেন যে, এই ‘event-management’-এর ব্যাপারটা এই সেদিন শুরু হয়েছে, তাঁরা জেনে রাখুন, আমাদের দেশে এ-কাজটা প্রথম শুরু করেছিলেন ভগবান বিষ্ণু। ভাগবত পুরাণে ব্রহ্মাদি দেবতারা যখন অধর্ম-ভারে ক্লিষ্টা পৃথিবীর ভার হরণের জন্য প্রার্থনা জানালেন ভগবান বিষ্ণুর কাছে, তখন বিষ্ণু তথাস্তু বলে মনুষ্য-রূপে পূর্ণ অবতার হবার ঘোষণা দিলেন। অবতার-গ্রহণের প্রক্রিয়া সূত্রাকারে জেনে নিয়েই ব্রহ্মা ফিরে এলেন দেবতাদের কাছে সমস্ত সংবাদ দেবার জন্য।

আরও পড়ুন-আজকের যশোদারা

ব্রহ্মা জানালেন— ভগবান বিষ্ণু মর্ত্যলোকে বসুদেবের ছেলে হয়ে জন্মাবেন। আর সহস্রবদন অনন্ত-নাগ বিষ্ণুর লীলাসহায় হিসেবে আগেই তাঁর বড় ভাই হয়ে জন্মাবেন বসুদেবের ঘরেই। আর নরদেহে ভগবানে জন্ম থেকে আরম্ভ করে পর পর তিনি কী করবেন না-করবেন, তার সমস্ত পরিচালনার ভার দিয়েছেন তাঁরই একান্ত অন্তরঙ্গা মায়াশক্তি যোগমায়ার ওপর এবং তিনিও বিষ্ণুর আদেশে প্রায় একই সময়ে জন্মাবেন পৃথিবীতে— তিনি বিষ্ণুমায়া— আদিষ্টা প্রভুনাংশেন কার্য্যার্থে সম্ভবিষ্যতি। এই বিষ্ণুমায়ার পরিচয়ে চারটি কথা— তিনি ভগবান বিষ্ণুর অংশ, তিনি ভগবত মায়া, তিনি সমস্ত জগৎকে মোহিত করেন এবং ভগবানের মানুষী কার্যকলাপ সবটা তিনিই পরিচালনা করবেন— বিষ্ণোর্মায়া ভগবতী…‘কার্য্যার্থে’ সম্ভবিষ্যতি।

আরও পড়ুন-দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথি, শুভেচ্ছা বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

ভাগবতের এই শ্লোক শুনে প্রাজ্ঞ-বৃদ্ধ-প্রাচীন টীকাকার শ্রীধরস্বামী ভগবতী মায়ার কার্যপরিচালনা অথবা ঈশ্বর-লীলার event-management-এর একটু নমুনা দিয়ে বললেন— ওই যে বসুদেবের ঔরসে দেবকীর সপ্তম গর্ভে বলরাম জন্মাবেন, সেই গর্ভ আকর্ষণ করে বসুদেবের অন্যতরা স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে সংস্থাপন করা, তারপর দেবকীর অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণ জন্মালে তাঁকে যশোদার কোলের কাছে রেখে সেখান থেকে তাঁর সদ্য-প্রসূতা কন্যাটিকে নিয়ে এসে দেবকীর হাতে দেওয়া— এখান থেকেই যোগমায়ার event-management আরম্ভ। আরও লক্ষণীয়, এই যোগমায়া কিন্তু অলৌকিক-ভাবে কৃষ্ণলীলার কর্মগুলি নাটকের মতো পরিচালনা করছেন না। তিনি নিজেও কিন্তু এই লীলা-ঘটনাবলির মধ্যে একজন ‘পারফর্মার’, তিনি এই লীলার একজন অংশীদার। তিনি কৃষ্ণের লীলা-জীবনের আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত এক সমান্তরাল চালিকাশক্তি, manager।

আরও পড়ুন-রাজ্যের একাধিক প্রকল্প ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপের প্রযুক্তি সভা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হল, টুইট মুখ্যমন্ত্রীর

পুরাণে দেখুন, যোগমায়ার প্রতি ভগবানের যত অনুশাসন সব কৃষ্ণাগ্রজ বলরামের জন্ম পর্যন্ত, কিন্তু তারপরেই নিজে যখন মর্ত্যভূমিতে মর্ত্যমাতার গর্ভে প্রবেশ করছেন সঙ্গে সঙ্গে ভগবতী যোগমায়াকেও তিনি মর্ত্য-মাতৃগর্ভে জন্ম নিতে নির্দেশ দিচ্ছেন। পুরাণের কৃষ্ণজন্মখণ্ডে যখন দেখা যাচ্ছে যে, দেবকীর সপ্তম গর্ভ প্রকট হয়ে উঠছে, তখনই ভগবতী যোগমায়াকে ভগবান হিসেবে শেষ নির্দেশ দিচ্ছেন— যদৃনাং নিজনাথানাং যোগমায়াং সমাদিশৎ। ভগবান বললেন— তুমি এখনই ব্রজভূমি বৃন্দাবনে যাও, দেবী! সেখানে গোপ-গোপীরা আছেন, আছেন ব্রজরাজ নন্দ এবং তাঁর স্ত্রী যশোদা। বসুদেবের অপরা স্ত্রী রোহিণীও আছেন বৃন্দাবনে। ওদিকে মথুরায় বসুদেব-পত্নী দেবকীর সপ্তম গর্ভে আমারই অংশ শেষশায়ী নারায়ণ মানবশিশু হিসেবে প্রকট হয়ে উঠবেন। আর সেখানে তোমার প্রথম কাজ হল, কংসের ভয়-ভীত দেবকীর পুষ্ট গর্ভ সমাকর্ষণ করে বৃন্দাবনে থাকা রোহিণীর গর্ভে সুসংস্থাপিত করা। তুমি এই সমাকর্ষণের কাজটি করবে বলে সেই রোহিণী-নন্দনের নামই হয়ে যাবে সঙ্কর্ষণ।

আরও পড়ুন-গোতাবায়ার আবেদন

ভগবান বিষ্ণু যোগমায়াকে আরও বললেন— রোহিণীর উদরে সংস্থাপন করার পরে তুমি বৃন্দাবনেই থাকবে। সঙ্কর্ষণ বলরামের জন্মের পরেই আমি দেবকীর গর্ভে প্রবেশ করব, আর তুমিও সেই মুহূর্তেই নন্দপত্নী যশোদার গর্ভে প্রবেশ করবে— ত্বং যশোদায়াং নন্দপত্ন্যাং ভবিষ্যমি। এত বড় কাজটা তুমি করে দেবে আমার। তার জন্য লোকে অনেক উপহার-নৈবেদ্য দিয়ে পুজো করবে তোমার। তুমি আমার একান্ত অন্তরঙ্গা শক্তি হলেও তুমি সমস্ত মানুষের কামনা পূরণ করবে। অনেক নামও হবে তোমার— দুর্গেতি ভদ্রকালীতি বিজয়া বৈষ্ণবীতি চ। কুমুদা চণ্ডিকা মায়া নারায়ণ্যম্বিকেতি চ।

আরও পড়ুন-বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেস জোট গড়ে লড়লেও আসানসোলে মেয়র বিধানের জয় নিশ্চিত

এই নির্দেশের পর সেই যে কৃষ্ণ জন্মলাভ করবেন দেবকীর ঘরে এবং পিতা-মাতার প্রত্যয়ের জন্য একবার বিষ্ণুরূপ ধারণ করে বসুদেবকেও তিনি নির্দেশ দিলেন বৃন্দাবন-গোকুলে রেখে আসতে এবং বললেন— আমারই মায়ারূপিণী যে মেয়েটি যশোদার কোলে জন্মেছে, তাকে নিয়ে এসো এইখানে— মন্মায়াম্-আনয়াস্তু ত্বং যশোদাগর্ভসম্ভবাম্। ঠিক এর পরেই যে ভগবান দেবকীর কোলে যে প্রাকৃত শিশুটি হয়ে গেলেন, ‘তারপরে আর গানের কথা মনে নাই।’ ভগবানের ভগবত্তা, ঐশ্বর্য সব তিনি ভুলে গেলেন, এবার কাজ আরম্ভ হল যোগমায়ার।
কাজ তো আরম্ভ হল, কিন্তু সে কাজটা যে কত কঠিন, সেটা ওই কংসের আছাড় খাওয়া মায়াবিনী কন্যা যখন কংসের হাত পিছলে আকাশে অষ্টভুজা দেবীমূর্তিতে দেখা দিলেন এবং জানালেন— তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে— এই কাজটা কিছুই নয়। যোগমায়ার আসল কাজ আরম্ভ জননী যশোমতীর ঘরে স্বয়ং ভগবানের শৈশব-লালনের সময় থেকে। আসলে যিনি সমস্ত জগতের ঈশ্বর, ভগবান, যার কনিষ্ঠাঙ্গুলি হেলনে তিন ভুবন আলোড়িত হয়, সেই ভগবানের ভগবত্তা নিয়েই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আসলে চরম ঐশ্বর্য, চরম মাধুর্য এবং আরও কিছুই যা চরম আছে— রূপ, বল, প্রভুত্ব— সেই সবগুলিই যেহেতু ভগবত্তার উপাদান, তাই সেগুলিকে চেপে রাখা খুব কঠিন। খুব চেপে রাখলেও তাঁর ঈশ্বর-স্বভাব, প্রভুত্ব, বিভুত্ব, বিভূতিগুলি প্রকট হয়ে পড়ে— প্রস্ফুটিত পুষ্প থাকে পল্লবে বিলীন, গন্ধ তার লুকাবে কোথায়? যোগমায়ার কাজ এইখানেই। তিনি পরম ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব, প্রভূত্ব, ঐশ্বর্য ভুলিয়ে রেখে তাঁকে লীলায়িত হবার সুযোগ দেন।

আরও পড়ুন-ইডেনে বাংলার বুট ক্যাম্প ট্রেনিং

যোগমায়া এমনই এক তত্ত্ব এবং তাত্ত্বিকভাবেই তিনি এমনই এক বিশেষ ক্ষমতাময়ী শক্তি যা স্বয়ং ভগবানকেও আপন নিয়ন্ত্রণে রাখে। ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ ভগবান যোগমায়ার সেই শক্তির একটা তাত্ত্বিক আভাস দিয়ে বলেছেন— আমি যখন যোগমায়ার দ্বারা সমাচ্ছন্ন থাকি তখন কেউ আমাকে ভগবান বলে চিনতে পারে না— নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়া-সমাবৃতঃ। বুড়ো টীকাকার শ্রীধরস্বামী এখানে বলেছেন— যোগমায়া শব্দের মধ্যে যোগ মানে হল— ভগবানের যুক্তি-ভাবনার অচিন্ত্য প্রজ্ঞাবিলাস এবং তিনি ভগবানের জীবনেও অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়া। তাই কৃষ্ণ তাঁর মর্ত্যজীবনে যা যা করতে চেয়েছেন, সেটা যে করতে পেরেছেন, সেটা এই যোগমায়ার চেষ্টায় এবং তাঁর কৃপায়। তবে যোগমায়ার আসল স্বরূপটা কী, সেটা সবচেয়ে ভাল বুঝিয়ে দিয়েছেন ভাগবত পুরাণের সবচেয়ে রসিক টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী।
তিনি চণ্ডী-মহামায়া দুর্গার সঙ্গে যোগমায়ার সামান্য তাত্ত্বিক পার্থক্য দেখিয়ে মন্তব্য করেছেন— মহামায়া-চণ্ডী আসংসার সমস্ত জীবকে কামনা-বাসনা-মমতার মোহে ভুলিয়ে রাখেন— তথাপি মমতাগর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ— আর ভগবতী যোগমায়া— তিনি স্বয়ং ভগবানকেই তাঁর পরম ঐশ্বর্য ভুলিয়ে দিয়ে জাগতিক মোহের আবর্তে ফেলে দেন। এখানেই ভগবতী যোগমায়া ভগবানের চাইতেও বড়।

আরও পড়ুন-পুরস্কার ঘোষণা পুতিনের

এমনটা যদি না হত যে, অর্থাৎ কৃষ্ণের এই নরলীলার মধ্যে মাঝে-মধ্যেই যদি কৃষ্ণের মনে হত যে, আমি তো সর্বশক্তিমান ভগবান, আমি তো সব করতে পারি, তাহলে তো যশোদা-জননীর কোনও বাৎসল্যের তিরস্কারও শুনতে হত না, খেটো কাপড় পরে সখা-সঙ্গে নটন-রঙ্গে গরুচরাতেও যেতে হত না, এমনকী গোষ্ঠযাত্রায় খেলার সময় খেলায় হেরে সুবল-সখাকে কাঁধে করে মাঠ পার করতে হত না। জননীর বাৎসল্য-রস উপভোগ করার সময় ভগবত্তার শক্তি মাথায় এলে যশোমতীই কি অমন সরলতায় বলতে পারতেন— আমার শপথি লাগে/না যাইও ধেনু আগে/পরাণের পরাণ নীলমণি।
আবার যে জননী ছেলেকে রাখালি করতে দিয়ে গরুর ভয় পান, তাঁর কী অবস্থা হয়, যখন নন্দরাজ তাঁর ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে বলেন যশোদাকে। যশোদা বলেন— আমার ছেলে দুগ্ধপোষ্য শিশু, এখনই বিয়ে কী? যশোদার কথা শুনে অবশ্য ব্রজরমণী চটুল গোপীরা অনেকেই কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছিল। কৃষ্ণসখা মধুমঙ্গল তো মৃদু স্বরে বলেই ফেলল— তোমার ছেলে সত্যিই দুগ্ধপোষ্য বটে, তবে সেটা কাদের বেশি দুগ্ধপোষ্য, সেটা যদি জানতে? আমি শুধু ভাবি— এই সময়ে কৃষ্ণ তাঁর ভগবত্তা ফলিয়ে বলতেন— মেলা বকাবকি কোরো না। আমি হলাম ভগবান, আমি যখন যা ইচ্ছে করতে পারি, তোমাদের এত কথা কী? আমি শুধু ভাবি— তাহলে কী আর নরলীলার কোনও আস্বাদন হত— যদি না ভগবতী যোগমায়া কৃষ্ণের ভগবত্তা ভুলিয়ে না রাখতেন!

আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছেন ঋষি

ভাগবত-পুরাণে যখন তাই শারদ-রজনীর সন্ধ্যাবেলায় কৃষ্ণের রাসলীলার উপক্রম হল, তখন পৌরাণিক জানালেন— স্বয়ং ভগবানের রতিসুখ আস্বাদনের ইচ্ছে হল বলে তিনি নিশ্চিন্তে যোগমায়ার আশ্রয় নিলেন— রন্তুং মনশ্চক্রে যোগমায়াম্ উপাশ্রিতঃ।

Latest article