বিলকিস বানো মামলার রায়ে জয় হল সত্যের

একজন মহিলা স্রেফ মুসলমান ধর্মাবলম্বী বলে উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের নির্যাতনের শিকার হলেন গুজরাত দাঙ্গার সময়। সেই নির্যাতনকারীরা জেল থেকে ছাড়া পেলে বিজেপির তরফে তাদের সংবর্ধিত করা হল। জেল থেকে ছাড়ার ক্ষেত্রেও বদমায়েশির আশ্রয় নেওয়া হয়। এসব নোংরামির মুখোশ ছিঁড়লেন ড. মইনুল হাসান

Must read

১৫ অগাস্ট জাতির জীবনে আনন্দের দিন। আমরা পতাকা তুলি। আলোর মালায় সাজাই ঘর। উৎসবে মাতোয়ারা হই। কিন্তু ২০২২ সালের ১৫ অগাস্ট আমাদের কাছে একেবারে আলাদা ছিল। সেদিন গুজরাতের বিজেপি সরকারের বদান্যতায় বিলকিস বানোর ধর্ষকরা মোট ১১ জন জেল থেকে মুক্ত হয়ে যায়। গুজরাত সরকারের এক মন্ত্রীর মত ছিল ধর্ষকদের নাকি যথেষ্ট জেল খাটা হয়ে গিয়েছে। সেদিন লজ্জায় দেশবাসী মাথা নত করেছিল। বিলকিস বানোর (Bilkis Bano Case) কাছে আমাদের কোনও জবাব ছিল না। নিজেদেরকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। কোনও কোনও সময় মনে হচ্ছিল এত নিরপেক্ষ প্রসাশন, সংবিধান, বিচার ব্যবস্থাতে কী লাভ! যদি ২০০২ সালের বিরল থেকে বিরলতর ঘটনার ইনসাফ বিলকিস না পায়?

২০০২ সালে গোধরায় ঘটনার পর ৩ মে দাহোড় জেলায় দবগড় বারিয়া গ্রামে দুষ্কৃতীরা হামলা চালায়। পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান বিলকিস বানো ও তাঁর পরিবার। বিলকিস তখন ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাঁকে, তাঁর মা ও আরও একজনকে গণধর্ষণের শিকার হতে হয়। এই ১১ জন আসামি সেই কাজ করে। দলে ছিল ২০ জন। বিলকিসের ৩ বছরের বাচ্চাকে পাথরে আছড়ে মেরে ফেলা হয়। আরও ৬ জনকে খুন করা হয়। বিলকিসকে শুধু ধর্ষিতা হতে হয়েছে তাই নয়। আত্মীয় ৭ জনের শহিদ হওয়া দেখতে হয়েছে। স্থানীয় থানা কোনও অভিযোগ নেয়নি। জাতীয় মানবাধিকারে যায় বিলকিস। তারপর সুপ্রিম কোর্ট সক্রিয় হয়। তদন্তে নামে সিবিআই। সিবিআই বিশেষ আদালতে পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেবার জন্য একটা রিপোর্ট দেয়। অভিযুক্তদের বাঁচাতে তারা রিপোর্ট তৈরি করে। গুজরাত হাইকোর্টে তখন মামলা। ২০০৪ সালে বিলকিস (Bilkis Bano Case) সুপ্রিম কোর্টে জানান, তিনি নিয়মিত প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছেন। কোথাও তাঁরা থাকার জন্য বাড়ি ভাড়া পাচ্ছেন না। পেলেও কিছুদিনের মধ্যে সেটা ছাড়তে হচ্ছে। ২ বছরে ২০ বারের বেশি বাড়ি পাল্টাতে হয়। গুজরাত পুলিশ, প্রশাসন ও গুন্ডারা প্রাণনাশের হুমকি দিয়েই চলেছে। ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে সিবিআই সমস্ত আসামিকে গ্রেফতার করে। মামলা সরিয়ে দেওয়া হয় মুম্বই হাইকোর্টে।

২০০৮ সালে ১১ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। প্রমাণের অভাবে অনেকে ছাড়া পায়। বিলকিস (Bilkis Bano Case) সবাইকে শনাক্ত করে। অপরাধীরা সবাই তার চেনা। ২০২২ সালে রাধেশ্যাম নামে একজন, যিনি তখন জেল খাটছেন, আবেদন করেন, তাঁদের ১৫ বছর জেল খাটা হয়ে গিয়েছে। তাঁদের মুক্তি দেওয়া হোক। বিচারপতি রাস্তোগি এ ব্যাপারে মতামত জানাবার জন্য গুজরাত সরকারকে বলেন। আপত্তি করেনি রাজ্য সরকার। ব্যাস, ২০২২ সালের স্বাধীনতার ৭৫ বৎসরের ‘অমৃতকালে’ সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনকে গুজরাতের সরকার ছেড়ে দেয়। আমার মনে করিয়ে দিতে হবে না। ২০০২ সালে ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০২২ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই ঘটনায় সারা দেশে, এমনকী বিদেশে সমালোচনা হয়। শীর্ষ আদালতে বহু মামলা হয়। বিলকিস বানো এই আদেশ ‘রিভিউ’ করে দেখার আবেদন জানান শীর্ষ আদালতকে। গুজরাত সরকার শীর্ষ আদালতে যে হলফনামা দিয়েছিল তাতে বলেছিল আসামিরা জেলে ভাল আচরণ করার জন্য তাদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। সর্বৈব অসত্য। শীর্ষ আদালতের চাপে ওই আসামিদের সমস্ত নথি আদালতে জমা পড়ে। এই ব্যাপারে যে রায় শীর্ষ আদালত দিয়েছিল তা প্রণিধানযোগ্য। ক) এখানে অর্থাৎ এই মামলায় গুজরাত সরকার সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমাহীন অপব্যবহার করেছে। অন্যের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে কর্তৃত্ব করেছে। খ) এমন একটা বিশেষ ধরনের কেসে অপরাধীদের আগাম মুক্তি দিয়ে শীর্ষ আদালতের নির্দেশকে আইনগত দিক থেকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। গ) গুজরাট সরকার অপরাধীদের সঙ্গে অবৈধ ও অনৈতিক যোগসাজশ চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে উল্লেখ করা ঠিক হবে যে, ছুতোনাতা কারণ দেখিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় অসামিদের প্যারোল মঞ্জুর করা হয়েছে এবং প্যারোলে ছাড়া পেয়েই বিলকিস বানো এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের উপর হুমকি দিয়েছে। একবার নয়, একাধিকবার। ঘ) গুজরাট সরকারের কোনও অধিকার নেই এমনতর আসামিদের জেলখাটার মেয়াদ কমানোর কথা বিবেচনা করা এবং তা মঞ্জুর করা।

আরও পড়ুন- ৩১ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে সংসদের বাজেট অধিবেশন

আজ সেই ছবিটা আমরা নিশ্চয় ভুলে যায়নি যে, অসত্য কাগজপত্র দাখিল করে, গুজরাত সরকারের পুরোপুরি সাহায্যে ১১ জন ধর্ষক আসামি যেদিন জেলখানা থেকে বেরিয়ে এল সেদিন বিজেপি লক্ষ লাড্ডু বিতরণ করেছিল। আর বিজেপি অফিসে নিয়ে গিয়ে এই ১১ জন ধর্ষককে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছিল। বিজেপির এই নেতারা, তাদের নেতারা নারীর সম্মানের কথা বলে। মানবাধিকারের কথা বলে।
বিলকিস বানোর ‘রিভিউ পিটিশন’ সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দেয়। কিন্তু তাকে দমানো যায়নি। তিনি ‘রিট পিটিশন’ করেন। আরও অনেকে শীর্ষ আদালতে মামলা দায়ের করেন। সবার মতামত প্রায় একই ছিল যে গুজরাত সরকারের এমন সাজা কমানো ও মুক্তি দেওয়ার অধিকার নেই। সুপ্রম কোর্ট ছাড়া পাওয়া আসামিদের আবার জেলে পাঠাবার নির্দেশ দিয়েছেন। দেশে যে আইন আদালত আছে এ-কথাটা বিজেপি সরকার ক্ষমতার দম্ভে ভুলে যেতে বসেছে। এটা সত্য নয়। ২০০২ সালে গুজরাতে সংখ্যালঘুনিধন কীভাবে হয়েছে সবাই জানে। গোধরাতে যা হয়েছিল তা ঘোরতর অন্যায়। কিন্তু ১৫০ কিমি দূরে বাস করা বিলকিস বানো তার জন্য দায়ী হবে কেন? তার তিন বছরের বাচ্চাটা দায়ী হবে কেন? প্রাক্তন সাংসদ এহেসান জাফরি দায়ী হবে কেন? এটা ছিল বিজেপির ও তার সরকারের পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

রায় ঘোষণার পর দীর্ঘদিন পর ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে ধরে হেসেছেন বিলকিস। আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। আশ্চর্য এই মহিলা! গত ২০ বছরে তাঁর ২০ বছর বয়স বেড়েছে। এই সময়ে আমার সঙ্গে তার ৩ বার দেখা হয়েছে। অসম্ভব দৃঢ়তা। মনের বল। এর নাম নারীশক্তি। দোষীদের শাস্তির জন্য অচঞ্চল থেকে সব প্রলোভন জয় করেছেন। সারা ভারত অন্তর তাঁকে রক্ষা করেছে। পরিবারের ৭ জনকে মারা যেতে দেখেও যিনি বেঁচে আছেন, লড়াই করছেন তাঁকে সেলাম না জানিয়ে পারা যায় না। একা লড়েছেন গুজরাত সরকারের বৈভবের বিরুদ্ধে। সঙ্গে তার আইনজীবী প্রভা গুপ্তা, আর বিশিষ্ট সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদ। সত্যের জয় হবে। সেই জয় পেয়েছেন বিলকিস। সেলাম আপনাকে।

Latest article