নয়ের দশকের বিশিষ্ট কবি বিশ্বজিৎ রায়। হাতে এসেছে তাঁর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসার নৌকা’। প্রত্যেকটি কবিতাই উৎসর্গ করা হয়েছে বিভিন্ন কবিকে। অতীত দিনের কবিরা যেমন আছেন, তেমন আছেন বর্তমান সময়ের কবিরা।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
নিচু স্বরে কথা বলেন এই কবি। কান পাততে হয়। মন পাততে হয়। রাজপথ নয়, তাঁর কবিতা বেছে নেয় নির্জন অলিগলি। যেখানে মুখোমুখি হওয়া যায় নিজের। দীর্ঘ কবিতা-সফরে তিনি খুঁজে পেয়েছেন আপন কাব্যভাষা। কয়েক পঙক্তি এগোলেই চিনে নেওয়া যায়। ‘চাঁদ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘চাঁদের আলো দেখে শব্দরা ছুটে এল দল বেঁধে।’ এই ‘শব্দরা’ শোষিত, নির্যাতিতর দল। কেমন দশা তাদের? ‘শরীরে অন্ধকার, বালি-মাটি মাখা,/ ছিঁড়েফুটে গেছে এখানে ওখানে…/ অনেকদিন পর হঠাৎ আলোর স্পর্শ পেয়ে/ মেতে উঠলো সবাই আনন্দস্নানে।’ মুক্তি চায় তারা। আঁধার মুছে ফিরতে চায় আলোয়। কবিতায় ফুটে উঠেছে সময়ের ছবি। সমাজের ছবি। প্রবলভাবে রয়েছে নিষ্ঠুর শাসকের অদৃশ্য উপস্থিতি।
আরও পড়ুন-ফের বিজেপির নোংরা চক্রান্ত, তোপ মহুয়ার
শব্দের প্রসঙ্গ এসেছে আরও একটি কবিতায়। শিরোনাম ‘চাষি’। প্রথম পঙক্তি এইরকম, ‘শব্দরা আমার কাছে বন্ধুর মতো আসে’ কীভাবে আসে? ‘পাখির মতো ডানা মেলে আসে…/ আগুন ও প্রেম বুকে বেঁধে মেঘের ভেলায় চেপে আসে।’
কবিতার আরও কিছু অংশ রয়েছে। তবু থামতে হল এখানেই। অদ্ভুত বৈপরীত্য। প্রেম ও আগুন। পাশাপাশি। দোঁহের মিলনে হতে পারে কোনও সৃষ্টি। আবার ধ্বংসও। দুটিকে বুকে বেঁধে পাখির মতো যে উড়ে যায়, সে যৌবনের প্রতীক। তারুণ্যের প্রতীক। এই কবিতার ‘শব্দরা’ কোনও বাধা তোয়াক্কা করে না। এগিয়ে যায়। জাগায়, ভাবায়।
আরও পড়ুন-ভিন রাজ্যের ভোটে বাংলার স্কিম নকল
‘দৈববাণী’ কবিতার প্রথম পঙক্তি, ‘এমন কবিতা লেখো, যেন গাছেরা শুনতে পায়।’ সরল উচ্চারণ, অথচ গভীর। গাছ এখানে শুদ্ধতার প্রতীক। তার কাছে পৌঁছতে পারে একমাত্র উৎকৃষ্ট কবিতা। তেমন কবিতা লেখার কথাই বলা হয়েছে। পঙক্তিটুকু পৃথক একটি কবিতার রূপ পেতে পারে। এ ছাড়াও মন ছুঁয়ে যায় ‘বিশ্বপথিক’, ‘ছায়াপ্রতিমা’, ‘বেশ আছি’, ‘দোসর’, ‘সিম্ফনি’ প্রভৃতি কবিতাগুলো। প্রকাশক সারঙ্গ। প্রচ্ছদশিল্পী সৈকত নায়েক। দাম ২২০ টাকা।
আরও পড়ুন-রাসেল, নারিনকে ছেডে় দিতে পারে কেকেআর
এই সময়ের একজন শক্তিমান কবি অসিতবরণ চট্টোপাধ্যায়। এই বছর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘রাস্তা যেখানে এসে থামে’। কবিতাগুলো বহুমাত্রিক। মনকে নিয়ে যায় অন্য জগতে। প্রেমের কথা বলেন কবি। বলেন প্রেমহীনতার কথাও। ধরা পড়েছে বিচিত্র সম্পর্কের জলছবি। ‘আঘাত ও অপরাধপ্রবণতা’ কবিতায় কবি লেখেন, ‘যে যায় সে আর ফিরে আসে না/ অথবা যে ফিরে আসে সে বুঝি আগের মতো নয়।’ জীবনকে দেখান কবি, চেনান। অক্ষরে অক্ষরে। সম্পর্ক ছিঁড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ফিরে আসা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নয়। তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে শর্ত, অঙ্ক, সমীকরণ। যাওয়া এবং আসার মধ্যিখানে বিস্তর ব্যবধান। ঘটে যায় মনের বদল। উভয়ের।
আরও পড়ুন-মানবসভ্যতার বিপদ এড়াতেই কি বরখাস্ত হন অল্টম্যান? চাঞ্চল্যকর তথ্য
‘কথার পিঠে’ কবিতার প্রথম পঙক্তি, ‘সাতাশ বছর তুমি আমার সঙ্গে নেই। নেই।’ এই দ্বিতীয় ‘নেই’-এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে প্রয়োগটি যথার্থ। দ্বিতীয় ‘নেই’ কারও না-থাকাটা অনেক বেশি সুস্পষ্ট করেছে।
‘খেলা’ এক আশ্চর্য কবিতা। শুরুটা এইরকম, ‘আমি দেখছি না এই মৃত্যু।’ মনে হতে পারে বলা হল কোনও মানুষের মৃত্যু নিয়ে। ভাবনা বদলে যায় পরের অংশে, ‘দেখছি না/ কীভাবে একটা শতাব্দীপ্রাচীন কোলাহল/ প্রোমোটারের শাঁড়াশি-আক্রমণে/ মুখে গাঁজলা উঠে মরে যায়।’ গৃহস্থের অন্দরে আছড়ে পড়েছে প্রোমোটারের থাবা। ‘শতাব্দীপ্রাচীন কোলাহল’-এ দাঁড়ালে ছায়াছবির মতো ভেসে ওঠে প্রশস্ত ঘরদুয়ার। মানুষের পাশে মানুষ। ব্যস্ততা। সুখ-দুঃখ হাসি কান্নার মহাসম্মিলন। মুহূর্তগুলো আজ অতীত, মৃত। কবিতাটি বুকের গভীরে তীব্র হাহাকার জাগায়। এছাড়াও ভাল লাগে ‘সরল গণিত’, ‘ঋতুবিহারী পাখি’, ‘প্রেসার কুকার’, ‘ভানুমতী’ প্রভৃতি কবিতাগুলো। প্রকাশক দাঁড়াবার জায়গা। প্রচ্ছদ সুমন হাজরা। দাম ১৮০ টাকা।